রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সম্পর্ক আলোচনা কর।

by - April 02, 2022

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সম্পর্ক আলোচনা কর। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস কীভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল ? 

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য। 

Relation between political science and history . ( In Bengali ). 




রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সম্পর্ক :- 


রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস - উভয় শাস্ত্রই সমাজ বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা। উভয় শাস্ত্রই মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা করে। আবার অন্যভাবে বলতে গেলে উভয় শাস্ত্রই পরস্পর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সম্পর্ক বিচার করতে গিয়ে John Seeley মন্তব্য করেছেন - History without political science has no fruit ; Political science without history has no root. এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সম্পর্ক অতি গভীর। 

'' History is past politics , politics is present history. '' - Freeman 

'' Political science stands midway between History and politics , between past and present. It has drawn material from the one , it has to apply them to the other. '' - Lord Bryce. 


রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সাদৃশ্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা  :- 


১. রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস উভয় বিষয়ই মানুষের সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। মানুষের রাজনৈতিক জীবন উভয় শাস্ত্রেই আলোচিত হয়। 

২. বর্তমান হল অতীতের পরিবর্তিত রূপ। আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় উপাদান ও বৈশিষ্ট লুকিয়ে আছে অতীতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাস থেকে অতীত সমাজের ধারণা গ্রহণ করে বর্তমান সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে। 

৩. ইতিহাস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বর্তমান সমাজের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি সম্পর্কে  বিশ্লেষণাত্মক আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই সাধারণ সূত্রগুলির মাধ্যমে বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। 

৪. ইতিহাসের ধারণা ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা সম্পূর্ণ নয় ; আবার রাষ্ট্রনৈতিক আলোচনা ছাড়া ইতিহাস অসম্পূর্ণ। উভয় শাস্ত্র পরস্পরের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।  

৫. রাষ্ট্রের আলোচনাকে সম্পূর্ণতা প্রদান করতে হলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি , ইতিহাস , বিবর্তন , ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ঘটনাবলী - ইত্যাদি বিষয়গুলি সংযুক্ত করা দরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই সকল জ্ঞান ইতিহাস থেকে লাভ করে। এইভাবে ইতিহাসের সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার আলোচনাকে সম্পূর্ণ করে তোলে। 

৬. আবার ইতিহাসও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ , কারণ অনুসন্ধান , ফলাফল বিচার - ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে। এইভাবে ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে রাষ্ট্র সম্পর্কে তার আলোচনাকে যুক্তিগ্রাহ্য ও রাষ্ট্রনৈতিক করে তোলে। 

৭. রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন উপাদান যথা - স্বাধীনতা ,জাতীয়তাবাদ , আন্তর্জাতিকতা , সমাজতন্ত্রবাদ - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তত্ত্বমূলক আলোচনা করে এবং এক্ষেত্রে ইতিহাসের আলোচনা মূলতঃ তথ্যভিত্তিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা বিষয়গুলি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা অর্জন করতে পারি এবং ইতিহাসের মাধ্যমে বিষয়গুলি বাস্তবে কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে - সে সম্পর্কে ধারণা গঠন করতে পারি। 

৮. মানুষের রাজনৈতিক জীবন ও রাজনৈতিক কার্যকলাপকে বাদ দিয়ে কোনো দেশের ইতিহাস সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারেনা। ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাছ থেকে মানুষের রাজনৈতিক জীবন , বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান , রাজনৈতিক তত্ত্ব - ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে তোলে। 


রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের পার্থক্য / বৈসাদৃশ্য :- 


১. বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা :- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় ইতিহাসের বিষয়বস্তু অনেক বেশি ব্যাপক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র মানুষের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু ইতিহাস মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ , অর্থনীতি , সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। 

২. মূল্যবোধের পার্থক্য :- রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করে। তাই এই ধরণের আলোচনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত পক্ষপাত প্রযুক্ত হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস মূল্যবোধের আলোচনার উর্দ্ধে। ইতিহাস শুধুমাত্র প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনার বিশ্লেষণ করে , ঘটনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনা। 

৩. কাল্পনিক তত্ত্বগত পার্থক্য :- রাষ্ট্রবিজ্ঞান বহু আলোচনায় কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন রাষ্ট্রের উৎপত্তি , জাতীয় জীবনের উৎপত্তি ও বিকাশ - ইত্যাদি সম্পর্কে বহু কাল্পনিক তত্ত্বের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ইতিহাস কখনো কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেনা। শুধুমাত্র প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনার বিবরণ দেয়। 

৪. পদ্ধতিগত পার্থক্য :- ইতিহাস তার বিষয়গুলির বর্ণনাত্মক বিবরণ দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র কিছু তত্ত্ব ও ঘটনা সংক্রান্ত আলোচনা করে। ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে সামাজিক জীবনের ব্যাখ্যা প্রদান করে ; কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের উপর আলোকপাত করে। 

৫. ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে পার্থক্য :- ইতিহাসের আলোচনা ধারাবাহিক ; অর্থাৎ , ইতিহাস সময়ের ধারাবাহিক ঘটনাবলীর বিবরণ দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ধারাবাহিক বিবরণের পরিবর্তে শুধুমাত্র মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সাথে যুক্ত ঘটনা ও বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে। 

৬. পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে পার্থক্য :- রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবলমাত্র ইতিহাস থেকেই তথ্য সংগ্রহ করেনা ; ইতিহাস ছাড়াও নৃতত্ব , দর্শন - ইত্যাদি শাস্ত্র থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু ইতিহাস অনেক বেশি করে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান , সাহিত্য - ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। 

৭. রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের আলোচনার ক্ষেত্রে পার্থক্য :- মানুষের রাজনৈতিক জীবনের আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাস বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে তত্ত্ব নির্মাণ করে। 

৮. বস্তুনিষ্ঠ ও আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান :- ইতিহাস হল মূলত একটি বস্তুনিষ্ঠ বা বিষয়নিষ্ঠ সমাজবিজ্ঞান। ইতিহাস কখনোই ঔচিত্যের কথা আলোচনা করেনা - সে শুধু ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় জীবনের ব্যাখ্যা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে উচিত , অনুচিত ও নীতিগত দিকটিও তুলে ধরা হয়। 

পরিষেশে বলা যায় , রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয় শাস্ত্রের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান - তা অস্বীকার করা যায়না ; উভয় শাস্ত্রই একে - অপরের পরিপূরক ও সাহায্যকারী। আসলে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং কোনো শাখাকেই অপর শাখা থেকে পৃথক করা যায়না।  

                        
  

You May Also Like

0 comments