ভারতে জাতিভেদ প্রথায় পরিবর্তনের কারণ।

by - April 13, 2022

ভারতে জাতিভেদ প্রথায় পরিবর্তনের কারণ। 

Factors responsible for change caste system in India . ( In Bengali ) 



ভারতে জাতিভেদ প্রথায় পরিবর্তনের কারণ। 

ঊনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণের হাত ধরে ভারতে জাতি ব্যবস্থায় পরিবর্তন দ্রুত হতে শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে পূর্বতন জাতি ব্যবস্থার সাথে বর্তমান জাতি ব্যবস্থার ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ভারতে জাতিভেদ প্রথায় পরিবর্তনের কারণগুলি নীচে আলোচনা করা হল। 

১. আধুনিক শিক্ষার ভূমিকা :- 
ভারতে ইংরেজরা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন করে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতে ব্যাপকভাবে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো হয়। তথাকথিত নীচু জাতের মানুষেরা , যারা চিরকাল শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল , তারা শিক্ষালাভ করতে শুরু করে। ভারতে আধুনিক শিক্ষা জাত - ব্যবস্থার প্রাধান্যকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে। আধুনিক শিক্ষালাভের মাধ্যমে মানুষের আরোপিত মর্যাদার তুলনায় অর্জিত মর্যাদার গুরুত্ব সমাজে অধিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।     

২. সাংবিধানিক ব্যবস্থা :- 
ভারতীয় সংবিধানে ১৪ - ১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সাম্যের অধিকারে বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং সকলেই আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার পাবে। এছাড়াও , তফসিলি জাতি , উপজাতি ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা স্বীকৃত হয়েছে। এইসকল সাংবিধানিক ব্যবস্থা জাতি ব্যবস্থার প্রাধান্যকে দূর করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। 


৩. বিভিন্ন সাংবিধানিক আইন :- 
ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ কিছু আইন জাতি ব্যবস্থার প্রাধান্যকে দূর করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন - 
হিন্দু বিবাহ আইন ( ১৯৫৫ ) , অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন ( ১৯৫৬ ) ,  The Caste Disabilities Removal Act ( ১৮৫০ ) , বিশেষ বিবাহ আইন ( ১৮৭২ ) - ইত্যাদি। বর্তমানে ভারতে অস্পৃশ্যতামূলক আচরণ আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। 

৪. ব্রাহ্মণদের প্রভুত্ব বিরোধী আন্দোলন :- 
ভারতে স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণদের প্রভুত্ব বিরোধী বহু আন্দোলন সংগঠিত হয়। এইসকল আন্দোলনগুলি সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রভুত্ব ও বিশেষ সুযোগ সুবিধার অধিকারকে নাকচ করার দাবী জানায়। এর ফলে সমাজে ব্রাহ্মণদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে কমে যায়। এই সকল আন্দোলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - জ্যোতিরাও ফুলে -র '' সত্যশোধক সমাজ '' আন্দোলন , ডক্টর বি আর আম্বেদকরের '' চৌদার পুকুর আন্দোলন '' , এছাড়াও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে প্রবেশের দাবীতে আন্দোলন - ইত্যাদি। 

৫. বিভিন্ন সমাজ সংস্কার আন্দোলন :- 
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে বাংলার নবজাগরণের যুগ বলা হয়। এই সময়ে বিভিন্ন সমাজ সংস্কার আন্দোলন সমাজে সকলের শিক্ষা , কুসংস্কার দূরীকরণ , নারী শিক্ষার বিস্তার - ইত্যাদির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই সকল আন্দোলনগুলির মধ্যে দিয়ে পক্ষান্তরে ভারতে জাতিভেদ প্রথার পরিবর্তন সাধিত হয়। ব্রাহ্মসমাজ , আর্যসমাজ , রামকৃষ্ণমিশন , সত্যসাধক সমাজ - ইত্যাদি সংগঠনের আন্দোলন মূলত ছিল সমাজের অসাম্যগুলিকে দূর করে মুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা। 

৬. ভারতে গণতন্ত্রের বিকাশ :- 
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে সামাজিক ও জাতিগত অসাম্যের মূল উপাদানগুলি বিলুপ্ত হতে থাকে। গণতন্ত্রে জাতি - গোষ্ঠী - ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করা হয়। 


৭. নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তন :- 
স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বে এবং পরবর্তী সময়ে বহু আন্দোলন , শিক্ষার বিস্তার , সাংবিধানিক ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতীয় নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তন ঘটে। এর সাথে সাথে নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি যুক্ত হলে , দুর্বল জাতি হিসাবে নারীদের দমন ও বঞ্চিত করে রাখার প্রক্রিয়া বহুলাংশে হ্রাস পায়। 

৮. শিল্পায়নের প্রভাব :- 
স্বাধীনতার  পরবর্তীকালে ভারতে ভারী শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এর ফলে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে ভারতে চিরাচরিতভাবে চলে আসা জাতের ভিত্তিতে কর্ম - এই ধারণার বিলুপ্তি ঘটে। এই সময়কাল থেকেই জাত ও বর্ণের ভেদাভেদের উর্ধে উঠে মানুষ বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে জাতিপ্রথার প্রাধান্য ম্লান হয়ে পড়ে। 

৯. নগরায়ণের প্রভাব :- 
শিল্পায়ন ও নগরায়ণ পরস্পর সম্পর্কিত। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে দ্রুত নগরায়ণের বিস্তার ঘটতে থাকে। নগরের মানুষের আধুনিক ও ব্যাস্ত জীবনযাত্রায় জাতি প্রথার কোনো গুরুত্ব থাকেনা। জাতিভেদের বিভিন্ন বাধানিষেধ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। 

১০. আধুনিকীকরণ ও পাশ্চ্যত্যের প্রভাব :- 
ভারতে ব্রিটিশদের হাত ধরে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন উপাদান ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রবেশ করতে শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বায়নের ফলে ভারতীয় সমাজ আন্তর্জাতিক সমাজে পরিণত হয়েছে ও সারা বিশ্বের সকল আধুনিক উপাদানগুলোকে গ্রহণ করেছে। এই সকল আধুনিক সামাজিক উপাদান জাতিপ্রথাকে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

১১. বিভিন্ন মনিষীদের ভূমিকা :- 
ভারতের বিভিন্ন মনীষীগণ জাতপাতের বিরুদ্ধে তাঁদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। যেমন রাজা রামমোহন রায় , স্বামী বিবেকানন্দ , শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস , মহাত্মা গান্ধী , ডক্টর বি আর আম্বেদকর , জ্যোতিরাও ফুলে - প্রমুখ। মনিষীগণ তাঁদের আদর্শের মাধ্যমে মানবধর্মকে তুলে ধরেছিলেন। জাতপাতের উর্ধে উঠে তারা শিক্ষা , মানুষের অধিকার ও প্রকৃত মানবধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

১২. নতুন সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব :- 
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব হয়। এর পেছনে কিছু সামাজিক ও সাংবিধানিক কারণ দায়ী ছিল। যেমন স্বাধীনতালাভের পরবর্তীকালে ভারতে রাজতন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটে ও বিভিন্ন সময়ে জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি ঘটে। এছাড়াও স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে পুঁজিপতি , মধ্যবিত্ত - ইত্যাদি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই নতুন সামাজিক শ্রেণীগুলি মূলত শ্রম - বিভাজন দ্বারা গঠিত হয় ; জাতের ভিত্তিতে নয়। 

পরিশেষে বলা যায় , ভারতে জাত ব্যবস্থার পরিবর্তন হঠাৎ করে সংগঠিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়ার দ্বারা তা প্রভাবিত হয়েছে এবং এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বর্তমানেও সমানভাবে ত্বরান্বিত হচ্ছে। 

   

You May Also Like

0 comments