সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা দাও। সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন ধরণগুলি আলোচনা কর। social stratification .

by - August 05, 2021

Define social stratification . Discuss the various forms of social stratification .

সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা দাও। সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন ধরণগুলি আলোচনা কর। 





সামাজিক স্তরবিন্যাস :-     


সামাজিক স্তরবিন্যাস হল সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গকে উচ্চ - নীচ স্তরে বিভক্ত করা। অর্থাৎ , সমাজের ব্যক্তিবর্গকে তাদের সামাজিক অবস্থান , অর্থাৎ মর্যাদা এবং ভূমিকা অনুযায়ী ক্রমোচ্চভাবে বিন্যস্ত করাকে বলে সামাজিক স্তরবিন্যাস। 


এল ক্রিসবার্গ : সামাজিক স্তরবিন্যাস হল অসমতার একটি অটল বা স্থির ব্যবস্থা , যেটি নিয়ম ও কাঠামোর ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। 

অগবার্ন ও নিমকফ : যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে মর্যাদার ক্রমানুসারে কম - বেশি স্থায়ীভাবে বিন্যস্ত করা হয় , তাকে বলে সামাজিক স্তরবিন্যাস। 

জিসবার্ট : সামাজিক স্তরবিন্যাস হল শ্রেষ্ঠত্ব ও বশ্যতার দ্বারা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত স্থায়ী গোষ্ঠী বা শ্রেণীতে সমাজের বিভাজন। 

মেলভিন টিউমিন : সামাজিক স্তরবিন্যাস বলতে বোঝায় , ক্ষমতা , সম্পত্তি , সামাজিক মূল্যায়ন , মানসিক পরিতৃপ্তির বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো গোষ্ঠী বা সমাজের ক্রমোচ্চ বিভাজনকে। 

সরোকিন : সামাজিক স্তরবিন্যাস হল জনসংখ্যার পর্যায়ক্রমে বিভক্তিকরণ , যে বিন্যাসের এক প্রান্তে উচ্চ শ্রেণী ও অপরপ্রান্তে নিম্নশ্রেনী অবস্থিত। 

চিনয় : চিনয় তাঁর Society : An Introduction to Sociology গ্রন্থে বলেছেন , প্রত্যেক সমাজেই কিছু ব্যক্তি হন উচ্চ , আবার কিছু হন নীচ , কিছু ব্যক্তি শাসন করেন আবার কিছু ব্যক্তি শাসিত ও শোষিত হন। উচ্চ - নীচ , ধনী - দরিদ্র , শক্তিশালী - শক্তিহীন - এইসকল বৈপরীত্যই সামাজিক স্তরবিন্যাসের সারবত্তা।    


সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন ধরণ :-        


সামাজিক স্তরবিন্যাস চিরন্তন হলেও সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে  স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রকারভেদ পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক স্তরবিন্যাসের তিনটি ভিত্তি আছে - (ক ) অর্থনীতি ভিত্তিক , (খ ) মর্যাদা ভিত্তিক ও (গ ) ক্ষমতা ভিত্তিক। সমাজতাত্ত্বিকগণ স্তরবিন্যাসের এই রূপগুলিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেন। যথা - ১. দাসপ্রথা , ২. সামন্ত প্রথা বা ভূমিদাস প্রথা ৩. শ্রেণি ব্যবস্থা , ৪. জাতি ব্যবস্থা ও ৫. ক্ষমতা। 

১. দাসপ্রথা :- 
সামাজিক স্তরবিন্যাসের এক চরম নিদর্শন হল দাসপ্রথা। প্রাচীন যুগে ইউরোপে এই প্রথা অনুযায়ী সমাজে দুই শ্রেনীর মানুষ ছিল - ক্রীতদাস ও দাস - মালিক। সামাজিক প্রথা অনুযায়ী ক্রীতদাসের কোনরূপ ভূসম্পত্তি অথবা মানবিক অধিকার ছিলনা। ক্রীতদাসগণ প্রভুর সম্পত্তি রূপে গণ্য হত। পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা দাসপ্রথার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ছিল। 

দাসপ্রথার তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যায় - 
প্রথমত : দাস ছিল প্রভুর সম্পত্তি। দাসের ওপর প্রভুর অগাধ কর্তৃত্ব স্বীকৃত ছিল। 
দ্বিতীয়ত :- সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রীতদাসের কোনো অধিকার ছিল না। সমাজে ক্রীতদাস ছিল ঘৃণার পাত্র। 
তৃতীয়তঃ - দাসকে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম দান করতে হত। 
প্রাচীন যুগের পরবর্তীকালে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটে। 

২.  সামন্তপ্রথা :- 
মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ত বা ভূমিস্বত্ব বা তালুক প্রথাকে কেন্দ্র করে সামাজিক স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। শব্দটি ভূমি ,  জমি বা তালুক অধিগ্রহণ ও স্বত্বাধিকার হতে উদ্ভব হয়েছে।  অসম ভূমি বন্টনের জন্য একটি তালুকের মালিক নির্দিষ্ট মর্যাদা বহন করত। মধ্যযুগীয় সামন্তপ্রথা অনুযায়ী তিনটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। 

প্রথমতঃ  সমাজের লোকেরা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। প্রথম শ্রেণীতে ছিলেন যাজক সম্প্রদায় , তাদের বলা হত ফার্স্ট স্টেট ; দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিলেন অভিজাত সম্প্রদায় এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন সর্বসাধারণ। এই তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের একত্রে থার্ড স্টেট বলা হত। এই তিন শ্রেণীর কাজকর্ম এবং জীবনযাপনের রীতিতে পার্থক্য বজায় ছিল। 

দ্বিতীয়তঃ - প্রত্যেকটি শ্রেণীর পদমর্যাদা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সুনির্দিষ্ট করা ছিল। আইনের চোখে সকলেই সমান ছিল না। একই অপরাধের জন্য অভিজাত সম্প্রদায় এবং সাধারণ মানুষ ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি পেত।  অন্যান্য আইন সম্মত অধিকারের ক্ষেত্রেও পার্থক্য ছিল। 

তৃতীয়তঃ  সামন্তপ্রথায়  শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তিগণ রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতেন। সাধারণ মানুষের কোনোরূপ রাজনৈতিক অধিকার ছিলনা। মধ্যযুগের ইউরোপ ছাড়া প্রাচীন ভারতবর্ষেও সামন্ত প্রথার প্রচলন বজায় ছিল। তবে ভারতবর্ষে সামন্ত প্রথা ছিল পৃথক ধরনের। অবশ্য ধনতন্ত্রের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে। সামন্তপ্রথার পরিবর্তে শ্রেণি ব্যবস্থা সামাজিক স্তরবিন্যাসের অন্যতম ভিত্তিতে পরিণত হয়।


৩. শ্রেণী ব্যবস্থা :- 
শিল্প সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে সমাজের জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করা হয়। শ্রেণি বা Class শব্দটি সমাজতত্ত্বে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে , শ্রেণি হল এমন এক জনসমষ্টি যাদের উপযোগিতা গ্রহণের সুযোগ ও জীবনযাত্রার মান সমপর্যায়ভুক্ত।  ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা ও সম্পত্তির অধিকার থেকে শ্রেণী নির্ধারিত হয়ে থাকে। বায়ারস্টেড পদমর্যাদার ভিত্তিতে সামাজিক শ্রেণীকে বিভক্ত করেছেন। 

আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজে মর্যাদা অনুসারী শ্রেণি প্রাধান্য পেয়েছে। মর্যাদা অনুযায়ী শ্রেণি ভোগ এবং জীবনযাপনের রীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে জীবনযাপনের রীতি , চাল - চলন , কথাবার্তা , চিন্তা , অনুভূতি , পোশাক-পরিচ্ছেদ সামাজিক শ্রেণীর বা মর্যাদা অনুসারী শ্রেণীর নির্ধারক হিসেবে কাজ করে।  বিশুদ্ধ অনুভূতি , শিক্ষা , আসবাবপত্র , আদান প্রদান - ইত্যাদি সবই গুরুত্বপূর্ণ। 

লেনিনের মতে , শ্রেণী হল এমন এক জনসমষ্টি যে জনসমষ্টি উৎপাদনের সঙ্গে এক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে এবং উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে। 

৪. জাতি ব্যবস্থা :- 
শ্রেণী ব্যবস্থার সাথে সাথে জাতি ব্যবস্থা হল ভারতীয় সমাজের এক সুপ্রাচীন বৈশিষ্ট। অধ্যাপক মজুমদার ও মদনের মতে , জাতি বলতে এক বদ্ধ গোষ্ঠীকে বোঝায়। বস্তুতঃপক্ষে জাতি হল একটি অন্তঃবৈবাহিক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী সদস্যদের সামাজিক ক্ষেত্রে কতকগুলি বিধিনিষেধ বা আচার - আচরণ মেনে চলতে হয়। 

জাতি ব্যবস্থায় বৃত্তি অনুযায়ী ভারতীয় সমাজের জনগোষ্ঠীকে প্রধানত চারভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা - ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য ও শুদ্র। 

এক্ষেত্রে জাতি ব্যবস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট উল্লেখযোগ্য - 
(ক ) সদস্যপদ জন্মসূত্রে নির্ধারিত। 
(খ ) সামাজিক নিশ্চলতা। 
(গ ) বংশানুক্রমিক পেশা বা বৃত্তি। 
(ঘ ) আন্তঃবিবাহ বা বিবাহের কঠোরতা। 
(ঙ ) মর্যাদার পার্থক্য। 
(চ ) সুনির্দিষ্ট রীতিনীতি ই বিধি নিষেধ। 

৫. ক্ষমতা :- 
রাষ্ট্র ও রাজনীতি হল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। দৈহিক শক্তির প্রয়োগ অথবা দেখিয়ে কোনো ব্যক্তিকে পরিচালিত করার সামর্থ্য হল ক্ষমতা। বর্তমানে ক্ষমতা হল সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। প্যারেটো প্রমুখ ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গকে বিভক্ত করেন - শাসক , শাসিত , সাধারণ মানুষ - ইত্যাদি। 

প্যারেটো এলিট বা প্রবর তত্ত্বের সাহায্যে সমাজে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন। কার্ল মার্কস ও ম্যাক্স ওয়েবার ক্ষমতাকে সামাজিক মর্যাদার সূচক হিসেবে গণ্য করেন। প্যারেটো , মস্কা এবং মিচেলস তাঁদের এলিট তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন যে , সকল সমাজে এক সংখ্যালঘিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর কর্তৃত্ত্ব স্থাপন করে। 


You May Also Like

1 comments

  1. খুব সুন্দর লিখন পদ্ধতি।

    ReplyDelete