ফরাসি বিপ্লবের অনিবার্যতা বিচার। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ফ্রান্সেই কেন প্রথম রাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লব সংগঠিত হয় ?

by - February 06, 2022

ফরাসি বিপ্লবের অনিবার্যতা বিচার।  

ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ফ্রান্সেই কেন প্রথম রাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লব সংগঠিত হয় ? 

ফরাসি বিপ্লব কি অনিবার্য ছিল ? 

Whether the French Revolution was inevitable ? ( In Bengali ) 

Why was the first anti-monarchy revolution held in France ? ( In Bengali ) 





১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব অপরাপর ইউরোপীয় রাষ্ট্র ও সারা বিশ্বের নিকট রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকেই সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরী হয়। তৎকালীন ফ্রান্সের প্রচলিত মধ্যযুগীয় , অচল , পরিবর্তনহীন সমাজ ব্যবস্থায় সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পটভূমি রচিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ফিশার - এর মত অনুসারে ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের দোষ ত্রুটিগুলি দূর করতে রাজতন্ত্র চরমভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ফিশারের ধারণা সম্পর্ণরূপে সঠিক নয় ; কেননা , পরিস্থিতি এমন গতিপ্রাপ্ত হয়েছিল যে রাজতন্ত্র সমস্ত ত্রুটিগুলি দূর করলেও বিপ্লব অনিবার্য ছিল। ঐতিহাসিক স্টিফেনস মনে করেন দার্শনিকদের ভূমিকা ফরাসি বিপ্লব অনিবার্য করে তোলে। ঐতিহাসিক Hearnshaw এর মত অনুসারে , ফরাসি বিপ্লবের সংগঠনে রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সামাজিক কারণ অপেক্ষা অনেক বেশি দায়ী ছিল মুষ্টিমেয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগণ দার্শনিকদের রচনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শাসন ক্ষমতা হস্তগত করার  আকাঙ্খা। এই কারণেই ফ্রান্সেই সর্বপ্রথম রাজতন্ত্রবিরোধী বিরোধী বিপ্লব সংগঠিত হয়। 


প্রথমতঃ ফ্রান্সের তৎকালীন শ্রেণীকে দুটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে - একটি হল ক্ষমতাভোগী শ্রেণী এবং অপরটি হল কার্যকরী শ্রেণী। এই কার্যকরী শ্রেণী হলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সকল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা শিক্ষা , সংস্কৃতি , অর্থনীতি , রাজনৈতিক চেতনা - ইত্যাদি সকল দিক দিয়েই যাজক ও অভিজাতদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা মর্যাদা ও ক্ষমতা লাভের আকাঙ্খা নিয়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে বহুদিন ধরে ক্ষমতা দখল করে থাকা যাজক ও অভিজাতদের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণীর ক্ষমতা প্রাপ্তির আকাঙ্খা ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলে। 

দ্বিতীয়তঃ ফ্রান্সে রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র ছিল পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাই রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা শাসনযন্ত্র সর্বদা অভিজাতদের স্বার্থে পরিচালিত হত। এই দুই শ্রেণীর সম্মিলিত স্বার্থের প্রভাবে তৃতীয় শ্রেণীর স্বার্থ বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছিল। রাজতন্ত্রের পক্ষে অভিজাতদের স্বার্থ উপেক্ষা করে তৃতীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুরক্ষিত করা সম্ভব ছিল না। তাই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নিজেদের রাজনৈতিক ,  সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদে অভিজাত ও রাজতন্ত্রের বিরোধিতা শুরু করে।


তৃতীয়তঃ ফরাসি শাসনযন্ত্র দীর্ঘকাল যাবৎ সংস্কারবিহীন অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছিল। ফ্রান্সের কৃষক ও সাধারণ মানুষের সমস্যা ছিল বহুবিধ এবং তাঁদের এই সমস্যাগুলি সম্পর্কে শাসন ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। ফলে একদিকে গ্রামীণ ক্ষেত্রে কৃষক শ্রেণীর অসন্তোষ এবং অন্যদিকে শহরে শ্রমিক ও মধ্যবিত্তদের অসন্তোষ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের জন্ম দেয়। 

চতুর্থতঃ সামন্ত শ্রেণী ও রাজতন্ত্রের স্বার্থ ছিল পরস্পর অভিন্ন। রাজা ছিলেন সামন্ততান্ত্রিক পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তর। তাই রাজার পক্ষে সামন্ত শ্রেণীর বিশেষ অধিকারগুলি ক্ষুন্ন করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব ছিল না। ফলে সামন্ত শ্রেণীর বিশেষ অধিকার লোপ করা হলেই বিপ্লব এড়ানো যেত - এ ধারণা সঠিক নয়। কেননা , রাজার নিজের স্বার্থের জন্য রাজাকে সামন্তদের স্বার্থ রক্ষা করতে হত। তাই বিপ্লব ছিল অনিবার্য। 

পঞ্চমতঃ যেহেতু সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক ছিল তাই গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষকদের ক্ষোভ রাজতন্ত্রের উপর পর্যবসিত হয়। কাজেই শুধুমাত্র সামন্তদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সম্ভব ছিল না। কৃষক , শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রাজতন্ত্র প্রশমিত করতে না পারার কারণে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব ছিল অনিবার্য। 

ষষ্ঠতঃ ফরাসি শাসনতন্ত্র ছিল জীর্ণ ও পুরাতনপন্থী। তাই ক্ষয় ধরা , সংস্কারবিহীন শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না করে প্রগতিশীল সংস্কার সাধন ছিল অসম্ভব। তাই বিপ্লবের দ্বারা পুরাতনতন্ত্রের পতন অনিবার্য ছিল। 

সপ্তমতঃ ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় ফ্রান্সের কৃষকেরা ছিল শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তাই তারা খুব সহজেই এবং অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের দুর্দশার কারণ হিসেবে সামন্ত ও রাজতন্ত্রের ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। করভারে জর্জরিত কৃষকদের নিকট রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। 

অষ্টমতঃ ফরাসি বিপ্লবে ফরাসি দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির তুলনায় ফ্রান্সের দার্শনিকগণ তাঁদের প্রগতিশীল ভাবধারা প্রকাশ করতে সক্ষম হন। তাঁরা তাঁদের তীব্র লেখনীর সাহায্যে ফরাসি সমাজে প্রচলিত অনাচার ও অব্যবস্থাগুলি সম্পর্কে ফরাসি জনসাধারণকে সচেতন করেন। ফলে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফ্রান্সেই প্রথম রাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লব সংগঠিত হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , তৎকালীন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে বিপ্লবকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিলনা। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেসকল উপাদানগুলি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলে - সেসকল উপাদানগুলি তৎকালীন ইউরোপে ফ্রান্স ব্যতীত অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রকাশ পায়নি। ঐতিহাসিক Mignet বলেছেন - " The Revolution was the inevitable outcome of a process by which the Third Estate had rises in wealth and intelligence.'' 

ঐতিহাসিক Ketelbey অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে তৎকালীন ফ্রান্সের দুর্বল ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র , দুর্নীতিগ্রস্থ গীর্জা ও যাজক সম্প্রদায় , অভিজাতদের কায়েমী স্বার্থ , শুন্য রাজকোষ , উৎপীড়িত কৃষকশ্রেণী , ক্ষমতাহীন ও অধিকারহীন তৃতীয় শ্রেণী , আর্থিক - প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা - ইত্যাদি একাধিক বিষয় ফ্রান্সকে অনিবার্যভাবে বিপ্লবের মুখে ঠেলে দেয়।     



You May Also Like

0 comments