আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার সংজ্ঞা ও উপাদান। international politics

by - September 25, 2021

শক্তি বা ক্ষমতার সংজ্ঞা দাও। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলি বিশ্লেষণ কর।




শক্তি বা ক্ষমতার ধারণা ও সংজ্ঞা :-  


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ হ্যান্স জে মরগেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে শক্তি বা ক্ষমতার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন , শক্তি বা ক্ষমতা বলতে অন্যের মন ও কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। তাঁর মতে , এক জাতির মন ও কাজের ওপর অন্য জাতির ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগ হল জাতীয় শক্তি। 

অরগানস্কি - র মতে , আন্তর্জাতিক শক্তি বা ক্ষমতা হল অন্য জাতিকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করার ক্ষমতা। 

জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল বলেছেন , অন্য জাতির ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে নিজের ইচ্ছানুযারী ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা। 

কার্ল ডয়েস এর মতে , একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অন্যান্য রাষ্ট্রের আচরণকে তার নিজের ইচ্ছেনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য। 


আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদান :- 


অর্গানস্কি তাঁর World Politics শীর্ষক গ্রন্থে এইরূপ অভিমত প্রকাশ করছেন যে , রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হল ক্ষমতা বা শক্তি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র কী  ভূমিকা নেবে তা প্রধানত ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়। শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলি হল - 

১. ভৌগোলিক অবস্থান :- 
অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থান দেশের সামরিক ও নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। যেমন - বর্তমানে একমেরু বিশ্বের অতিবৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বদিকে তিন হাজার মাইল এবং পশ্চিমদিকে ছ - হাজার মাইল জলপথ তাকে নিরাপত্তার দিক দিয়ে সুবিধাজনক জায়গায় রেখেছে। 

২. রাষ্ট্রের আয়তন :- 
সাধারণভাবে মনে করা হয় রাষ্ট্রের আয়তন বৃহৎ হলে তার শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ ধারণা সবসময় সঠিক নয়। কেননা , কানাডা , অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ আয়তনে বড় হলেও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল ; আবার ইজরায়েল ক্ষুদ্র দেশ হলেও সামরিক দিক দিয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। 

৩. ভূপ্রকৃতি :- 
আধুনিক বিশ্বে জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে ভূপ্রকৃতিও গুরুত্বপূর্ণ। যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকাংশে ভূপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। বন্ধুর ও প্রতিকূল ভূপ্রকৃতি কোনো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ , রাজনৈতিক ঐক্য এমনকি জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। 

৪. জলবায়ু :- 
জলবায়ু মানুষের কর্মক্ষমতা নির্ধারণ করে জাতীয় শক্তিকে প্রভাবিত করে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে , নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল কোনো দেশের বৃহৎ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশের পক্ষে সহায়ক। ক্রান্তীয় মৌসুমী অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের ফলে কৃষির উৎপাদন বেশি হয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পায়। 

৫. জনসংখ্যা :- 
জনসংখ্যা বা মানবসম্পদ জাতীয় শক্তির অন্যতম নির্ণায়ক উপাদান। প্রতিরক্ষা , অর্থনৈতিক বিকাশ এবং দেশ গঠনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী , দক্ষ ও শিক্ষিত জনগণের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। জনসংখ্যা বেশি হলে , বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব , নেতৃত্ব , প্রতিভার সন্ধান সহজলভ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন , জাপান স্বল্প জনসংখ্যার দেশ হলেও এর সার্বিক উন্নয়ন ও জাতীয় শক্তি উল্লেখযোগ্য। 

৬. প্রাকৃতিক সম্পদ :- 
আধুনিক বিশ্বে কোনো দেশকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে গেলে তাকে অবশ্যই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হতে হবে। আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চমানের ইস্পাত , খনিজ তেল , ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের একান্ত প্রয়োজন। প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ , শিল্পোন্নয়ন - ইত্যাদির জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। 


৭. অর্থনৈতিক সামর্থ্য :- 
অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে জাতীয় শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলি এই কারণে জাতীয় শক্তির দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বস্তুত কোনো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের হার অনুকূল না হলে তার পক্ষে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছাড়া প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই প্রযুক্তির উন্নয়নকে কাজে লাগিয়েই জাপান আজ নিজেকে উন্নত শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। 

৮. সামরিক ব্যবস্থা :- 
বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থা না থাকলে কোনো দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র গতানুগতিক স্থলবাহিনী , নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী নয় ; এর সাথে বর্তমান প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পারমাণবিক অস্ত্র , আন্তর্দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য শক্তিশালী মারণাস্ত্রের উপর বর্তমানে একটি দেশের সামরিক শক্তি নির্ভর করে। 

৯. সরকারের প্রকৃতি :- 
হ্যান্স জে মরগেনথাউ এর মতে , একটি উৎকৃষ্ট সরকার ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির সার্থক রূপায়ণ সম্ভবপর নয়। সরকারের প্রকৃতির ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ভর করে। অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমলাবর্গের সক্রিয়তার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। 

১০. জাতীয় চরিত্র ও জাতীয় বৈশিষ্ট :- 
কোনো দেশের শক্তি অর্জনের বিষয়টি সেই দেশের জনগণের জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট ও আত্মবিশ্বাসের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। যেমন , প্রবল দেশপ্রেম ও সুদৃঢ় মনোবলের জন্যই ভিয়েতনামের মত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বৃহৎ শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সঙ্গে লড়াই চালাতে পেরেছিল। 

১১. কূটনীতি :- 
অনেকে কূটনীতিকে জাতীয় শক্তির মস্তিষ্করূপে বর্ণনা করেছেন। মরগেনথাউ - এর মতে , যেসব উপাদান নিয়ে কোনো জাতির শক্তি গড়ে ওঠে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কূটনীতি। কূটনীতির মাধ্যমে একটি দেশ তার জাতীয় শক্তির অন্যান্য উপাদানকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পারে। 

১২. আন্তর্জাতিক ভূমিকা ও সহাবস্থান :- 
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি দেশের সার্থক অংশগ্রহণ সেই দেশের জাতীয় শক্তির ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলিতে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা পালনের মধ্যে দিয়ে ও জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে সুবিধাজনক জায়গায় রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি দেশের অংশগ্রহণকেই জাতীয় শক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 

পরিশেষে বলা যায় , কোনো একটি বা কয়েকটি উপাদানের বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে শক্তি বা ক্ষমতার সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায়না। জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি উপাদানের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলিরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে।     

   

You May Also Like

0 comments