সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত শাসন ব্যবস্থার সুবিধা - অসুবিধা।

by - February 22, 2022

সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত শাসন ব্যবস্থার সুবিধা - অসুবিধা। 

সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত সরকারের সুবিধা - অসুবিধা। 




সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত সরকারের সুবিধা :- 


১. আইন ও শাসন বিভাগের যৌথ সহযোগিতা ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক :- সংসদীয় সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। এইভাবে আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকার ফলে উভয় বিভাগের মধ্যে বিরোধের সম্ভাবনা হ্রাস পায় এবং শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার সম্ভাবনার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। নীতি প্রণয়ন ও তা রূপায়ণের ক্ষেত্রে শাসন ও আইন বিভাগের মধ্যে যৌথ সহযোগিতার পরিবেশ তৈরী হয়। 

২. নমনীয় ও স্থিতিস্থাপক :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকারি ব্যবস্থা নমনীয় ও স্থিতিস্থাপক। যেকোনো ধরণের জটিল অথবা জরুরি পরিস্তিতির ভিত্তিতে সরকারি নীতির যথাযথ পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে প্রশাসন বা সরকারের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তাই সংসদীয় সরকার নমনীয় ও স্থিতিস্থাপক। 


৩. আইনসভার নিকট দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভা :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা আইন সভার নিকট দায়িত্বশীল থাকে। অযোগ্য বা দুর্নীতিগ্রস্থ মন্ত্রিসভাকে আইনসভা তার সাংবিধানিক ক্ষমতার সাহায্যে অপসারিত করতে পারেন। এমনকি প্রয়োজনে আইনসভা ভেঙে দিয়ে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা যেতে পারে। ফলে , জনগণের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইন ও শাসন বিভাগ পরিচালিত হতে পারে। 

৪. শাসন বিভাগের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা রোধ :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ সরাসরি আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকে। এমনকি শাসন বিভাগের কার্যকালের অস্তিত্ব নির্ভর করে আইনসভার উপর। আইনসভা প্রয়োজনে শাসন বিভাগকে অপসারিত করতে পারে। তাই সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা হ্রাস পায়। 

৫. রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসার :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আইনসভা ও সরকারের কার্যাবলী , বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা , আইনসভা পরিচালনা , আইনসভায় বিভিন্ন প্রস্তাব আলোচনা - ইত্যাদি বিষয়গুলি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার বিস্তার ঘটে। 

৬. সরকার ও বিরোধী দলের পারস্পরিক সম্পর্ক :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক জনকল্যাণকর নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে। সরকার যেমন নীতি নির্ধারণ ও তা প্রণয়ন করে ; ঠিক তেমনি বিরোধী দল সরকারি কাজকর্মের বিরোধিতার মাধ্যমে সরকারকে জনকল্যাণকারী নীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য করে। 

৭. বিরোধী দলের মর্যাদা স্বীকার :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় শাসক ও বিরোধী দল উভয়েরই সাংবিধানিক মর্যাদা স্বীকৃত থাকে। বিরোধী দলনেতা একটি সাংবিধানিক পদ। এছাড়াও বিরোধী দল সরকারি নীতি ও কার্যাবলীর সমালোচনা করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। বিরোধী দলের এইরূপ সাংবিধানিক মর্যাদার ফলে শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অনুকূল হয়। 

৮. দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার পক্ষে সহায়ক :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন পরিচালনায় সহায়ক। সরকারের যেকোনো জনবিরোধী নীতি , কার্যকলাপ - ইত্যাদি বিরোধী দলের কাছে একটি সুযোগ এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী দল ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সরকার বিরোধী পরিবেশ গড়ে তোলে এমনকি সরকার  আহ্বান করে। ফলে সরকারকে সর্বদা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে হয়। 

সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত শাসন ব্যবস্থার অসুবিধা :- 


১. স্থায়িত্বহীনতা :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকার বা শাসন বিভাগ কোনো কারণে আইনসভার আস্থা হারালে বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সমর্থন প্রত্যাহার করলে সরকারের পতন ঘটে। সরকারকে সর্বদা স্থায়িত্তের জন্য আইনসভার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। ফলে সরকার তার যেকোনো নীতি ও পরিকল্পনা রূপায়ণের ক্ষেত্রে আইনসভার সম্মতির উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। 

২. জোট সরকারের ক্ষেত্রে অনুপযুক্ততা :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় অনেক সময় জোট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই জোট গঠিত হয় পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। কিন্তু জোট দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরী হলে এবং একটি দল সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে অতি সহজেই সরকারের পতন ঘটে। 


৩. সরকার দুর্নীতির উর্ধে নয় :- মন্ত্রিসভা পরিচালিত সরকার সর্বদা যে দুর্নীতিমুক্ত শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত করতে পারে - এমনটা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বার্থের তুলনায় ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কোনো দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলে আইনসভাতেও তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সরকার বিরোধী যেকোনো ধরণের অভিযোগ শুরুতেই বিনাশ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। 

৪. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি অনুপস্থিত থাকে। কোনো দল বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলে আইনসভার উপর সহজেই শাসন বিভাগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে , ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

৫. জনমতের বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা :- অনেকসময় মন্ত্রীরা আইনসভাতে যথার্থ তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা উপস্থাপন করেন না। তারা দলীয় স্বার্থ , ব্যক্তিগত স্বার্থ - ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিয়ে যে বক্তব্য পেশ করেন তা জনমতকে বিভ্রান্ত করে। এমনকি সরকার নিজের স্বার্থের জন্য গণমাধ্যমগুলির উপরেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। 

৬. আইনসভার উপর আধিপত্য :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় একটি দল যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে তখন সেই দলের প্রতিটি সদস্য দলীয় আনুগত্যের কাছে নতি স্বীকার করে শাসন বিভাগের সমস্ত নীতি ও পরিকল্পনাতে নীরবে সমর্থন করতে বাধ্য হয়। এইভাবে শাসক দল আইনসভাতেও তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। 


৭. সাংবিধানিক শাসক প্রধান প্রকৃত শাসক নন :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান প্রকৃত প্রধান নন। এই জাতীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রকৃত শাসক হলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু যদি নিয়মতান্ত্রিক ও প্রকৃত শাসকের মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। 

৮. আমলাতান্ত্রিক প্রভাব :- অনেক সময় সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতে যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন - তা মন্ত্রীদের থাকেনা না। ফলে শাসন বিভাগকে আমলানির্ভর হতে হয়। এই আমলাতান্ত্রিকতা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকারক ফল প্রদান করে। 

৯. জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয় :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা জরুরি ও সংকটকালীন পরিস্থিতির পক্ষে উপযুক্ত নয়। কেননা এই ধরণের শাসন ব্যবস্থায় আলোচনা , তর্ক - বিতর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এর ফলে যেকোনো ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রূপায়ণে বিলম্ব ঘটে। 

১০. অযোগ্যদের শাসন :- সংসদীয় শাসনতন্ত্রে যেকোনো অযোগ্য ব্যক্তি দলীয় আনুগত্যের সুযোগ নিয়ে আইনসভার সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান। আইন সভাতে অযোগ্য ব্যক্তিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সেই সরকার অযোগ্যদের সরকারে পরিণত হয়। 

                  

You May Also Like

0 comments