Difference between caste and class . ( জাতি ও শ্রেণি ব্যবস্থার পার্থক্য। )
Difference between caste and class
জাতি ও শ্রেণি ব্যবস্থার পার্থক্য।
জাত ও শ্রেণী (Caste and Class)।
'জাত’ ও ‘শ্রেণি’ উভয়ই সমাজে মর্যাদা-গােষ্ঠী’ (status-group) হিসাবে পরিগণিত হয়। মর্যাদা-গােষ্ঠী বলতে এমন একটি ব্যক্তি গােষ্ঠীকে বােঝায় যাদের জীবনধারায় স্বাতন্ত্র্য আছে এবং এই স্বাতন্ত্র সম্পর্কে সচেতনতা আছে। কোন একটি শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মর্যাদাগত সাম্য পরিলক্ষিত হয়। সমাজের অন্যান্য শ্রেণির পরিপ্রেক্ষিতে এই আর্থ সামাজিক মর্যাদার সমতার কথা বলা হয়। জাতগুলি হল বংশানুক্রমিক। জাতসমূহের আচার-বিচারগত মর্যাদা নির্দিষ্ট।
উৎপাদন-সম্পর্কের শর্তাদির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণীসমূহ নির্ধারিত হয়। কোন সামাজিক শ্রেণি সুসংগঠিত নয়। কিন্তু প্রতিটি সামাজিক শ্রেণির অন্তর্গত ব্যক্তিবর্গ বা পরিবারসমূহ শিক্ষা, আর্থনীতিক ও সামাজিক মর্যাদাগত বিচারে মােটামুটি সমপর্যায়ভুক্ত।
জাতি ও শ্রেণির পার্থক্য :-
সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে জাত ও সামাজিক শ্রেণির মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পার্থক্যগুলি নিম্নরূপ :-
(১) অন্তর্বিবাহ জাতের বৈশিষ্ট্য :- জাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে অন্তর্বিবাহ। (endogamy)-র কথা বলা হয়। জাতভেদ ব্যবস্থায় বিবাহের ব্যাপারে পাত্র-পাত্রী উভয়েই অভিন্ন জাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক। কিন্তু সামাজিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। সামাজিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর ব্যক্তির সঙ্গে অপর এক শ্রেণীর ব্যক্তির বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে।
(২) ভিক্তিগত পার্থক্য :- জাতভেদ প্রথা হল জন্মভিত্তিক ও বংশানুক্রমিক। কুলগত বিচার বা জন্মসূত্রই হল জাতভেদ প্রথার ভিত্তি। স্বভাবতই জাতবিন্যাস হল একটি বংশানুক্রমিক বিষয়। এবং জাত হল একটি বদ্ধ গােষ্ঠী। পক্ষান্তরে সামাজিক শ্রেণীভেদের ভিত্তি হল সামাজিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈষম্য বা জীবনের সুযােগ-সুবিধার নতুন নতুন সম্ভাবনার (life chances) ক্ষেত্রে তারতম্য। পেশাগত পার্থক্য বা আর্থনীতিক অবস্থাগত তারতম্যের কারণে শ্রেণীগত পার্থক্য দেখা দেয় এবং সামাজিক স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়।
(৩) জাত ব্যবস্থা ভারতীয় :- লীচ ও ডুমন্ট (Leach & Dumont)-এর অভিমত অনুযায়ী জাত ব্যবস্থা হল একান্তভাবে একটি ভারতীয় ব্যবস্থা। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এ রকম জাত ব্যবস্থা দেখা যায় না। বিপরীতক্রমে শ্রেণীব্যবস্থা হল একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা। পৃথিবীর সকল দেশেই এই শ্রেণীব্যবস্থার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।
(৪) সামাজিক ব্যবধানের ক্ষেত্রে পার্থক্য :- জাতবিন্যাসের ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মধ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান বর্তমান থাকে। এই ব্যবধান প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সামাজিক ব্যবধান থাকে। এ কথা ঠিক। কিন্তু এই ব্যবধান তেমন প্রকট নয়। সামাজিক শ্রেণীর জাতপঞ্চায়েত থাকে না, থাকে শ্রেণি সংগঠন।
(৫) সামাজিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘শ্রেণী সচেতনতা’ (class ness) এবং শ্রেণী সংহতি’ (class-solidarity)। কিন্তু জাতভেদ প্রথার ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না।
(৬) জাত অনেকাংশে আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত। বিপরীতক্রমে শ্রেণী ছিন্নাংশমূলক প্রকৃতির। শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ প্রতিযােগিতামূলক মনােভাবের দ্বারা পরিচালিত হয়। এই বিষয়টি জাতের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
(৭) সনাতন হিন্দু সমাজের চলে আসা ধারা অনুযায়ী ব্যক্তিমাত্রেরই বৃত্তি বা পেশা পূর্ব নির্দিষ্ট। জাত ও বৃত্তি এ ক্ষেত্রে অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত। শিশু বড় হয়ে পারিবারিক বৃত্তিই গ্রহণ করে। অপরদিকে শ্রেণীব্যবস্থায় ব্যক্তি-মানুষের পেশা পূর্ব-নিদিষ্ট নয়। শ্রেণীব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক পেশার বিষয়টি গুরুত্বহীন।
(৮) সমপাঙক্তেয়তার ক্ষেত্রে পার্থক্য :- জাত ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট সমপাঙক্তেয়তা (commensality)। জাতসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষ ক্ষেত্রে কতকগুলি বিধিনিষেধ প্রচলিত থাকে। সাধারণত পান-ভােজনের ক্ষেত্রে এই সমস্ত বিধিব্যবস্থা বর্তমান থাকে। প্রতিটি জাতই মনে করে যে, তার নিজস্ব এই সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে চলা দরকার। একেই বলে জাত ব্যবস্থার সমপাঙক্তেয়তা। শ্রেণিব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমপাঙক্তেয়তা অনুপস্থিত।
(৯) জাত ব্যবস্থায় পদবির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির জাত-পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ পদবি জাতসমূহের মধ্যে পার্থক্য সূচক বিষয় হিসাবে বর্তমান। কিন্তু শ্রেণীর ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পদবি শ্রেণী-পরিচায়ক ভূমিকা পালন করে না।
(১০) মর্যাদা ও সদস্যপদের ক্ষেত্রে পার্থক্য :- জাতবিন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তির পদমর্যাদা জন্মসূত্রে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এর পরিবর্তন ঘটে না। অপরদিকে শ্রেণীবিন্যাসের ক্ষেত্রে পদমর্যাদার প্রশ্নটি পূর্বনির্ধারিত নয় বা অপরিবর্তনীয়ও নয়। সুতরাং জাতগত মর্যাদা হল। ‘আরােপিত’ (ascribed) মর্যাদা। পক্ষান্তরে সামাজিক শ্রেণীগত মর্যাদা হল অর্জিত’ (acquired) মর্যাদা। সামাজিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে উন্নত শ্রেণীতে উন্নীত হওয়া সম্ভব।
(১১) জাতের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি থাকে :- জাতের মধ্যেই একাধিক শ্রেণির অস্তিত্ব বর্তমান থাকে এবং একটি জাতের অন্তর্গত শ্রেণিসমূহের মধ্যে সংঘাতের সম্পর্ক অপসৃত হয়। অভিন্ন জাতের অন্তর্ভুক্ত দরিদ্র শ্রেণীর মানুষও বিত্তবান শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক সংরক্ষণে যত্নবান হয়।
(১২) সহযােগিতার প্রশ্নে পার্থক্য :- জাতসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা জাত ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয়। তা ছাড়া আর্থনীতিক ক্ষেত্রে জাতসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে লীচ (Leach) - এর মতানুসারে জাত ব্যবস্থা হল একটি জৈবিক (organic) ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি জাত নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। তা ছাড়া জাত ব্যবস্থা হল একটি শ্রমবিভাজন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় সদস্যদের মধ্যে প্রতিযােগিতার উপাদান অনুপস্থিত। বিপরীতক্রমে শ্রেণিব্যবস্থায় কোনো রকম অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বা সহযােগিতা থাকে না। শ্রেণিব্যবস্থায় সহযােগিতার পরিবর্তে প্রতিযােগিতা ও বিরােধ পরিলক্ষিত হয়।
(১৩) সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে পার্থক্য :- ডুমন্ট (Dumont)-এর অভিমত অনুযায়ী জাত ব্যবস্থায় একটি জাতের সামাজিক অবস্থান বা মর্যাদা নির্ধারিত হয় সামাজিক আচার-বিচার বা বিধি - নীতির দ্বারা। এ ক্ষেত্রে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক সুযােগ-সুবিধা গুরুত্বহীন। বিপরীতক্রমে শ্রেণী ব্যবস্থায় ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামাজিক বিধি-রীতি গুরুত্বহীন এবং আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষমতাই গুরুত্বপূর্ণ।
(১৪) নিচু জাতের পরিষেবা :- জাত ব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের জাতসমূহকে নিচু জাতের পরিষেবার উপর নির্ভর করতে হয়। এই কারণে নিচু জাতসমূহের সেবা ও আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে উঁচু জাতের ব্যক্তিবর্গ নিজেদের মধ্যেই পারস্পরিক প্রতিযােগিতার সামিল হয়। কিন্তু শ্রেণী ব্যবস্থায় উচ্চ শ্রেণীসমূহের আনুকূল্য লাভের আশায় নিম্নশ্রেণীসমূহ নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযােগিতার সামিল হয়।
(১৫) সামাজিক সচলতার ক্ষেত্রে পার্থক্য :- সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক সচলতা। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য জাতবিন্যাসের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের ক্ষেত্রে শ্রেণী তা পরিবর্তনের সুযােগ থাকে। তাতে কোন সামাজিক বাধা থাকে না। এই কারণে আধুনিক সমাজের শ্রেণীবিন্যাস মুক্ত সমাজ’ (open society)-এর প্রতীক হিসাবে প্রতীয়মান হয়।
(১৬) জাতভেদ প্রথা ধর্মীয়, শ্রেণীভেদ ধর্মনিরপেক্ষ :- জাতভেদ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঈশ্বরীয় অনুমােদনের অস্তিত্বের কথা বলা হয়। জাতভেদ প্রথার উৎপত্তির ক্ষেত্রেও ঐশ্বরিক ধারণা বা পবিত্রতার কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সমাজের শ্রেণীগত বিন্যাসের ক্ষেত্রে এরকম কোন ঐশ্বরিক বা পবিত্রতার ধারণা অনুপস্থিত। জাত ব্যবস্থা ধর্মের দ্বারা সামগ্রিকভাবে আচ্ছন্ন। বিপরীতক্রমে শ্রেণিব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির।
আঁদ্রে বেতে (Andre Beteille)-র অভিমত অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে জাত একটি সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে কাজ করে। শ্রেণীকে এই ভূমিকায় দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে তিনি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিরােধিতা করেছেন। দক্ষিণ ভারতে শ্রীপুরম অঞ্চলে সম্পাদিত সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষার ভিত্তিতে আঁদ্রে বেতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
0 comments