এককেন্দ্রিক সরকারের দোষ - গুণ বা সুবিধা - অসুবিধা সম্পর্কে আলোচনা কর।

by - February 15, 2022

এককেন্দ্রিক সরকারের দোষ - গুণ বা সুবিধা - অসুবিধা সম্পর্কে আলোচনা কর। 

Merits and Demerits of the Unitary Government. ( In Bengali ) 




এককেন্দ্রিক সরকারের গুণ বা সুবিধা :- 


১. প্রশাসনিক জটিলতার সম্ভবনা কম :- যেহেতু এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একটিমাত্র সরকারের হাতে ন্যাস্ত থাকে সেহেতু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সমগ্র দেশে একই ধরণের আইন ও শাসন সহজেই বলবৎ করা সম্ভব হয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে তাই জটিলতা তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

২. অঙ্গরাজ্যগুলিতে বৈষম্যের অনুপস্থিতি :- এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত ক্ষমতা ন্যাস্ত থাকায় সমগ্র দেশে একই ধরণের নীতি প্রয়োগ করা হয়। ফলে অঙ্গরাজ্যগুলির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বৈষম্যের কোনো অভিযোগ উপস্থাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। 


৩. জাতীয় সংহতির সহায়ক :- এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় সারা দেশে একই ধরণের আইন ও শাসন ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। নাগরিকদের আনুগত্য থাকে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি। সারা দেশে একই ধরণের নীতি প্রচলিত থাকার ফলে প্রাদেশিকতা , বিচ্ছিন্নতাবাদ - ইত্যাদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। তাই এককেন্দ্রিক সরকার জাতীয় ঐক্যের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

৪. ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে অধিক উপযুক্ত :- ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার তুলনায় এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা অধিক কার্যকরী ও উপযুক্ত। সাধারণতঃ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিতে জাতি - বর্ণ - ভাষা - সংস্কৃতি - ইত্যাদির বৈচিত্র খুব কম থাকে বৃহৎ রাষ্ট্রের তুলনায়। ফলে এই সকল রাষ্ট্রে এককেন্দ্রিক শাসন অধিক উপযুক্ত। 

৫. আইন প্রণয়নের সুবিধা :- এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবিধানের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রাধান্যলাভ করে। কেন্দ্রীয় আইনসভা নিজেদের ইচ্ছা ও প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করতে পারে। এখানে আইনের ব্যাখ্যা করা বা আইন বাতিল করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের থাকে না। তাই এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইন প্রণয়ন ও সংশোধন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি সহজ। 

৬. আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সুবিধা :- এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একটি মাত্র সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকায় আন্তর্জাতিক চুক্তি , সন্ধি ইত্যাদি সম্পাদনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুবিধা হয়। এ সকল চুক্তি সম্পাদন করতে অঙ্গরাজ্যগুলি থেকে কোনো বাধা প্রদান সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকার নিজস্ব প্রয়োজন , নীতি ও সুবিধা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে এবং চুক্তি,  সন্ধি ইত্যাদি সহজেই সম্পাদন করতে পারে। 


৭. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিধা :- অর্থনৈতিক বিভিন্ন পরিকল্পনা রূপায়ণের ক্ষেত্রেও এককেন্দ্রিক সরকার কার্যকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি এবং তা রূপায়ণ ,  অঙ্গরাজ্যের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং তা প্রণয়নের ক্ষমতা কেবলমাত্র একটি সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিরোধের সম্ভাবনা থাকেনা। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার যে নীতি গ্রহণ করে তা সহজেই প্রণয়ন করতে পারে। 

৮. বিচার বিভাগ কর্তৃক আইন ও শাসন বিভাগের কাজে বাধা প্রদান সম্ভব নয় :-  এককেন্দ্রিক সরকার গুলিতে বিচার বিভাগের কোনো প্রাধান্য থাকে না। ফলে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন , প্রশাসনিক দিক এবং নীতি প্রণয়ন এবং তার রূপায়নের ক্ষেত্রে এককেন্দ্রিক সরকারের কার্যাবলীতে বিচার বিভাগ কোনো প্রকার বাধা প্রদান করতে পারে না। ফলে নীতি গ্রহণ ও রুপায়ন অধিকতর দ্রুত এবং সহজ পদ্ধতিতে সংঘটিত হয়। 

৯. স্বল্প - ব্যয় :- অধ্যাপক গার্ণার এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের স্বল্প - ব্যয় সম্পন্ন হওয়ার কথা বলেছেন। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে একটি মাত্র সরকার সমগ্র দেশে শাসন পরিচালনা করে। ফলে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যায়ভার যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম হয়। 

১০. আপাতকালীন পরিস্থিতির পক্ষে সহায়ক :- রাষ্ট্রকে অনেক সময় যুদ্ধ , গণবিদ্রোহ , অর্থনৈতিক অচলাবস্থা , বিচ্ছিন্নতাবাদ , সন্ত্রাসবাদ - ইত্যাদি আপৎকালীন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই সকল পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের তুলনায় এককেন্দ্রিক সরকার অনেক বেশি কার্যকরী হয়। 

এককেন্দ্রিক সরকারের দোষ বা অসুবিধাসমূহ :- 


১. এককেন্দ্রিক সরকারের সমস্ত ক্ষমতা একটিমাত্র সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকায় শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা থাকে ; আঞ্চলিক সরকারগুলির কোনো গুরুত্ব থাকেনা। আঞ্চলিক সরকারগুলি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়। এই ব্যবস্থা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের পক্ষে উপযুক্ত নয়। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলিতে স্থানীয় সমস্যাগুলির পরিবর্তে বৃহৎ জাতীয় সমস্যাগুলি প্রাধান্য পায়। ফলে স্থানীয় সমস্যা ও প্রয়োজনগুলি সর্বদা উপেক্ষিত থাকে। 

২. এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে ন্যস্ত থাকে এবং এক্ষেত্রে একমাত্র কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা থাকে। কিন্তু একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক - ইত্যাদি বিভিন্ন দিক দিয়ে বৈচিত্র ও বিভিন্নতা থাকে।  এই বৈচিত্রময় পরিমন্ডলে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয়ভাবে আইন প্রণয়ন করলে তা সমগ্র দেশের পক্ষে কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা কম। 


৩. আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বা সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।  কোন কারণে যদি এককেন্দ্রিক সরকার সেই সংকট প্রতিহত করতে না পারে বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে বিশেষ সমস্যামূলক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সুতরাং আপদকালীন পরিস্থিতির পক্ষে এককেন্দ্রিক সরকার কার্যকর - তা কিন্তু নয়। 

৪. এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আঞ্চলিক বিভিন্ন দাবি-দাওয়া , আঞ্চলিক সমস্যাগুলির প্রতি নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে বা প্রদেশগুলোতে আঞ্চলিকতাবাদ , প্রাদেশিকতা , বিচ্ছিন্নতাবাদ -  ইত্যাদি প্রাধান্য অর্জন করে। এর সাথে সাথে যুক্ত হয় কেন্দ্র বিরোধী মনোভাব। 

৫. বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে এককেন্দ্রিক সরকার কোনভাবেই উপযুক্ত নয়। একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ কোনটিই সঠিক নৈপুণ্যের সাথে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সেজন্য এককেন্দ্রিক সরকার বৃহদায়তন রাষ্ট্রের কখনো কার্যকরী হয় না। 

৬. অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এককেন্দ্রিক সরকার কাম্য নয়। কেননা একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যা থাকতে পারে। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রের সকল অংশের সমস্ত রকম অর্থনৈতিক সুবিধা - অসুবিধার কথা বিচার-বিবেচনা করে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না। ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 


৭. এককেন্দ্রিক সরকার যেহেতু নমনীয় হয় সেহেতু এককেন্দ্রিক সরকারে অধিষ্ঠিত শাসক দল নিজেদের সুবিধামতো ও নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। এর ফলে স্বৈরাচার ও দলীয় স্বেচ্ছাচার বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে এবং রাষ্ট্র একনায়কতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয়। 

৮. এককেন্দ্রিক সরকার কখনোই রাজনৈতিক চেতনা এবং কার্যকলাপে জনসাধারণকে উৎসাহ প্রদান করতে পারে না। একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক জীবন সীমাবদ্ধ। সেখানে জনসাধারণের অংশগ্রহণ কম। ফলে জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনা এবং প্রশাসনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে জনসাধারণের অংশগ্রহণের বিশেষ ঘাটতি দেখা যায়। 

৯. এককেন্দ্রিক সরকারগুলি সম্পূর্ণভাবে আমলানির্ভর হয়। এর ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ,  দীর্ঘসূত্রিতা - ইত্যাদি প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে এবং তার সাথে সাথে আমলাদের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকলে শাসনব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক হয়ে ওঠে এবং জনসাধারণের অভাব-অভিযোগ স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে তার সমাধান ঘটতে পারে না। 

১০. এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই অগণতান্ত্রিক - এমন অভিযোগ করা হয়। কেননা , এখানে শাসন ক্ষমতার একমাত্র উৎস হল কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার নিজের ইচ্ছা ও স্বার্থ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। আঞ্চলিক সরকার বা অন্যান্য দলগুলির কোন স্বাধীন সত্তা বা অস্তিত্ব থাকে না। এখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয় ও প্রশাসনে সাধারণের অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। ফলে এককেন্দ্রিক সরকারকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যায় না।  

    

You May Also Like

0 comments