এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে ? এককেন্দ্রিক সরকারের বিভিন্ন বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।

by - February 12, 2022

এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে ? এককেন্দ্রিক সরকারের বিভিন্ন বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 

এককেন্দ্রিক সরকারের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট :- 

এককেন্দ্রিক সরকারের ধারণা ও বৈশিষ্ট :- 

Definition and features of Unitary Government.  ( In Bengali ) 



শাসন ক্ষমতা বন্টনের ভিত্তিতে সরকারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় ; যথা - এককেন্দ্রিক সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার। এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা হল এমন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা যেখানে সরকারের বা রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা কেবলমাত্র একটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এখানে স্বীকৃত নয়। এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় রাজ্য সরকারগুলির অস্তিত্ব থাকলেও তারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করে থাকে এবং তাদের অস্তিত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। মূলত তাদের ক্ষমতার উৎস হল কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে তাদের সমস্ত কার্যাবলী পরিচালিত হয়। অর্থাৎ , এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সংবিধানগতভাবে ক্ষমতা বন্টনের কোন ব্যবস্থা থাকে না , এখানে সমস্ত ক্ষমতা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। 


অধ্যাপক গার্ণারের মতে , এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবাস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতা বন্টনের কোন ব্যবস্থা থাকেনা। এককেন্দ্রিক সরকারে একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকারের প্রাধান্য বা স্বাতন্ত্র থাকে না। শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যাবলী পরিচালনার সুবিধার জন্য অঙ্গরাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আঞ্চলিক সরকার গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। 

এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা বর্তমান যেসকল রাষ্ট্রগুলিতে প্রচলিত সেগুলি হল গ্রেট ব্রিটেন , ফ্রান্স ,  নিউজিল্যান্ড , ইতালি , রিপাবলিক অফ চায়না , জাপান , বাংলাদেশ , স্পেন , পর্তুগাল - ইত্যাদি। 


১. কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য :- এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল ক্ষমতা কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বা একটিমাত্র সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। এখানে অঙ্গরাজ্যগুলিতে আঞ্চলিক সরকারের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। যদিও প্রশাসনিক পরিচালনার সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের প্রয়োজনমতো আঞ্চলিক সরকার গঠন করে , তবে এই সকল আঞ্চলিক সরকারগুলির নিজস্ব স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকেনা। তাদেরকে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগত হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। অর্থাৎ তারা সমগ্র দিক দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করে থাকে। সুতরাং এককেন্দ্রিক সরকারগুলিতে রাষ্ট্রের যাবতীয় দায়িত্ব , ক্ষমতা , নীতি এবং সরকার পরিচালনার সর্বোচ্চ ক্ষমতা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। 

২. কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য :- এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনসভার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে এখানে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য থাকে। আইন প্রণয়ন , আইন সংশোধন - ইত্যাদি ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যের আইনসভা গুলির কোন ক্ষমতায় থাকে না। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানের প্রাধান্যের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত থাকে। অধ্যাপক ডাইসি কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্যকে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 


৩. সাংবিধানিক বৈশিষ্ট :- এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সংবিধান লিখিত এবং অলিখিত উভয়ই হতে পারে। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো  বৈশিষ্ট্য বা নিয়ম পরিলক্ষিত হয় না। যেমন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন , ইতালি , নিউজিল্যান্ড - প্রভৃতি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে লিখিত সংবিধানের অস্তিত্ব দেখা যায়। কিন্তু অপরদিকে ইংল্যান্ডের সংবিধান অলিখিত। সুতরাং এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সংবিধান লিখিত না অলিখিত হবে - এ বিষয়ে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। 

৪. সংবিধান সুপরিবর্তনীয়  :- যে সকল রাষ্ট্রে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেই সকল রাষ্ট্রের সংবিধান সাধারণত সুপরিবর্তনীয় হয়। কেননা এই ধরনের রাষ্ট্রে যেহেতু সরকারের সকল ক্ষমতা একটিমাত্র সরকারের হাতে বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নিহিত থাকে সেহেতু আইনসভাতে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাধান্যের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করা হয়। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের  জন্য কোনো বিশেষ বা জটিল পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় না। এজন্য এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র লির সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি সুপরিবর্তনীয়। 

৫. সংবিধানের প্রাধান্যহীনতা :- এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য থাকে না। যেহেতু এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় কেবলমাত্র একটি সরকারের বা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত থাকে সেহেতু কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিরোধের কোনো সম্ভাবনা থাকেনা। কেননা এখানে রাজ্য সরকারগুলি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন হয়ে থাকে। অঙ্গরাজ্যগুলির সরকারের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়। তাই এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধের কোন সম্ভাবনা নেই। সংবিধানের প্রাধান্য তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার গুলিতে সাংবিধানিক ক্ষমতা বন্টিত থাকে। কিন্তু যেহেতু এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বন্টিত থাকে না , সমস্ত ক্ষমতা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে -  সেহেতু এখানে সংবিধান গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হয়। 

৬. সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি :- এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ বা জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। এখানে সহজ-সরল পদ্ধতির মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়ন করা হয়।  বেশিরভাগ যুক্তরাষ্ট্রগুলিতে যেমন সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইন সভার মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন হয় , সেখানে এককেন্দ্রিক আইনসভাগুলিতে সংবিধান সংশোধন ও আইন প্রবর্তনের জন্য শুধুমাত্র সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয়। 


৭. বিচার বিভাগের প্রাধান্যহীনতা :- এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা এবং রক্ষাকর্তা হিসেবে বিচার বিভাগের কোনো ভূমিকা থাকে না। কেননা ,এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আদালতের তুলনায় বিচার বিভাগের ক্ষমতা এবং গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে এই সকল রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কার্যত শাসন বিভাগের বশ্যতা স্বীকার করে কার্য পরিচালনা করে থাকে। 

৮. সার্বভৌম শাসন ও আইন বিভাগ :- এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে যেহেতু সরকারের সকল ক্ষমতা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে সেহেতু সার্বভৌমিকতার প্রশ্নে এককেন্দ্রিক সরকারগুলি সম্পূর্ণ সার্বভৌম। তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকেনা। কোনো আঞ্চলিক সংস্থা , আঞ্চলিক সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান এককেন্দ্রিক সরকারগুলিতে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উল্লেখ করা যেতে পারে। ইংল্যান্ডের  পার্লামেন্ট আইনগত দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে সার্বভৌম। 

৯. সরকারের প্রকৃতি :- এককেন্দ্রিক সরকারগুলি রাষ্ট্রপতি শাসিত ও সংসদীয় বা মন্ত্রিসভা পরিচালিত - উভয়ই হতে পারে। এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট বাঁধাধরা নিয়ম নেই। যেমন ফ্রান্সের সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত কিন্তু অপরপক্ষে ইংল্যান্ডের সরকার মন্ত্রিসভা পরিচালিত। 

১০. এক নাগরিকত্বের স্বীকৃতি :- এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সাধারণত এক নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখানে অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য পৃথক কোনো নাগরিকত্বের স্বীকৃতির ব্যবস্থা থাকে না। যেমন গ্রেট ব্রিটেন , ফ্রান্স , নিউজিল্যান্ড - ইত্যাদি দেশে আঞ্চলিক সরকারের অধীনস্থ অধিবাসীদের জন্য আলাদা করে কোনো নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই।  কিন্তু এ বিষয়ে অবশ্যই ভারতের শাসন ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও ভারতে এক নাগরিকত্ব স্বীকৃত। কিন্তু সাধারণত এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে এক নাগরিকত্ব স্বীকৃত থাকে। 

১১. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি :- এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। তাই এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কোনো সম্ভাবনা থাকেনা। যদিও অঙ্গরাজ্যগুলিতে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ; কিন্তু সেই সকল প্রাদেশিক সরকারগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী এবং তাদের নির্দেশিত দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্য নিয়েই। সুতরাং এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারগুলিকে ততটুকুই ক্ষমতা প্রদান করে থাকে যতটুকু ক্ষমতা তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানে অঙ্গরাজ্যগুলি কোনো ভাবেই সার্বভৌম ক্ষমতার দাবিদার নয়। 

এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে ? এককেন্দ্রিক সরকারের বিভিন্ন বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 



You May Also Like

0 comments