বৃন্দাবন কীভাবে পন্ডিতমশাই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে - তা আলোচনা করো।

by - August 18, 2021

বৃন্দাবনকে পন্ডিতমশাই উপন্যাসের নায়ক চরিত্র বলা যায় কি'না আলোচনা কর। 

অথবা , '' পন্ডিতমশাই উপন্যাসের নায়ক বৃন্দাবন '' - এই মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো। 

অথবা , বৃন্দাবন কীভাবে পন্ডিতমশাই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে - তা আলোচনা করো। 

অথবা , পন্ডিতমশাই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কে ? যুক্তিসহ আলোচনা করো। 




পন্ডিতমশাই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হল বৃন্দাবন। সাধারণত যে চরিত্র সমস্ত ঘটনা ধারাকে পরিচালিত করে , অথবা যাকে কেন্দ্র করে সমস্ত ঘটনা আবর্তিত হয় , সেই পুরুষ চরিত্রকে নায়ক বলা যায়। এই অর্থে বৃন্দাবনকে পন্ডিতমশাই উপন্যাসের নায়ক বলা যেতে পারে। যেহেতু নায়িকা কুসুমের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে বৃন্দাবনের জীবনধারা পরিচালিত হয়েছে এবং উপন্যাসের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে , সেই কারণে বৃন্দাবনকে এই উপন্যাসের নায়ক চরিত্র হিসেবে মেনে নেওয়া যেতে পারে। 


পন্ডিতমশাই উপন্যাসে কুসুম আকর্ষণীয় ও কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও কুসুম চরিত্রের বিকাশে ও প্রকাশে  বৃন্দাবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অর্থাৎ পন্ডিতমশাই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে তার জায়গা অনেকখানি।  গ্রামের মানুষ তাকে পন্ডিতমশাই নামে ডাকে। প্রথম জীবনে নয় , পরবর্তীকালে নানানভাবে জ্ঞানচর্চা করে বৃন্দাবন একজন নিষ্ঠাবান পন্ডিতে পরিণত হয়। কুসুম সেই বাল্যে যেদিন বৃন্দাবনের জীবন থেকে সামাজিক অনুশাসনে চলে আসতে বাধ্য হয় , তখন বৃন্দাবনের কোনো জ্ঞানচর্চার কথা তার জানা ছিল না। তাই পরবর্তীকালে সেই সংবাদে কুসুম যেমন বিস্মিত হয় , তেমনি আবার বৃন্দাবনের প্রতি শ্রদ্ধাও  জাগে। 

বৃন্দাবন অত্যন্ত সৎ চরিত্র , স্বল্পবাক এবং স্বভাবধর্মে বিনয়ী ও সংযত মানুষ। তার মধ্যে দেখা যায় যৌবনের উচ্ছল উদ্দামতার থেকে বয়স্ক স্থিতধী সংযমের প্রাধান্য। তাই দীর্ঘদিন যে পূর্ণবয়স্কা  কুসুমকে কলসি কাঁখে সিক্তবসনে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল বৃন্দাবন , যুবতী তার কাছে প্রাথমিকভাবে অপরিচিত হলেও সেই যুবতীর পরিচয় আবিষ্কারে বৃন্দাবন দ্রুত উপলব্ধি করেছে যে , সে হচ্ছে তারই  বিবাহিতা স্ত্রী কুসুম। এই পরিচয় আবিষ্কারের সূত্রেই সম্ভবত স্ত্রী কুসুমের উপর তার অধিকারবোধ জন্মায়। বাংলার বৈষ্ণব সমাজের কন্ঠিবদলের প্রথা দৃঢ়চেতা বৃন্দাবনকে প্রভাবিত করেনি। 


গ্রামের একটি সম্পন্ন পরিবারের সন্তান বৃন্দাবন। গ্রামের মাটিতে বাস করলেও বৃন্দাবন শুধুই পারিবারিক অর্থ , গ্রাম্য জীবন ও তার সংস্কার নিয়ে না থেকে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কোথায় - তা ভালভাবে উপলব্ধি করেছিল। কৃষিভিত্তিক গ্রাম্যজীবনে বিদ্যার তেমন প্রয়োজন কেউই অনুভব করেনি ; কেননা বিদ্যার্জনের কোনো উপায়ও সেখানে ছিল বলে মনে হয় না। সব গ্রামে ঠিকমতো কোনো পাঠশালা ছিল না।  এই অবস্থায় বৃন্দাবন আপনার ভেতরকার প্রেরণায় বিদ্যার প্রাথমিক পাঠ সমাপ্ত করে। কিছুটা ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে আধুনিকতার পাঠ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তার আধুনিক মনোভাব তাকে বলিষ্ঠ মানুষ হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত করে। 

নিজের বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন নিরক্ষর গ্রামের অশিক্ষিত কৃষক সন্তানদের শেখানোর চেষ্টা করে। গ্রামে পাঠশালা খোলার কথা ভাবে। কিন্তু পিতা গৌড় দাসের দিক থেকে কোনো সহায়তা সে পায়নি। বিষয়-আশয় , চাষবাস ইত্যাদির প্রতিও তার দুর্বলতা ছিল। আবার নিজেকে যুগোপযোগী করার প্রয়াসও ছিল। এই আধুনিক মানুষকে তাই হঠাৎ দেখে কুসুম বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি ; বরং রীতিমত অবাক হয়। আবার বৃন্দাবন সাত বছর বয়সের কুসুমকে দীর্ঘদিন পর পূর্ণ যুবতী হিসেবে দেখে মুগ্ধ হয়।  দুজনের কাছে দুজনেই যেন নব পরিচয় প্রাপ্ত হয় আজ। 

বৃন্দাবন একজন সৎ চরিত্রের মানুষ। সে নির্লোভ। মানুষকে শ্রদ্ধা করতে জানে। তাই তার স্ত্রীকে সে মর্যাদা দেয়। স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেম ছিল অক্ষুন্ন। রুচিশীল , শিক্ষিত এই মানুষটি শেষ পর্যন্ত কুসুমের হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করে তোলে। তাই উপন্যাসের নায়কের মর্যাদার অধিকারী বৃন্দাবন। 

পন্ডিতমশাই বা বৃন্দাবন বাঙালি পরিবারের একজন সংসারী মানুষ। পৈতৃক জমিজমা , স্ত্রী কুসুম , পুত্র চরণ - ইত্যাদি নিয়েই সে শুধু থাকেনি ; অর্থাৎ আর পাঁচটা বাঙালির মত শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত থাকতে পারেনা। বৃন্দাবন নিজের পরিধি ছাপিয়ে অপরের কথা ভেবে আপনার মানবধর্মকে সার্থক করার কথা বলেছে। গ্রাম সংগঠনের জন্য দরকার ছিল সৎ ও উদ্যোগী মানুষের। বৃন্দাবন তেমনিই এক সৎ ও  উদ্যোগী মানুষ , যা অনেকটা আদর্শরূপে স্থাপন করতে চেয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। 

বৃন্দাবনকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন ধীর-স্থির , দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। মা ও একমাত্র সন্তান চরণকে হারানোর পরও সে জীবন যুদ্ধে হতাশ হয়নি। সন্নাসীর মতো সবকিছু ত্যাগ করে পথে নেমেছে। যদিও তার পথে নামাতে সঙ্গী হিসাবে শেষ পর্যন্ত পেয়ে যায় স্ত্রী কুসুমকে। বৃন্দাবন শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করেছে সংসার জীবনে নারী বা স্ত্রীকে অস্বীকার করে সাধনা সফল হয়না। পন্ডিতমশাইরুপী বৃন্দাবন হয়ে উঠেছে একটি প্রতীকী চরিত্র। বৃন্দাবন বা পন্ডিতমশাইয়ের মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্রের জীবনদর্শন প্রকাশিত। তাই , বৃন্দাবনই উপন্যাসের নায়ক এবং সে অবশ্যই একটি আকর্ষণীয় ও যথার্থ চরিত্র। 


     

You May Also Like

0 comments