প্রাণায়ামের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করো।

by - February 25, 2022

প্রাণায়ামের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করো।  

Discuss the different types of Pranayama . ( In Bengali ) 



প্রাণায়ামের প্রকারভেদ :- 

১. ভস্ত্রিকা প্রাণায়াম :-  ( Bhastrika Pranayama ) 

কোনো ধ্যানাত্মক আসনে সুবিধা অনুযায়ী বসে দুই নাক দিয়ে শ্বাসকে পুরো ভিতরে ডায়াফ্রাম পর্যন্ত ভরা এবং বাইরেও পুরো শক্তির সঙ্গে শ্বাস ছাড়াকে ভস্ত্রিকা প্রাণায়াম বলে। এই প্রাণায়াম নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তিন প্রকারের করা যেতে পারে। যথা - মৃদু গতিতে , মধ্যম গতিতে এবং তীব্র গতিতে। যেসকল ব্যক্তির ফুসফুস এবং হৃদপিন্ড দুর্বল , তাদের মৃদু গতিতে রেচক এবং পূরক করে এই প্রাণায়াম করা উচিত। সুস্থ ব্যক্তি এবং পুরোনো অভ্যাসকারীদের ধীরে ধীরে শ্বাস - প্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে মধ্যম এবং তারপর তীব্র গতিতে ভস্ত্রিকা প্রাণায়াম করা উচিত। এই প্রাণায়াম ৩-৫ মিনিট পর্যন্ত করা উচিত। 

এই প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) সর্দি - কাশি ,  অ্যালার্জি , শ্বাস রোগ , হাঁপানি , সাইনাস - ইত্যাদি সমস্ত প্রকারের কফ ঘটিত রোগ দূর হয়। 
(খ ) ফুসফুস শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং শুদ্ধ বায়ু দ্বারা বায়ু প্রাপ্তির ফলে হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্কের আরোগ্যলাভ হয়। 
(গ ) থাইরয়েড , টনসিল - ইত্যাদি গলার রোগ দূর হয়। 
(ঘ ) রক্ত পরিশুদ্ধ হয় এবং শরীরের বিষাক্ত , বিজাতীয় দ্রব্য শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। 
(ঙ ) প্রাণ ও মন স্থির হয়। 


২. কপালভাতি প্রাণায়াম :- ( Kapalvati Pranayama ) 

কপালভাতি প্রাণায়াম করার সময় মনে এমন বিচার আনা উচিত যে , আমরা যেই মুহূর্তে শ্বাস বাইরে ছাড়ছি , সেই মুহূর্তে নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরের সমস্ত রোগ বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রোগ , বিকার , কাম , ক্রোধ , লোভ , মোহ , ঈর্ষা , রাগ , দ্বেষ - ইত্যাদি বের করে দেওয়ার ভাবনা ভাবতে ভাবতে রেচক করা উচিত। সাধারণতঃ ৩-৫ মিনিট কপালভাতি প্রাণায়ামের অভ্যাস করা উচিত। শুরুতে ক্লান্তি , পেট ও কোমরে যন্ত্রণা অনুভূত হলেও , কিছুদিন পর এই যন্ত্রণা নিজে থেকেই দূর হয়ে যায়। 

কপালভাতি প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) মস্তিস্ক ও মুখমন্ডলে তেজ , আভা ও সৌন্দর্য বেড়ে ওঠে। 
(খ )  সর্দি - কাশি ,  অ্যালার্জি , শ্বাস রোগ , হাঁপানি , সাইনাস - ইত্যাদি সমস্ত প্রকারের কফ ঘটিত রোগ দূর হয়।   
(গ ) ফুসফুস , হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্কের সমস্ত রোগ দূর হয়। 
(ঘ ) মেদাধিক্য , কোষ্ঠকাঠিন্য , ডায়াবেটিস , অম্লপিত্ত , কিডনি ও প্রস্টেটের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত রোগ নিশ্চিতভাবে দূর হয়। 
(ঙ ) হৃদপিন্ডের শিরাগুলির অবরোধ বা ব্লকেজ খুলে যায়। 
(চ ) ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।  
(ছ ) আমাশয় , অগ্ন্যাশয় , যকৃৎ , প্লীহা , অন্ত্র - ইত্যাদির দুর্বলতা ও রোগ দূর করতে এই প্রাণায়াম বিশেষভাবে কার্যকরী। 


৩. বাহ্য প্রাণায়াম :-  ( Bahya Pranayama ) 

সিদ্ধাসন বা পদ্মাসনে বসে শ্বাসকে জোরপূর্বক বাইরে বের করে দিতে হবে। শ্বাস বাইরে ছেড়ে মুখবন্ধ ( পায়ুপ্রদেশ এবং মুত্রেন্দ্রিয়কে উপরের দিকে আকর্ষিত করতে হবে। এই বন্ধে নাভির নিচের অংশে টান পড়বে ) , উড্ডীয়ান বন্ধ ( পেটকে ভেতরের দিকে ঢোকানোর চেষ্টা করা ) এবং জালন্ধর বন্ধ ( হাত দুটিকে হাঁটুর উপরে রেখে থুতনিকে কিছুটা ঝুঁকিয়ে কণ্ঠকূপের সঙ্গে লাগানো ) - এই তিনের মাধ্যমে শ্বাসকে যথাসম্ভব বাইরে আটকে রাখতে হবে। যখন শ্বাস নেওয়ার ইচ্ছা হবে তখন বন্ধগুলিকে সরিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে হবে। 

এই প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) মনের চঞ্চলতা দূর হয়। 
(খ ) এই প্রাণায়াম পেটের রোগে বিশেষ লাভপ্রদ হয়। 
(গ ) বুদ্ধি সূক্ষ্ম ও তীব্র হয়ে ওঠে। 
(ঘ ) বীর্যকে উর্দ্ধগামী করে স্বপ্নদোষ , শীঘ্রপতন - ইত্যাদি বিকারের নিবৃত্তি করে। 
(ঙ ) পেটকে বিশ্রাম এবং আরোগ্য প্রদানের জন্য ত্রিবন্ধপূর্বক এই প্রাণায়াম করা উচিত। 

৪. অনুলোম - বিলোম প্রাণায়াম :-  ( Anuloma - Viloma Pranayama ) 

ডান হাতকে তুলে , ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা ডানদিকের নাসাছিদ্র এবং অনামিকা বা মধ্যমা আঙুল দ্বারা বাম দিকের নাসারন্ধ্র বন্ধ করা উচিত। প্রক্রিয়াটি অবশ্য বাম দিকের নাসিকা দ্বারা শুরু করা উচিত। বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা ডান নাক বন্ধ করে বাম দিকের নাসাছিদ্র দিয়ে শ্বাস নিতে হবে। পুরো শ্বাস নেওয়ার পর অনামিকা বা মধ্যমা দ্বারা বাম নাক বন্ধ করে ডান নাসাছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে দিতে হবে। তারপর একই প্রক্রিয়া অপর নাসাছিদ্রগুলি দিয়ে অর্থাৎ , ডান দিক দিয়ে শ্বাস নিয়ে বাম দিকের নাসাছিদ্র দিয়ে শ্বাস ছেড়ে দিতে হবে। ক্লান্তি আসলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার করা যেতে পারে। ৩-১০ মিনিট পর্যন্ত এই প্রাণায়াম করা যেতে পারে। 

অনুলোম - বিলোম প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) এই প্রাণায়াম দ্বারা বাহাত্তর কোটি বাহাত্তর লক্ষ দশ হাজার দুশো দশ নাড়ি পরিশুদ্ধ হয়। 
(খ ) সন্ধিবাত , আমবাত , গেঁটে বাত , স্নায়ু দুর্বলতা , মূত্ররোগ , ধাতুরোগ , অম্লপিত্ত , সর্দি জ্বর , হাঁপানি , কাশি , টনসিল , সাইনাস - ইত্যাদি বহুরোগ দূর হয়। 
(গ ) হৃদপিন্ডের শিরাগুলির অবরোধ বা ব্লকেজ খুলে যায়।    
(ঘ ) কোলেস্টোরল , ট্রাইগ্লিসারাইডস , HDL  বা  LDL - ইত্যাদি রোগের নিরাময় সম্ভব হয়। 

৫. ভ্রামরী প্রাণায়াম :-  ( Bhramari Pranayama ) 

শ্বাসকে পুরো ভিতরে পুরে দুই হাতের মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে নাকের মুলদেশে চোখের দুই পাশে একটু চেপে রাখতে হবে এবং অন্যান্য আঙুলগুলি নাকের দুইপাশে ত্বককে স্পর্শ করে থাকবে। দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে দুই কানকে পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। এবার ভ্রমরের মতো গুঞ্জন করতে করতে ওঁম শব্দের উচ্চারণ করে শ্বাসকে নাকের মধ্যে দিয়ে নবাইরে ছাড়তে হবে। এই সময় মুখ বন্ধ থাকবে। 

ভ্রামরী প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) মনের চঞ্চলতা দূর করা সম্ভব হয়। 
(খ ) মানসিক টেনশন , উত্তেজনা , উচ্চ রক্তচাপ , হৃদরোগ - ইত্যাদিতে এই প্রাণায়াম অত্যন্ত লাভকারী হয়। 
(গ ) এই ধ্যানের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী প্রাণায়াম। 



৬. নাড়ি শোধন প্রাণায়াম :-  ( Nadi Shoidhan Pranayama ) 

শুরুতে নাড়ি শোধন প্রাণায়ামের জন্য অনুলোম - বিলোমের মতো ডান নাককে বন্ধ করে বাম নাক দিয়ে পুরো শ্বাস নিতে হবে। পুরো শ্বাস নেওয়ার পর মুখবন্ধ এবং জালন্ধর বন্ধ করা উচিত। তারপর জালন্ধর বন্ধ সরিয়ে শ্বাসকে অত্যন্ত ধীর গতিতে ডান নাক দিয়ে বাইরে ছাড়তে হবে। পুরো শ্বাস ছেড়ে দেওয়ার পর ডান দিকের নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে অন্তঃকুম্ভক করে শ্বাসকে আটকে রেখে বাম দিকের নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাসকে বাইরে ছাড়তে হবে। শ্বাস নেওয়া বা ছাড়ার সময় প্রাণের কোনো শব্দ হওয়া উচিত নয়। এই প্রাণায়াম কমপক্ষে তিনবার করা উচিত। 

এই প্রাণায়ামের উপকারিতা অনুলোম - বিলোমের অনুরূপ। 

৭. চন্দ্রভেদী বা চন্দ্রাঙ্গ প্রাণায়াম :-  ( Chandra Bhedi Pranayama ) 

এই প্রাণায়ামে বাম নাক দিয়ে পূরক করে , তারপর অন্তঃকুম্ভক করতে হবে। এই প্রাণায়াম জালন্ধর এবং মূলবন্ধের সঙ্গে অভ্যাস করা উত্তম। তারপর ডান নাক দিয়ে রেচক করতে হবে। এই প্রাণায়ামে সর্বদা চন্দ্রস্বর বা বাম নাক দিয়ে পূরক এবং সূর্যস্বর বা ডান নাক দিয়ে রেচক করা হয়। 

এই প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) শরীরে শীতলতা এসে ক্লান্তি ও উষ্ণতা দূর হয়। 
(খ ) মানসিক উত্তেজনা শান্ত হয়। 
(গ ) পিত্তের কারণে উৎপন্ন জ্বলুনিতে এই প্রাণায়াম লাভদায়ক হয়। 

৮. উজ্জায়ী প্রাণায়াম :- ( Ujjayi Pranayama ) 

এই প্রাণায়ামে পূরক করতে করতে গলাকে সংকুচিত করতে হয় এবং যখন গলাকে সংকুচিত করে শ্বাস ভিতরে নেওয়া হয় , তখন গলা দিয়ে নাক ডাকার মতো আওয়াজ বেরোতে থাকে। তবে , বাতাসের ঘর্ষণ নাকে হওয়াটা উচিত নয় , গলায় ঘর্ষণ হলে একটি ধ্বনি উৎপন্ন হবে। শুরুতে কুম্ভকের প্রয়োগ না করে শুধুমাত্র পূরক - রেচকেই অভ্যাস করা উচিত। 

এই প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) সর্দি কাশি , টনসিল , থাইরয়েড , মানসিক টেনশন , রক্তচাপ , টি বি , আমবাত - ইত্যাদি রোগে এই প্রাণায়াম খুবই উপকারী। 
(খ ) গলাকে নীরোগ এবং মধুর করার জন্য এই প্রাণায়াম খুবই কার্যকরী। 
(গ ) তোতলামি দূর হয়। 

৯. শীতলী প্রাণায়াম :-  ( Sheetali Pranayama ) 

ধ্যানাত্মক আসনে বসে দুই হাতকে হাঁটুর উপরে রাখতে হবে। জিভকে নালির মতো সরু করে মুড়ে মুখ খোলা রেখে মুখ দিয়ে পূরক করতে হবে। জিভের মধ্যে দিয়ে শ্বাস নিয়ে ফুসফুস পূরণ করতে হবে। কয়েক মুহূর্ত থেমে মুখ বন্ধ করে দুই নাক দিয়ে রেচক করতে হবে। এইভাবে ৪-১০ বার অভ্যাস করতে হবে। 

এই প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) জিভ , মুখ ও গলার রোগে এই প্রাণায়াম কার্যকরী। 
(খ ) ক্ষুধা - তৃষ্ণার উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা যায়। 
(গ ) উচ্চ রক্তচাপ , পিত্ত রোগ ও রক্ত শোধনের ক্ষেত্রে এই প্রাণায়াম কার্যকরী। 

১০. শীৎকারী প্রাণায়াম :-  ( Sitkari Pranayama ) 

ধ্যানাত্মক আসনে বসে জিভকে উপরের দিকে তালুর সঙ্গে লাগিয়ে উপর আর নিচের পাটির দাঁতের সঙ্গে একদম সাঁটিয়ে ধরে ঠোঁটকে খুলে রাখতে হবে। এবার 'সী' 'সী' আওয়াজ করতে করতে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হবে। জালন্ধর বন্ধ করে যতটা সম্ভব এভাবে থেকে মুখ বন্ধ করে নাক দিয়ে ধীরে ধীরে রেচক করতে হবে। 

এই প্রাণায়ামের ফলে - 
(ক ) দন্তরোগ , গলা - মুখ - নাক - জিভ - ইত্যাদি রোগ নিরাময় সম্ভব হয়। 
(খ ) শরীর ঠান্ডা হয়। 
(গ ) ঘুম নিয়ন্ত্রিত হয়। 
(ঘ ) উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এই প্রাণায়ামে উপকার পাওয়া যায়।   


You May Also Like

0 comments