রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি - পরিধি আলোচনা কর।

by - April 01, 2022

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি - পরিধি আলোচনা কর। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র সম্পর্কে আলোচনা কর। 

Nature and scope of Political Science. ( In Bengali ).  



রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি - পরিধি :- 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচনা ক্ষেত্র হল সমাজ এবং সমাজে অবস্থানকারী মানুষের রাজনৈতিক আচরণ। যেহেতু সমাজ ও মানুষের আচরণ সর্বদা পরিবর্তনশীল তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয় বস্তুও পরিবর্তনশীল। মানুষের সতত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ও কার্যাবলী পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রেও গতিশীল হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি - পরিধি , আলোচনা ক্ষেত্র সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল - 


১. রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত আলোচনা :- রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন তত্ত্ব বর্তমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সেই সকল তত্ত্বগুলিকে তুলে ধরে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার চেষ্টা করে। এছাড়াও রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদান , কার্যাবলী - ইত্যাদি বিষয়েও রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে। 

২. রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও বিভিন্নতা সম্পর্কে আলোচনা :- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত। এই সকল রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - রাষ্ট্রপতি শাসিত রাষ্ট্র , সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত রাষ্ট্র , এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার , একক পরিচালক ও বহুপরিচালক - ইত্যাদি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই সমস্ত ধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট , দোষ - গুন - ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করে।   


৩. সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগ - আইন , শাসন ও বিচার বিভাগ সংক্রান্ত আলোচনা :- প্রতিটি রাষ্ট্রে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত প্রধান তিনটি বিভাগ হল - আইন , শাসন ও বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই প্রতিটি বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করে। প্রতিটি বিভাগের ভূমিকা ও কার্যাবলী , গঠন , স্বাধীনতা রক্ষার শর্ত - ইত্যাদি বিষয়গুলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় প্রাধান্য পায়।   

৪. বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ সম্পর্কিত আলোচনা :- রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় ও উপাদান সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানগন বিভিন্ন মতবাদ তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিজের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় সেই সকল মতবাদগুলিকে স্থান দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী করে তুলেছে। মার্কস , প্লেটো ,অ্যারিস্টটল , হবস , লক , রুশো , জন মিল , গেটেল , গার্নার - প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদেরা যেসকল মূল্যবান মতবাদ প্রবর্তন করেছেন - রাষ্ট্রবিজ্ঞান সেগুলিকে নিয়ে আলোচনা করে। 

৫. আন্তঃবিষয়কেন্দ্রিক আলোচনা :- রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি গতিশীল সমাজবিজ্ঞান। প্রতিটি সমাজবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাস , সমাজতত্ত্ব , অর্থনীতি , নৃতত্ব , জন - প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সেই সম্পর্ক , তাদের মধ্যেকার সাদৃশ্য - বৈসাদৃশ্য - ইত্যাদি সমস্ত কিছু নিয়েই আলোচনা করে। 

৬. রাজনৈতিক দল , চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী , জনমত সম্পর্কিত আলোচনা :- প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল ,চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও জনমতের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়।  রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট ও ভূমিকা , চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কার্যাবলী , জনমতের প্রভাব , জনমত গঠনের প্রক্রিয়া , জনমতের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির সম্পর্ক - ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে। 


৭. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কিত আলোচনা :- প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি প্রধান কাজ হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অংশগ্রহন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিটি রাষ্ট্র তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন ধরণ , আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস , বর্তমান পরিস্থিতি , বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভূমিকা - ইত্যাদি বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টিকে প্রাঞ্জল করে তোলে। 

৮. তত্ত্বগত ও ফলিত রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা :- সিজউইক , পোলক - প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়গুলিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন - তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক রাজনীতি। রাষ্ট্রের উৎপত্তি , বিবর্তন , আইন , স্বাধীনতা , ন্যায় , সাম্য - ইত্যাদি হল তত্ত্বগত আলোচনা এবং সরকার , কূটনীতি , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক , রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান - এগুলি হল ব্যবহারিক বিষয়বস্তু। 

৯. ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সংক্রান্ত আলোচনা :- বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা - যেমন - ভোটদাতা হিসাবে ব্যক্তির ভূমিকা , প্রশাসক হিসাবে ব্যক্তির ভূমিকা - ইত্যাদি বিষয়গুলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। আবার বেন্টলে প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীর ভূমিকাকেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। 

১০. প্রভাব ও প্রভাবশালীদের সম্পর্কে আলোচনা :- লাসওয়েল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ প্রভাব ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী সম্পর্কিত আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্থান দিয়েছেন। প্রভাবশালী গোষ্ঠী হল সেইসকল গোষ্ঠী যারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করে। 

১১. বিরোধ ও অনৈক্য সংক্রান্ত আলোচনা :- রবার্ট ডাল , অ্যালান বল - প্রমুখেরা রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেকার বিরোধ ও অনৈক্যকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদান ও প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিরোধ ও অনৈক্য বর্তমান। সেই বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে। 

১২. অতিসাম্প্রতিক পরিধি ও উত্তর - আধুনিকতা ও বিশ্বায়ন :- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  পরিধি সদা পরিবর্তনশীল। এই কারণে আধুনিক মতবাদের পর উত্তর আধুনিক মতবাদের উদ্ভব হয়। উত্তর আধুনিক বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্ত হল বর্তমান রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক , রাজনৈতিক পরিবর্তনশীলতা - ইত্যাদি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উত্তর - আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন - এরিক হবসবম। 

১৩. মার্কসবাদ সম্পর্কিত আলোচনা :- মার্কসবাদীদের মতে , রাষ্ট্র হল শ্রেণী শোষণের যন্ত্র এবং এর ফলে রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম ও বিপ্লব সংগঠিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান মার্কসবাদের - শ্রেণী ও বিপ্লব তত্ত্ব , সাম্যবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে সমৃদ্ধ করেছে। 

১৪. আচরণবাদের আলোচনা :- আচরণবাদীরা গণিত , সংখ্যাতত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে মূল্যমান নিরপেক্ষ করে তোলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান আচরণবাদী আলোচনা ও তত্ত্বগুলিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় স্থান দিয়ে আলোচনাকে মূল্যমান নিরপেক্ষ করে তুলেছে।     

পরিশেষে বলা যায় , রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রকে কোনো সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। যেহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিবর্তনশীল সমাজ থেকে তার উপাত্ত সংগ্রহ করে , সেহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিও পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতাই প্রতিটি সমাজবিজ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট।       


You May Also Like

0 comments