ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ড ও ইউরোপে তার প্রতিক্রিয়া।

by - February 09, 2022

ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ড ও ইউরোপে তার প্রতিক্রিয়া।   

Execution of Louis XVI and reaction in Europe. ( In Bengali ) 



ফরাসি বিপ্লবের অগ্রগতি : ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ড। 


ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই কর্তৃক স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান এবং তার পর থেকে ফরাসি বিপ্লব ছিল ঘটনাবহুল। ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পতনের পর ফ্রান্সের প্রশাসন জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে পরিচালিত হতে থাকে। জাতীয় সম্মেলনে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল - জ্যাকোবিন ও জিরন্ডিস্ট। জাতীয় সম্মেলনে জিরন্ডিস্টদের সংখ্যাধিক্য ছিল ও প্রদেশগুলিতে তাদেরই প্রভাব ছিল। কিন্তু তা স্বত্তেও জিরন্ডিস্টরা ছিল দুর্বল। যাইহোক , জ্যাকোবিনরা রাজার প্রাণদন্ডের পক্ষপাতি ছিলেন কিন্তু জিরন্ডিস্টরা রাজার প্রাণদন্ডের বিষয়টি গণভোটের উপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। 


ষোড়শ লুইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ :- 
ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের বিরুদ্ধে মূল কয়েকটি অভিযোগ হল - 
১. ফ্রান্স থেকে যেসকল রাজপন্থী অভিজাতগণ বিদেশে পলায়ন করেছিলেন , ষোড়শ লুই সেই সকল পলাতক রাজপন্থী অভিজাতদের সহায়তা করেছিলেন। 
২. তৃতীয় সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে জাতীয় সম্মেলন কর্তৃক যে সংবিধান রচিত হয় - ষোড়শ লুই সেই নতুন সংবিধান বাতিল করার চেষ্টা করেন। 
৩. ফরাসি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কারসাধনে ষোড়শ লুই সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিলেন এবং এই সুযোগের ফরাসি সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে অভিজাতরা তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর তীব্র অত্যাচার ও শোষণ চালিয়েছিল। 
৪. ষোড়শ লুই ইউরোপের অন্যান্য রাজশক্তিগুলির সাথে মিলিত হয়ে বিপ্লব ধ্বংস করার প্রচেষ্টা করছেন। 


ষোড়শ লুইয়ের বিচার :- 
জিরন্ডিস্ট দল রাজার প্রাণদন্ডের পক্ষপাতি ছিলেন না , তাঁরা বিষয়টিকে গণভোটের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু জ্যাকোবিনরা রাজার প্রাণদন্ডের পক্ষে প্রবলভাবে সওয়াল করেন। এরপর ন্যাশনাল কনভেনশন ষোড়শ লুইকে বৈদেশিক শক্তির সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁকে '' টেম্পল '' কারাগারে বন্দী করে। 

ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ড :- 
এরপর জাতীয় সম্মেলনে ষোড়শ লুইয়ের শাস্তি প্রসঙ্গে জ্যাকোবিন ও জিরন্ডিস্টদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। উগ্র বামপন্থী জ্যাকোবিনরা ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ডের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে অনড় ছিলেন। এরপর জাতীয় মহাসভায় প্রতিনিধিদের মধ্যে ভোটের ভিত্তিতে রাজার প্রাণদন্ডের বিষয়টি স্থির করা হয়। শেষ পর্যন্ত সামান্য কিছু ভোটের ব্যবধানে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে জানুয়ারী গিলোটিনের আঘাতে ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের শিরচ্ছেদ করা হয়। 

ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ডের প্রতিক্রিয়া :- 

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে জানুয়ারী ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ডের ঘটনা সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এক আতঙ্কময় পরিবেশের জন্ম দেয়। ইউরোপের রাজপন্থী রাষ্ট্রগুলিতে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। 

১. ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ডের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবপন্থীরা সমগ্র ইউরোপ জুড়ে সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করতে থাকে। ফলে ইউরোপের রাজপন্থী রাষ্ট্রগুলিতে ভীতির সঞ্চার হয়। 

২. ইউরোপের রাজতন্ত্রপ্রিয় রাষ্ট্রগুলি অনুভব করে যে অবিলম্বে ফ্রান্সের বিপ্লব ধ্বংস করতে না পারলে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। 

৩. এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ইউরোপের রাজপন্থী রাষ্ট্রগুলি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম রাষ্ট্রজোট গঠন করে ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। 

৪. ইংল্যান্ড , হল্যান্ড , অস্ট্রিয়া , প্রাশিয়া , সার্ডিনিয়া , স্পেন - ইত্যাদি রাজতন্ত্রপ্রিয় রাষ্ট্রগুলি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শক্তিজোট গঠন করে। 

৫. ফ্রান্স এই শক্তিজোটকে আক্রমণ করলে তারা শোচনীয়ভাবে শক্তিজোটের নিকট পরাজিত হয়। 

৬. বৈদেশিক ক্ষেত্রে শোচনীয় পরাজয়ের পর অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও ফ্রান্সকে চরম বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়। রাজতন্ত্রের সমর্থকরা প্রবলভাবে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির বিরোধিতা করতে থাকলে ফ্রান্সে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। 

এই অবস্থায় জ্যাকোবিন দলের নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেন বিপ্লব ও ফ্রান্সে সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্র রক্ষা করতে গেলে অবিলম্বে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সর্বত্র সন্ত্রাসের শাসন জারি করা প্রয়োজন। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে জ্যাকোবিন দলের নেতৃত্বে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয় - যা ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপের ইতিহাসে এক নক্কারজনক অধ্যায়।    


 

You May Also Like

0 comments