প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল আলোচনা কর।

by - January 08, 2022

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল আলোচনা কর। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব / গুরুত্ব আলোচনা কর। 

Discuss the outcome or importance or result of the First World War. ( In Bengali ) 




প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল : - 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ বললে খুব কম বলা হবে। যুদ্ধের ব্যাপকতা , বিভিন্ন রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ , মারণাস্ত্রের প্রয়োগ , আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার প্রভাব - ইত্যাদি সমস্ত কিছু বিচার করে তাকে যুদ্ধ অপেক্ষা কিছু বেশি বলা চলে। বস্তুতঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক চরিত্র বদলে যায়। এটি মূলতঃ ছিল একটি পরিবর্তনকারী বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলগুলি নিম্নরূপ :- 


১. প্রাণহানি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সংঘঠিত হওয়া যেকোনো যুদ্ধের তুলনায় এ যুদ্ধ অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটিয়েছিল। প্রায় ২৬ লক্ষ সেনা নিহত হন ও প্রায় ৭০ লক্ষ সেনা আহত হন। এছাড়া যুদ্ধের ফলে তৈরী হওয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্যও যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে প্রচুর মানুষ মারা যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতা এতটাই ছিল যে যুদ্ধ শেষের বহু বছর পরেও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে অস্থির পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। 

২. আর্থিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষ :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতেই কম - বেশি আর্থিক মন্দা দেখা দেয়। বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি দ্বারা জার্মানিকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা হয় যে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পরে। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। এইভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানবনির্মিত দুর্ভিক্ষের জন্ম হয়। 


৩. শক্তিসাম্যের ব্যাপক পরিবর্তন :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তিসাম্যের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। পূর্বতন আধিপত্যকারী শক্তিগুলির আধিপত্য বিনষ্ট হয়। জার্মানি , ফ্রান্স - ইত্যাদি রাষ্ট্রের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের পুনর্গঠন হয় ও অনেক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ফলে ইউরোপের মানচিত্রের ব্যাপক রদবদল ঘটে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাপান ও আমেরিকা আত্মপ্রকাশ করে। 

৪. জার্মানির উপর প্রভাব :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি জার্মানিকে এককভাবে যুদ্ধের জন্য দায়ী করে তার উপর বিরাট ক্ষতিপুরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। জার্মানির প্রতি প্রতিশোধাত্মক মনোভাব থেকে তার অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দেওয়া হয়। জার্মানির সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির ওপর বিজয়ী রাষ্ট্রবর্গের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। জার্মানির সমস্ত উপনিবেশ কেড়ে নিয়ে ও সামরিক শক্তি ধ্বংস করে দিয়ে তাকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। 

৫. জাতীয়তাবাদী নীতির প্রতিষ্ঠা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রগুলিকে নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়। যেমন রাশিয়া থেকে চারটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় - ফিনল্যান্ড , এস্টোনিয়া , ল্যাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া। পোল্যান্ডের পুনর্গঠন করা হয়। শ্লাভ অধ্যুষিত যুগোশ্লাভিয়া নতুন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। ফ্রান্সকে আলসেস ও লোরেন প্রত্যার্পণ করা হয়। ডেনমার্ককে স্লেজউইগ প্রত্যার্পণ করা হয়। এইভাবে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে বিভিন্ন জাতির জাতীয়তাবাদী আকাঙ্খা পূরণ করা হয়। 

৬. আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার :- যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রগুলি ব্যাপক ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে ইউরোপ ও বিশ্বরাজনীতিতে তাদের আধিপত্য বিনষ্ট হয়। এই শক্তিগুলির মধ্যে প্রধান ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। 


৭. রাশিয়ার উপর প্রভাব :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া যোগদান করে এবং পরাজিত হয়। ১৯০৫ এর পর থেকেই রাশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক জার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর সেই প্রতিবাদ তীব্র আকার ধারণ করে এবং ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ ৩০০ বছরের জার শাসনের অবসান ঘটে। এরপর রাশিয়াতে একটি বুর্জোয়া সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারপর সেই বুর্জোয়া শাসনের অবসান ঘটে ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। 

৮. শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে এবং তার পরবর্তীকালে ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের জন্ম হয় এবং শ্রমিক স্বার্থরক্ষায় শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। রাশিয়াতে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তা শ্রমিকদের অনুকূলে যায়। রাষ্ট্রীয় পরিচালকগণ শ্রমিক স্বার্থের অনুকূলে বিধি ব্যবস্থা প্রণয়নে বাধ্য হন। 

৯. নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তন :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীব্যাপী নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপের সর্বত্র নারীরা কর্মে স্বীকৃতি লাভ করেন , সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় , অফিস - কাছারি - শিল্প ও কৃষি উৎপাদন - ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহন স্বীকৃত হয় ও নারী স্বাধীনতার প্রসার ঘটে। 

১০. ভার্সাই চুক্তি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম :- ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানিকে যুদ্ধের জন্য এককভাবে দায়ী করে তাকে অর্থনৈতিক , সামরিক , সামাজিক - সমস্ত দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ভার্সাই চুক্তির প্রণেতাগণ তাদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে এই চুক্তির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার পটভূমিকা প্রস্তুত করেন। ফলে জার্মানির পক্ষে চুক্তির অপমানজনক শর্তগুলি দীর্ঘদিন ধরে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না এবং অচিরেই তাদের অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। 

পরিশেষে বলা যায় , ভার্সাই সন্ধি দ্বারা জার্মানির মত একটি বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রকে চিরকালের জন্য হীনবল করে রাখা সম্ভব ছিল না। জার্মানির জাতীয়তাবাদী মর্যাদা যেভাবে ক্ষুন্ন করা হয়েছিল তাতে জার্মানির মত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি নৈতিকতার দিক দিয়েও সমর্থনযোগ্য নয়। ফলে এই সন্ধির মধ্যেই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা নিহিত ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।  

      

You May Also Like

0 comments