সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট :-

by - April 12, 2022

সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট :- 

Social Stratification : Definition and features . ( In Bengali ). 




সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণা ও সংজ্ঞা :- 


জিসবার্ট বলেছেন , সামাজিক স্তরবিন্যাস হল প্রাধান্য ও বশ্যতার সূত্রে পরস্পর সম্পর্কিত স্থায়ী গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ভিত্তিতে সমাজের স্তরবিভাগ। 

সরোকিনের মতে , জনগণকে পর্যায়ক্রমে বিভক্ত করার প্রক্রিয়া হল সামাজিক স্তরবিন্যাস। 

বটোমোর বলেছেন , মর্যাদা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে বিভক্ত কতকগুলি শ্রেণী বা স্তরের উর্দ্ধক্রমে অবস্থিতিকে সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে। 

মেলভিন ও টিউমিন বলেছেন , ক্ষমতা , সম্পত্তি , সামাজিক অবস্থান - ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে বৈষম্য দেখা যায় , তার ভিত্তিতে গঠিত সমাজের ক্রমোচ্চ বিভাজন হল সামাজিক স্তরবিন্যাস। 

অগবার্ন ও নিমকফ বলেছেন , সামাজিক স্তরবিন্যাস হল একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক ব্যক্তিবর্গকে মর্যাদার ক্রমানুসারে সাজানো হয়। 

সুতরাং  , সামাজিক স্তরবিন্যাস হল এমন একটি চিরন্তন , সার্বজনীন এবং আবশ্যিক সামাজিক পরিস্থিতি , যার মধ্যে দিয়ে মানুষের সম্পত্তি , মর্যাদা ও ক্ষমতার পার্থক্য চিহ্নিত হয় এবং মানবিক সম্পর্কের গতি - প্রকৃতি নির্ধারিত হয় ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিকীকরণ ঘটে। 


সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট :- 


১. সামাজিক স্তরবিন্যাস মূলত সামাজিক প্রকৃতির। দৈহিক পার্থ্যক্যগুলির তুলনায় মানুষের সম্পত্তি , মর্যাদা , ক্ষমতা - ইত্যাদির পার্থ্যক্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক স্তরবিন্যাস গড়ে ওঠে। 

২. সামাজিক স্তরবিন্যাস হল একটি চিরন্তন ও সার্বজনীন ঘটনা। সমাজের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি সময়ে , প্রতিটি সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাসের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। 

৩. সামাজিক স্তরবিন্যাস সামাজিক মান - মর্যাদা প্রভৃতির নিয়ামক। সামাজিক মর্যাদা সিঁড়িতে যে ব্যক্তি বা শ্রেণী উপরের দিকে থাকেন - তারা অধিক ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা লাভ করেন। পক্ষান্তরে মর্যাদা সিঁড়ির নীচের দিকে থাকা ব্যক্তি বা শ্রেণী কম সুযোগ - সুবিধা ভোগ করেন বা অধিকারহীন শ্রেণীতে পরিণত হন। 

৪. সামাজিক স্তরবিন্যাসের কোনো জৈব তাৎপর্য নেই। মানুষের সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক স্তরবিন্যাস রচিত হয়। 

৫. সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজে বসবাসকারী সকল ব্যক্তিবর্গকে প্রভাবিত করে। সমাজে অবস্থানকারী প্রতিটি ব্যক্তি কোনো না কোনো মর্যাদা সিঁড়িতে অবস্থান করছেন। এই মর্যাদা সিঁড়িতে অবস্থানের পার্থ্যক্যের ভিত্তিতেই সামাজিক মর্যাদা স্থির হয়। 

৬. সামাজিক স্তরবিন্যাসের সাথে সামাজিকীকরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক মর্যাদা সিঁড়িতে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী বিভিন্ন ব্যক্তি বা শ্রেণী সমাজকে প্রভাবিত করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয় এবং তা সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। 

৭. সামাজিক স্তরবিন্যাস সামাজিক মিথষ্ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই মিথস্ক্রিয়া কেবলমাত্র অভিন্ন স্তরভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সংগঠিত হয় যেমন - বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন অথবা , সামাজিক লৌকিকতা পালনের বিশেষ বিশেষ রীতি - পদ্ধতি। এই সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক স্তরবিন্যাস নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। 


৮. সামাজিক স্তরবিন্যাসের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে সহযোগিতা , সহাবস্থান ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক তৈরী হয়। বিভিন্ন সামাজিক মর্যাদায় অবস্থানকারী ব্যক্তিদের উন্নততর স্তরে উত্তরণের স্পৃহা থেকে সমাজ পরিবর্তন , সমাজ উন্নয়ন ইত্যাদি প্রক্রিয়া সংগঠিত হয় সহাবস্থান ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানের ভিত্তিতে। 

৯. বিভিন্ন সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাসের চরিত্র অভিন্ন হয়না। দেশ - কাল ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটলেও সামাজিক স্তরবিন্যাসের মৌলিক চরিত্র অপরিবর্তিত থাকে। 

১০. সামাজিক স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যায়ন সম্ভব। সমাজে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গ মর্যাদা সিঁড়ির বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন এবং সমাজে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করেন ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করেন। এই সকল ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়াগুলির ভিত্তিতে সমাজে তাদের মূল্যায়ন সম্ভব হয়। 

১১. সামাজিক স্তরবিন্যাসের ফলে সমাজে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গ দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পায়। প্রতিটি সমাজে , প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা উভয়ই বর্তমান। এই পরস্পর বিপরীতমুখী সামাজিক প্রক্রিয়া ব্যক্তিবর্গকে মর্যাদা সিঁড়িতে উচ্চস্তরে অবস্থানের প্রেষণা যোগায় এবং এর ফলেই সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। 

১২. সামাজিক স্তরবিন্যাস আরোপিত ও অর্জিত উভয়ই হতে পারে। কোনো ব্যক্তি বংশানুক্রমে মর্যাদা সিঁড়িতে অবস্থান করে। আবার কেউ নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক মর্যাদার একটি নির্দিষ্ট সিঁড়ি অর্জন করে। 

১৩. মৌলিক চরিত্র অপরিবর্তিত থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সামাজিক স্তরবিন্যাসের ভিন্নরুপতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন - ভারতীয় সমাজ মূলত ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য , শুদ্র - এই চারভাগে বিভক্ত ছিল। আবার আফ্রিকায় পশুপালক ও কৃষকেরা বাহিমা ও বাইরু - এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। 

১৪. সামাজিক স্তরবিন্যাস ফলপ্রদায়ী বা অনুবন্ধী প্রকৃতির। সামাজিক মর্যাদা সিঁড়িতে অবস্থানকারী প্রতিটি ব্যক্তি সামাজিক ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা লাভ করে। মর্যাদা সিঁড়ির উপরের দিকে অবস্থানকারী ব্যক্তিরা অধিক সুযোগ সুবিধা লাভ করেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় , ভারতীয় হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণরা অধিক সামাজিক মর্যাদা লাভ করেন। 

১৫. সামাজিক স্তরবিন্যাস স্থিতিশীল নয় ; এটি চলমান ও গতিশীল প্রক্রিয়া। সামাজিক মর্যাদা সিঁড়ির একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থানকারী ব্যক্তি নিজের দক্ষতা , যোগ্যতা , শিক্ষা - ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে মর্যাদা সিঁড়িতে নিজের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।


You May Also Like

0 comments