বিশ্বায়নের প্রকৃতি nature of globalization

by - October 05, 2021

বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা কর। 




বিশ্বায়নের প্রকৃতি :- 


বিশ্বায়ন কোনো নতুন ধারণা নয়। বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যা বহু পূর্বেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বজায় ছিল। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে প্রয়োগের কাজ গত শতাব্দীতে , বিশেষত ১৯৯০ এর পর শুরু হয়। রোল্যান্ড রবার্টসন - এর মতে বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা ( New World Order ) প্রসারের ধারণার সঙ্গে জড়িত। পুঁজির অবাধ চলাচল , মুক্তবাজার অর্থনীতি , উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ প্রভৃতি ধারণার সঙ্গে বিশ্বায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। বিশ্বায়নের প্রকৃতিকে মূলতঃ যে সমস্ত দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে , সেগুলি হল - 


১. অর্থনৈতিক দিক : - 
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি হল তার অর্থনৈতিক প্রকৃতি। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার ( IMF ) , বিশ্বব্যাংক (World Bank ) এবং GATT ( General Agreement on Trade and Tariff ) চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে গঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ( WTO ) অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রধান দিকগুলির মধ্যে রয়েছে বিশ্ববাণিজ্যের দ্রুত প্রসার , লগ্নি পুঁজির অবাধ আদান প্রদান , বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে অভিগমন ও নির্গমন , এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধমের সঞ্চালন , বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ , বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদান প্রদান , আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্য মাধমের বিস্তার ইত্যাদি। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসেন '' The WTO Agreements on Agriculture and its impact on Developing Countries শীর্ষক রচনায় বিশ্বায়নের আর্থিক দিকটি পর্যালোচনা করে বলেছেন , বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত উদার অর্থনীতির পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে। 

২. রাজনৈতিক দিক :- 
রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি রাষ্ট্রের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। বিশ্বায়ন জাতি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি বাজার কেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত করেছে। অধ্যাপক হলটন তাঁর '' Globalization and The Nation State '' শীর্ষক রচনায় জাতি - রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব  আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন - জাতি রাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে  বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। 

Governance as a Globalizing World শীর্ষক গ্রন্থে জন ডি জোনাহিউ বলেছেন , বিশ্বায়নের যুগে মূলধনের সচলতা , এক দেশ থেকে অন্য দেশে দক্ষ শ্রমিকের নির্গমন , তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থ ও শেয়ার হস্তান্তর - ইত্যাদি বিষয়গুলি সরকারের কর আরোপ করার চিরাচরিত ক্ষমতাকে ব্যাহত করেছে। 


৩. সাংস্কৃতিক দিক :- 
সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের প্রধান লক্ষ্য হল সারা বিশ্বে এক সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন ইন্টারনেটসহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রচার শুরু করেছে , এর ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায় তাকে অনেকে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন।      

কে এম পানিক্কর বিশ্বায়ন , সংস্কৃতি ও পণ্য সংক্রান্ত তাঁর এক প্রবন্ধে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন , সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংগঠনগুলি বিশেষভাবে সক্রিয়। আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যে সাংস্কৃতিক আক্রমণ চলছে সেটি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার  এক প্রচেষ্টা। অবশ্য  এর ফলে বিশ্বের জাতি - রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে বিশ্বায়ন বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। 

৪. পরিবেশগত দিক :- 
পরিবেশবিদদের মতে , বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিশ্বের পরিবেশগত ক্ষেত্রে এক সংকট সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুধু যে বিনষ্ট করে চলেছে তাই নয় , তাকে পণ্যায়িত করেছে। পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা তাঁর '' Globalization and Environment '' শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন - পৃথিবীর মূল সম্পদগুলি হল স্থল , জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্য। বিশ্বায়নের প্রভাবে এই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলি পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন ধরণের  সম্পদ হিসেবে এই উপাদানগুলি উপজাতি ও কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকার থেকে নিষ্ক্রান্ত করে বিশ্বায়িত কর্পোরেশনগুলির নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। বিশ্বায়িত বাণিজ্যের চুক্তিগুলি জাতীয় সংবিধানকে অবনমিত করে , যার অর্থ নাগরিকদের জীবনের প্রতি অধিকার , স্থল , জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্যের প্রতি অধিকারের অবলুপ্তি।   


You May Also Like

0 comments