বিশ্বায়নের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট globalisation

by - October 02, 2021

বিশ্বায়নের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট আলোচনা করো। 




বিশ্বায়নের সংজ্ঞা :- 


বিশ্বায়ন বা Globalisation শব্দটি সাম্প্রতিককালে বহু ব্যবহৃত হলেও বিশ্বায়নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। জোসেফ স্টিগলিট্স - এর মতে , বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠ সংহতিসাধন যা পরিবহণ ও যোগাযোগের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস করেছে এবং দ্রব্যসামগ্রী , পরিষেবা , পুঁজি , জ্ঞান এমনকি পৃথিবী জুড়ে মানুষের অবাধ  যাতায়াতের অধিকারের ওপর আরোপিত কৃত্রিম বাধানিষেধকেও অতিক্রম করেছে।  


জন বেইলিস , প্যাট্রিসিয়া , স্টিভ স্মিথ সম্পাদিত The Globalisation of World Politics গ্রন্থে বলা হয়েছে সারা পৃথিবীতে সাধারণতঃ পাঁচটি অর্থে বিশ্বায়নকে বোঝানো হয়। এগুলি হল -
(A) আন্তর্জাতিকীকরণ - যা দেশের গন্ডি মুছে দিয়ে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে। 
(B) উদারীকরণ - দেশের সকল বৈষয়িক বিষয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে একটা খোলামেলা , সুসংহত বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে তোলা। 
(C) সর্বজনীন - বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের ওপর এর প্রভাব সর্বব্যাপী ও সর্বজনীন। 
(D) পশ্চিমিকরণ -  উন্নত দেশগুলির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন উন্নয়নশীল দেশগুলিকে প্রভাবিত করে। 
(E) সীমান্তলোপকরণ - রাষ্ট্রীয় সীমান্ত সম্পর্কে কঠোর ব্যবস্থা হ্রাস করে সর্বক্ষেত্রে যাতায়াত সহজ করে তোলা। 

সুতরাং , বিশ্বের বিভিন্ন দেশের , বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে অন্যান্য প্রান্তের মানুষের অবাধ বাণিজ্যিক , সাংস্কৃতিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ , পারস্পরিক আদান প্রদান , বাজার অর্থনীতি প্রভৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াই হল বিশ্বায়ন। 


বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট :- 


বিশ্বায়নের কতকগুলি অপরিহার্য  ও মৌলিক বৈশিষ্ট রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল - 

১. বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংহতি স্থাপন :- 
বিশ্বায়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে নিবিড় সংহতি গড়ে তুলতে চায়। আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে একাকী  বিচ্ছিন্নভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বিশ্বায়ন এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন যোগসূত্র গড়ে তুলতে চায়। 

২. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা :- 
বিশ্বায়ন অত্যন্ত সচেতনভাবে সমগ্র বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নির্বিশেষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে একটি পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পরিবেশ গড়ে তোলার পক্ষপাতী। নোয়াম চমস্কির মতে , বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য হল বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে দৃঢ়তর করে তোলা। 

৩. বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা :- 
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হল , আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে সুনিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষকরা মনে করেন , বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশাপাশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির ভূমিকাও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। 

৪. পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ চলাচল :- 
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হিসেবে আধুনিক বিশ্বে পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ চলাচলের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বিশ্বায়নের যুগে পুঁজি , প্রযুক্তি ও কারিগরি কৌশল কোনো একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে সীমায়িত হয়ে থাকেনি। বিশ্ব বাণিজ্যের অবাধ গতি এই বিষয়টিকে আরো সহজ করে তুলেছে। 

৫. মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা :- 
বিশ্বায়নের একটি প্রধান বৈশিষ্ট হল মুক্ত বাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন সারা বিশ্বের বাজারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখতে চায়। বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে মনে করা হয় যে , বাণিজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে অবাঞ্চিত। 

৬. রাষ্ট্রের সাবেকি সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন :- 
রাষ্ট্রের সাবেকি সার্বভৌম ক্ষমতার পরিবর্তনকে বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট বলে মনে করা হয়। সাবেকি সর্বভৌমিকতায় মনে করা হয় , বাহ্যিক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের যে অসীম বা চরম ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বায়ন তাকে অস্বীকার করে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে বাহ্যিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রই চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এই আধুনিক বিশ্বে , নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার সদস্য হিসেবে ছোট - বড় সকল রাষ্ট্রকেই বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ( WTO ) - র মত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নীতি ও নির্দেশ মেনে চলতে হয়। 

৭. তথ্য - প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি :- 
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হল তথ্য - প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি। বিশ্বায়নের যুগে ইন্টারনেট সহ তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিচরণে জাতি রাষ্ট্রের নিয়ম কানুন কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারেনা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করেন , তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে ইন্টারনেট বিপ্লবের মাধ্যমে জাতি রাষ্ট্রের সীমারেখাকে নিশ্চিহ্ন করে বিশ্বায়ন এক জাতি এক বিশ্বের এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। 


You May Also Like

0 comments