Effect of globalization on indian society and economy . বিশ্বায়ন বলতে কী বোঝ ? ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা কর।

by - December 03, 2021

বিশ্বায়ন বলতে কী বোঝ ? ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা কর। 


বিশ্বায়ন (Globalization) : 


ভূমিকা :- 

এই প্রজন্মে বিশ্বায়ন একটি বিশ্ববীক্ষার নাম। মানুষের প্রবহমান জীবনের প্রতিটি খাঁজে নিহিত রয়েছে বিশ্বায়ন সত্তার ইঙ্গিত। প্রতিটি মানুষ এই শব্দের সাথে আজ পরিচিত। জীবন ও বিশ্বায়ন—সখ্যের এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে যেন আবদ্ধ। প্রত্যয়টির জন্ম ১৯৯০ সালে। বিশ্বায়ন হল পারস্পরিক ক্রিয়া এবং আন্তঃসংযােগ সৃষ্টিকারী এমন একটি পদ্ধতি যা বিভিন্ন জাতির সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের মধ্যে সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়ার সূচনা করে। এই পদ্ধতির চালিকাশক্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিয়ােগ আর এর প্রধান সহায়ক শক্তি হল তথ্য প্রযুক্তি। অর্থাৎ এটি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংস্থাগুলি বিশ্বজুড়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক গড়ে তােলে। 


বাণিজ্যকে বাধাহীনভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচালনা করার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালাই হলাে বিশ্বায়ন। যে কোনাে দেশের পণ্য যে কোনাে দেশে বাধাহীনভাবে প্রবেশ করতে পারবে এবং ক্রেতারা তাদের পছন্দমতাে কিনবেন, এতে কোনাে বাধা থাকবে না। এই প্রক্রিয়া হল বিশ্বের মানুষকে একসূত্রে গ্রথিত করে বিশ্বসমাজ বা একটি ‘ভুবনগ্রাম’ গড়ে তােলার প্রচেষ্টা।“Globalization। panoramically refers to the extension and expansion of global linkages, the organization and institution of social living on a global parameter and the growth of global consciousness and hence to the consolidation of world society.” এ এক ভাবনা, যেখানে রয়েছে পৃথিবীকে একটা ছােট্ট গ্রামে পরিণত করার বাসনা, দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার মহান ঘােষণা।


বিশ্বায়নের অন্তর্নিহিত বার্তা : - 
কিন্তু বাস্তব তা নয়। বিশ্বায়নের এই মানবতাবাদী মুখােশের আড়ালে রয়েছে ভয়ংকর সত্য। বিশ্বায়নের বাণিজ্যিক নীতিমালাকে বাস্তবায়িত করার নেপথ্যে রয়েছে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার এক চতুর প্রয়াস। এই চক্রান্ত উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাদের ধারক-বাহক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। সময়ের সাথে সাথে সামন্তপ্রভু, বণিক, সাম্রাজ্যবাদী হয়ে এখন বিশ্বায়নবাদীর ছদ্মবেশে এরা চাইছে পুঁজিবাদী শক্তির বিস্তার ঘটিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে তাদের হাতের পুতুল তরে তুলতে। আর এভাবেই তারা হয়ে উঠবে স্বপ্নের ‘ভুবন গাঁয়ের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। 

১. বাণিজ্যিক ব্যবস্থাকে অবাধ করার জন্য কোনাে দেশ কর্তৃক তার নিজস্ব পণ্য উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করতে না পারার নিষেধাজ্ঞা, 
২.রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলিকে প্রতিযােগিতায় টিকে থাকার যােগ্য করার জন্য বেসরকারিকরণ করার উপদেশ,
৩. শিল্পোন্নত বিশ্বের তৈরি শিল্পপণ্য যেন বিনা শুল্কে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির বাজারে ঢুকতে পারে তার জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহকে চাপ প্রদান, 
৪. তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পণ্যের উন্নত দেশগুলিতে ঢােকার প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য মান যাচাই, ৫. তৃতীয় বিশ্বকে সাহায্য করার জন্য উদার ‘ঋণ’ হস্ত নিয়ে এগিয়ে আসা,
৬. স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ নানা প্রকল্পে যথেষ্ট অর্থ ঋণ হিসাবে প্রদান, 
৭. NGO-গুলিকে প্রভূত অর্থসাহায্য করা, 
৮. তৃতীয় বিশ্বকে উৎপাদন পদ্ধতি না শিখিয়ে ‘পেটেন্ট’ নামক নিয়মে আবদ্ধ করে শুধুমাত্র কাঁচামাল সরবরাহকারী করে দেওয়া, 
৯. উৎপাদিত দ্রব্যের উপর অধিকারহীনতা তৈরি করা
—এ সবই হলাে আপাত ‘বিশ্বমানবতাবােধে’র অন্তরালে পুঁজিবাদী শক্তির উন্নত মস্তিষ্কপ্রসূত এক খেলা—যার দ্বারা সমস্ত বিশ্বকে করায়ত্ত করে তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার স্বপ্ন রয়েছে। বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ হয়ে উঠতে চায় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।


অধ্যাপক ড. সমীর দাশগুপ্ত তার Globalization and After গ্রন্থে বিশ্বময় পুঁজিবাদের বিস্তার বিষয়টি একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখিয়েছেন তার মতে, “পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল সত্য হল সংকটের সৃষ্টি করা—যার থেকে তৈরি হয় নৈরাশ্য। আর এই নৈরাশ্যের সময়কালে পুঁজিবাদী দেশগুলি সংস্কারের নাম করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, দেশগুলিকে আরও নির্ভরশীল করে তােলে এবং বিশ্বময় পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটায়।”

অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মতাে ভারতবর্ষও এই প্রক্রিয়ার গণ্ডির বাইরে থাকতে পারেনি। ভারতের দুয়ারে বিশ্বায়ন এসেছে পুঁজিবাদী দেশের অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের নীতিমালা, বিশ্বসংযােগ প্রযুক্তি, বিশ্ববিপণনের বিজ্ঞাপনের হাত ধরে। 


পরিসংখ্যান ও ফলাফল : -

১. ১৯৯৭ সালে বিশ্বের মােট ১৯০টি রাষ্ট্র বিশ্বায়নের বৃত্তের মধ্যে আসে। ভারতের স্থান এর তৃতীয় বৃত্তে, যাদেরকে বলা হয় অসংহত উন্নয়নশীল দেশ। এই বৃত্তে অবস্থানকারী দেশসমূহের বৈশিষ্ট্য হল অবিন্যস্ত ও পরিকল্পনাহীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ঋণের বােঝা। 

২. ১৯৯১ সালে ভারতে বিশ্বায়ন বিষয়টি গৃহীত হয়। প্রথমদিকে এর সুপ্রভাব দেখা গেলেও বর্তমানে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের অবস্থা ক্রমশ শােচনীয় হয়ে চলেছে। 

৩. বেড়ে চলেছে উন্নত দেশগুলির সাথে বৈষম্য—যা বিশ্বায়নের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য। আমেরিকার সাথে ভারতের উন্নয়নের তুলনায় দেখতে পাবাে ২০১১ সালে যেখানে আমেরিকার মােট জাতীয় উৎপাদন ১৫,০৯৪ বিলিয়ন ডলার, ভারতের মাত্র ১,৮৪৭ বিলিয়ন ডলার; আমেরিকার মাথাপিছু মােট জাতীয় উৎপাদন ৪৮৪ ডলার, ভারতের ৫৪২ ডলার।

৪.  এছাড়াও আমরা ভারতের আর্থিক দূরাস্তার চিত্র, ঋণগ্রস্ততা প্রভৃতির খবর দৈনন্দিন পত্র-পত্রিকায় পাই। 

৫. সমাজ ও সংস্কৃতির অঙ্গনে বিশ্বায়নের প্রভাব আরাে ব্যাপকতর। ১৯৯১ সালে ভারতে শহুরে জনসংখ্যার ১০%-এর টিভি ছিল, ২০০৯ সালে তা হয়েছে ৮৫%, বিনােদনের রঙীন ঝকঝকে দুনিয়া এখন বাড়ির হেঁসেলে। ট্যাবলেট, মােবাইল, কম্পিউটার ব্যবহার বৃদ্ধি, ফেসবুক-টুইটার-গুগল-এর জগৎ, মাল্টিপ্লেক্স আর শপিং মল সংস্কৃতি, পিজা-বার্গার-কোক, ভ্যালেন্টটাইন-ডে, ফাদার্স ডে-মাদার্স ডে পালন , স্বপ্নালু নয়া সংস্কৃতির জৌলুস—এ সবই বিশ্বায়নের সম্মােহন। সত্যিই সারা বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়।।

৬. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন : সংস্কৃতি এবং মননের রদবদল ঘটিয়েছে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন আমাদের পরম্পরা, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সেই চিরকালীন সংস্কৃতি ও কৃষ্টির অস্তিত্বে এক অদৃশ্য মায়াবাদের জাল বিস্তার করে তার বহুমুখী সত্তাকে করে তুলেছে বিপন্ন। আর এই বিপন্ন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হল এই প্রজন্মের মানুষেরা। 

৭. তৃতীয় বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষের কাছে এ হল জীবনধারার চিরাচরিত ঐতিহ্যের বিলােপসাধন, জীবনযাত্রার মান, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবােধ ও কৃষ্টির অবমূল্যায়ন প্রক্রিয়া।

উপসংহার : - 

বাস্তবিকই বিশ্বায়নের অমােঘ আকর্ষণে সাড়া দিয়ে এখন সেই স্বপ্নভঙ্গের পর শুরু হয়েছে বাস্তবতার খেলা। আশঙ্কা আর উদ্বেগের মধ্যে সর্বদাই একটাই জিজ্ঞাসা—আমরা কি পুঁজিবাদের জাল কেটে আর মুক্ত হতে পারবাে না ? সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন কি স্বপ্নই থেকে যাবে? আজ সমাজের সর্বত্র দেখা যায় ঋণভাৱে জর্জরিত মানুষদের - যা বিশ্বায়নের একটি অন্যতম চরম কুফল। ভারত সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দেখা যায় চরম আর্থিক বৈষম্য , শোষণ , বঞ্চনা ও হাহাকার , সন্ত্রাসবাদের কালো ছায়া এবং মানুষের ক্ষোভ।  

You May Also Like

0 comments