'' নবান্ন '' নাটকের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।

by - August 18, 2021

'' নবান্ন '' নাটকের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো। 

অথবা , নবান্ন নাটকটির নামকরণ কতদূর যথার্থ - তা আলোচনা করো। 




সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ নামের মধ্যে দিয়েই লেখক তাঁর রচনার বা সাহিত্যের মূলভাব প্রকাশ করে থাকেন। লেখার বিষয় নামকরণে ফুটে ওঠে। শিল্পী মাত্রেই নামকরণের ব্যাপারে সচেতন থাকেন। নবান্ন নাটকের নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য নাট্য সচেতন শিল্পী। তাঁর নবান্ন নাটকটি হল বাস্তবধর্মী নাটক। নাট্যকারের আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি , বৃহত্তর শ্রেণীর আশা - আকাঙ্খা নাটকের নাটকের নামকরণে প্রতিফলিত হয়েছে। 

 
নবান্ন নাটকটি যে দেশকালের প্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে সেটি একদিকে ছিল দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষের এবং অন্যদিকে ক্রান্তিকালের। নবান্ন নাটক আমাদের মনে স্মৃতির সমুদ্র মন্থন করে তুলে আনে নবান্ন উৎসবের ছবি।  বন্যা , মহাযুদ্ধ , মহামারী - ইত্যাদি আমিনপুরের গ্রাম্য জীবনের সুস্নিগ্ধ দিন যাপন পদ্ধতির বুকে আঘাত হেনে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। মানুষ হয়ে উঠেছিল জন্তুপ্রায়। অন্নহীন , বস্ত্রহীন , মান-সম্ভ্রমহীন ভিখিরীতে রূপান্তরিত হয়ে মানুষ ভুলতে বসেছিল আপন অস্তিত্ব। সেই রকম এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগপূর্ণ দিনের চিত্র ফুটে উঠেছে নবান্ন নাটকে যেখানে মানুষের অস্তিত্বই সংকটে সেখানে নবান্ন উৎসব পালনের কথা ভাবাই যায়না। 

কিন্তু এত ঝড়-ঝাপটা ও দুর্ভিক্ষ সেই মানুষগুলোর মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি নবান্ন উৎসবের স্মৃতিকে। তাই যখন আবার ঘরছাড়া মানুষগুলো ফিরে এসেছে গ্রামে , নতুন ধান তুলেছে ঘরে , তখন নবান্ন উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তারা। বিগত দিনগুলোর বিভীষিকা মন থেকে মুছে ফেলে আয়োজন করেছে নবান্ন উৎসবের। 


নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে প্রাকৃতিক সংকটের ঘনীভূত রূপ দেখা যায়। তৃতীয় দৃশ্যের শেষের দিকে আকস্মিকভাবে প্রচন্ড ঝড় ওঠে , সাইক্লোনে প্রধানের দোচালা বিনোদিনীর মাথার ওপর ভেঙে পড়ে।  বিনোদিনী সেই আঘাতে অচৈতন্য হয়ে পরে। আবার সেই ঝড়ের প্রকোপে তৈরি হওয়া বন্যা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। বন্যায় সবকিছু ভেসে যায়। 

চতুর্থ দৃশ্যে দুর্যোগ ও বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে ভয়াবহ অভাব ও অর্থসংকট জন্ম নেয়। মানুষের খাদ্যের সংস্থান সংকুচিত হয়ে পড়ে। নাটক অনুসারে বলা যায় ,  '' নিত্যি ঐ এক ডুমুর - কলা সেদ্ধ আর কচুর নাতির ঝোল। '' 

পঞ্চম দৃশ্যে অনাহার , খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের জন্য কিছু মানুষের অমানবিক স্বার্থপরতা কীভাবে দায়ী -  তা বর্ণনা করা হয়েছে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে মজুতদারী ও কালোবাজারি যুদ্ধকালীন ব্যবস্থায় কীভাবে মানুষের অসহায় অবস্থার উপর চরম আঘাত হেনেছে - তার উল্লেখ পাওয়া যায় কালীধন ধাড়া ও হারু দত্ত নামক দুটি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। এরা বিবেকহীন , হৃদয়হীন ও অমানবিক বাণিজ্যকতার জাল সর্বত্র ছড়িয়ে রাখে - সে পরিচয় পাওয়া যায়। এদেরই চক্রান্তে ও রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় '' মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ '' লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। 

ষষ্ঠ দৃশ্য দেখা যায় সমাদ্দার পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরের পার্কে আশ্রয় নিয়েছে দুমুঠো খাবারের আশায়।  এরই মধ্যে বিচিত্র ধরনের সুযোগ সন্ধানীরা নানা রূপে ও বেশে জীর্ণশীর্ণ , বস্ত্রহীন - এই নিরন্ন কঙ্কালসার মানুষগুলোকে নিয়ে নির্লজ্জভাবে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্যোগী হয়। এদের কেউ ফটোগ্রাফার , কেউ বা টাউট। প্রথমোক্তরা প্রধানের ভাষায় '' কঙ্কালের ছবির ব্যবসাদার। '' 

তৃতীয় ও চতুর্থ দৃশ্যে প্রধান , কুঞ্জ , রাধিকা রাজপথে খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। প্রধান বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করেও ক্ষুধার অন্ন জোগাড় করতে পারেনা। কুঞ্জ ডাস্টবিনের খাবার নিয়ে কুকুরে - মানুষে লড়াই করছে। এ দৃশ্য বড়ই মর্মান্তিক। ওদিকে বড়লোকের বাড়িতে পান ভোজনের সমারোহ ; কিন্তু সামান্য উচ্ছিষ্টটুকুও দুর্গত মানুষদের দান করতে এদের হাত সরেনা। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে দেখা যায় ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত্যু মিছিল। 

অন্যদিকে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে হারু একদিকে বিপন্ন মানুষের জমি-বাড়ি সস্তায় কিনে নেয় এবং অপরদিকে গ্রামের দুস্থ মা - বাপ কে ভুল বুঝিয়ে মেয়েদের শহরে চালান দেয়।  কালীধনের সেবাশ্রমে 'সেবা' -  নামের আড়ালে নারীদেহ নিয়ে দেহব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এমনকি পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করলেও তাদের যে ছাড়া পেতে অসুবিধে হবে না - এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মেদিনীপুর ও চব্বিশ পরগনার একাংশ সাইক্লোন , জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় বিপর্যস্ত হয়। খাদ্য সংকট দেশবাসীর জীবনে নিয়ে এসেছিল মন্বন্তর। বাংলায় প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ এ সময় অনাহারে মৃত্যু বরণ করে। জোতদার , মজুতদাররা এর সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে শোষণ করে। নবান্ন নাটকে সমাজের সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। 

পরিশেষে বলা যায় , নবান্ন নাটকটি হল সংগ্রামের নাটক। আবার এই নাটকের শেষের দিকে নতুন দিনের সূচনার আভাস পাওয়া যায়। সংগ্রামের শেষে জীবনের জয়গান ফুটে উঠেছে এই নাটকে। সব হারানোর শেষে সব প্রাপ্তির যে চেতনা , তার মধ্যে দিয়ে পাওয়া যায় নতুন জীবনের উৎসব। সেই নতুন জীবন আহ্বান জানায় নতুন ভোরের রক্তিম সূর্যকে। মানুষকে অনুপ্রাণিত , উদ্দীপিত করার বার্তা দেওয়া হয়েছে এই নাটকে। নাটকের শেষ দিকে নবান্ন উৎসব পালন , শুধুই উৎসব হয়ে থাকেনি , তা মানুষের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নতুন করে বাঁচার আদর্শকে তুলে ধরা হয়েছে। তাই নবান্ন নাটকের নামকরণ ব্যাঞ্জনাধর্মী এবং যথার্থ।    


You May Also Like

0 comments