রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সুবিধা ও অসুবিধা।

by - February 21, 2022

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সুবিধা ও অসুবিধা। 

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের দোষ - গুন। 

Merit and Demerits of Presidential government. ( In Bengali ) 




 

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সুবিধা বা গুণাগুণ :- 


১. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সুবিধা হল রাষ্ট্রপতির কার্যকালের স্থায়িত্ব।  রাষ্ট্রপতির কার্যকাল আইনসভার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা সম্মতির ওপর নির্ভর করে না। তাই রাষ্ট্রপতি নিজ  অধিকার , বিবেচনা ও কর্মসূচী অনুযায়ী সরকার পরিচালনা করতে পারেন। আইনসভা এখানে প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি একটি নির্দিষ্ট সময় কালের জন্য নির্বাচিত হন। যদিও তাকে অপসারণ করা যায়। তবে সেই অপসারণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল হওয়ায় বিশেষ কিছু অভিযোগ ব্যতীত রাষ্ট্রপতির কার্যকালের আগে তাকে কোনভাবেই পদচ্যুত করা যায় না। 

২. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় দল বা আইনসভার দাসে পরিণত হওয়ার পরিবর্তে নিজের স্বাধীন কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারগুলিতে শাসন বিভাগের উপর আইনসভা ও দলীয় প্রাধান্য স্বীকৃত নয়। রাষ্ট্রপতিই দলকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ সুবিধা বন্টন , নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন , উচ্চ পদে নিয়োগ ও পদচ্যুতি - ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি দলের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। 


৩. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রধানের ভূমিকা পালন করে থাকেন। ফলে যে কোন জরুরীভিত্তিক পরিস্থিতিতে বা সংকটকালীন পরিস্থিতিতে তাকে মন্ত্রিসভা আইনসভার উপর নির্ভরশীল হতে হয় না। তিনি নিজেই নিজের স্বাধীন বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।  রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন , সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা কার্যকর করতে পারেন। এই সমস্ত কাজে তাকে মন্ত্রিসভা , ক্যাবিনেট বা আইনসভার ওপর নির্ভরশীল হতে হয় না। 

৪. যেহেতু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারগুলিতে মন্ত্রিসভা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির অনুগত কর্মচারী - তাই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারগুলিতে মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির কাজে কোনভাবেই বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না। মন্ত্রীগণ তাঁদের দক্ষতা ও রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির ভিত্তিতে নিজ নিজ পদে বহাল থাকেন। 

৫. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের রাষ্ট্রপতিকে প্রত্যক্ষভাবে জনগণের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। তাই জন বিরোধী কোন নীতি প্রণয়ন থেকে রাষ্ট্রপতি বিরত থাকেন। অন্যদিকে মন্ত্রীরাও রাষ্ট্রপতির কাজের যৌথভাবে আইনসভার নিকট এবং পরোক্ষভাবে জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকেন। এইভাবে একদিকে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাচার বন্ধ হয় এবং অন্যদিকে জনমতের চাপে শাসন বিভাগের সর্তকতা ও  উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। 

৬. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা , দলের সমর্থন - ইত্যাদির কোনো ভিত্তি নেই। ফলে রাষ্ট্রপতিকে কখনোই দলীয় সমর্থন লাভের জন্য উদগ্রীব বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হয় না। ফলে রাষ্ট্রপতি এখানে স্বাধীনভাবে ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ না করেই শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন। দল কোনভাবেই এখানে শাসনতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা রাষ্ট্রপতি কোন রকম দলীয় দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করেন না। 


৭. বহুদলীয় রাষ্ট্রের পক্ষে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বিশেষভাবে কার্যকরী। কেননা বহুদলীয় রাষ্ট্রগুলিতে অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকার জন্য আইন সভায় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোন একটি দলের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনসভা ত্রিশঙ্কু হতে দেখা যায়। তখন জোটের পরিস্থিতি তৈরী হয় এবং সেই জোট তৈরি হয় পারস্পরিক স্বার্থ ,  লেনদেন এবং কর্মসূচির ভিত্তিতে। এর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসন এই সমস্ত জোটের ঊর্ধ্বে উঠে সহজেই  প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে রাষ্ট্রপতি পদ কোনভাবেই দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল নয়। তাই বহুদলীয় রাষ্ট্রগুলিতে রাষ্ট্রপতি শাসন একান্ত ভাবে কাম্য। 

৮. রাষ্ট্রপতি শাসিত রাষ্ট্রগুলিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি থাকায় সরকারের তিনটি বিভাগ - শাসন , আইন ও বিচার বিভাগ - কেউ কারো কাজে পরস্পর হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। ফলে তিনটি বিভাগ স্বাধীনভাবে এবং নিরপেক্ষ ভাবে তাদের কার্য সম্পাদন করতে পারেন এবং আইনসভা স্বাধীনভাবে শাসন বিভাগের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি তুলে ধরে শাসন বিভাগকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। 

৯. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থাগুলিতে মন্ত্রীগণ সরাসরি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সেই সকল ব্যক্তিদেরকেই মন্ত্রীপদ প্রদান করে থাকেন যাদেরকে তিনি যথেষ্ট যোগ্য বলে মনে করেন।  অপরদিকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা , প্রাপ্ত ভোট এবং দলীয় প্রভাবের দ্বারাই কোনো একজন ব্যক্তি মন্ত্রী হন। সেই মন্ত্রীপদে তার যোগ্যতা কতটা - তা কেউ যাচাই করে দেখেনা। তাই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার যে সকল মন্ত্রীরা নিযুক্ত হন তারা অনেক বেশি উৎকর্ষতা ও দক্ষতার সঙ্গে কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। 

১০. অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ , বিভিন্ন বিষয়ে পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণ - ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারগুলি অধিক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে সংসদীয় রাষ্ট্রগুলিতে আলাপ-আলোচনা এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বহু সময় ব্যতীত হয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্রপতিশাসিত রাষ্ট্রগুলিতে রাষ্ট্রপতির হাতে যেহেতু শাসন বিভাগের সর্বময় কর্তৃত্ব থাকে সেহেতু রাষ্ট্রপতি এককভাবে শাসন বিভাগীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। 

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ত্রুটি বা অসুবিধা :- 


১. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হন। সেহেতু তার পক্ষে খুব সহজেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যায়। যেহেতু রাষ্ট্রপতির উপর আইনসভার নিয়ন্ত্রণ থাকেনা , তাই তিনি স্বাধীনভাবে তার কর্ম পরিচালনা করতে পারেন এবং তার অপসারণ পদ্ধতি যেহেতু জটিল তাই তাকে পদচ্যুত করা খুব জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি পক্ষে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সবরকম সম্ভাবনা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারগুলিতে বর্তমান। 

২. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে রাষ্ট্রপতি আইনসভার কাছে প্রত্যক্ষভাবে দায়িত্বশীল নন। আইনসভাতে  কোনো বিষয়ে জবাবদিহি করতে তিনি বাধ্য নন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি একমাত্র নির্বাচকমণ্ডলী বা জনগণের কাছে সরাসরি দায়িত্বশীল থাকেন। তাই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারকে অনেকে দায়িত্বহীন সরকার বলেও উল্লেখ করে থাকেন। 


৩. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারগুলিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকৃত থাকে। ফলে আইন , শাসন ও বিচার বিভাগ কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করেন না ঠিকই কিন্তু এই তিনটি বিভাগের কার্যাবলী সম্পাদনের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে , জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং উভয় বিভাগের মধ্যে যদি সমন্বয় সাধন না থাকে তাহলে শাসন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ও তিনটি বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা রকম জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। 

৪. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে জনমতের যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। মন্ত্রিসভা পরিচালিত শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীগণকে জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছা , আশা-আকাঙ্ক্ষা - ইত্যাদির সাথে সরাসরি সম্পর্ক রেখে চলতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে এমনটা হয় না। রাষ্ট্রপতি বিভিন্নভাবে তার বক্তব্য প্রচারের মধ্যে দিয়ে নিজ অবস্থান তুলে ধরতে পারেন ; কিন্তু জনসাধারণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ তার পক্ষে সম্ভব নয়। 

৫. অনেক সময় রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের নিয়োগ , উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ - ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ , দুর্নীতি , পরিচিতদের নিয়োগ ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। ফলে যথার্থ যোগ্য ব্যক্তি সেখানে স্থান পায় না। এরূপ অবস্থায় শাসনব্যবস্থার উৎকর্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি যদি তার প্রতি আনুগত্য এবং নিজের রাজনৈতিক স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন - তাহলে সেই শাসন ব্যবস্থা উৎকৃষ্টমান লাভ করতে পারে না। 

৬. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারগুলিতে বিচার বিভাগ অত্যধিক প্রাধান্য লাভ করে থাকে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির স্বীকৃতি সত্বেও বিভিন্ন বিভাগের কাজ কর্মের বৈধতা বিচার করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের থাকে। সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আইন ও শাসন বিভাগের উপর বিচার বিভাগ তার প্রাধান্য বিস্তার বা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। 

৭. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার গুলিতে সরকারের সাফল্য নির্ভর করে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত যোগ্যতা-দক্ষতা ,  নির্ভরশীলতা - ইত্যাদির উপর। কিন্তু কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি যদি যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করতে না পারেন তাহলে রাষ্ট্র ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। আবার নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ব্যতীত রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুতও করা যায়না। ফলে শাসন বিভাগ ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। 


You May Also Like

0 comments