যোগ বিকাশের ইতিহাস। ( History of Development of Yoga )

by - July 17, 2021

যোগ বিকাশের ইতিহাস। ( History of Development of Yoga ) 



যোগ বলতে শাস্ত্রীয় যোগ প্রণালী বা তন্ত্রকে বোঝায় যা পতঞ্জলি যোগসূত্রের চতুর্থ দশা। পতঞ্জলি অষ্টাঙ্গযোগ পদ্ধতির উপদেশ দিয়েছিলেন ; সেখানে জোর দেওয়া হয়েছিল নৈতিক নিয়মানুবর্তিতা সহ অবিচ্ছেদ্য আধ্যাত্মিক বিকাশের ওপর। যোগের ইতিহাসে পবিত্র গ্রন্থে তার মৌখিক সঞ্চালন ও তার শিক্ষাগুলির গোপন প্রকৃতির কারণে অনেক জায়গায় দুর্বোধ্যতা ও অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল। গোড়ার দিকে অর্থাৎ প্রাচীনকালে যোগ সম্বন্ধে প্রতিলিপিগুলি লেখা হত ভঙ্গুর তালপাতার ওপর। যা সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত , ধ্বংস হত বা হারিয়ে যেত। যোগের বিকাশ পাঁচ হাজার বছরের বেশি আগে হয়েছিল। কিন্তু কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে , যোগ দশ হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো হতে পারে। 


যোগের উৎপত্তির ইতিহাস ও সিন্ধু - হরপ্পা সভ্যতার সম্পর্ক সংক্রান্ত তত্ত্ব :- 
কোনো কোনো ঐতিহাসিক যোগের উৎপত্তির পেছনে প্রাক বৈদিক সম্পর্কের সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের মতে , যোগের কিছু অবস্থা বা বৈশিষ্ট সিন্ধু সভ্যতার যুগে উৎপত্তি ঘটেছিল। পশুপতি সিলমোহর সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই সিলমোহরে একটি সাধারণ যোগ ব্যায়াম বা ধ্যানপ্রতিম অঙ্গবিক্ষেপ অবস্থানে মানবমূর্তির চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। 

প্রায় এক শতকেরও বেশি গবেষণা হয়েছে যোগের উৎপত্তির ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। মার্শাল , ইলিয়াড ও অন্যান্য গবেষকগণ এই বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছেন যে , সিন্ধু সভ্যতা এবং পরে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে যোগের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে। 


বৈদিক যুগ : যোগের উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস :- 
বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থের নাম বেদ। সংস্কৃত শব্দ ' Veda ' - এর অর্থ জ্ঞান এবং ' rig ' শব্দের অর্থ প্রশংসা। এইভাবে ঋগ্বেদ ( Rigveda ) স্তবগানের একটি সংগ্রহ যা উচ্চমাপের এবং প্রশংসাযোগ্য। ঋগ্বেদ সংহিতায় রয়েছে স্তুতি ও প্রার্থনামূলক মন্ত্র যা পদ্যে রচিত। এখানে 10,472 টি মন্ত্র রয়েছে। 

বৈদিক যুগে উচ্চতর অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য ধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞান বা ব্রম্মান্ড থেকে দৈববাণী আহরণ করা হত। এটি তিনটি যোগ অভ্যাস নিয়ে গঠিত। যথা - 
(ক ) মন্ত্রযোগ 
(খ ) প্রাণযোগ 
(গ ) ধ্যানযোগ। 

মন্ত্রযোগে মন্ত্রের শক্তির মাধ্যমে মনকে রূপান্তরের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রানযোগের মাধ্যমে প্রানশক্তি প্রবলভাবে সক্রিয় হয়। ধ্যানযোগের মাধ্যমে মনের উচ্চ এবং শ্বাশত সত্য হৃদয়ঙ্গম করার প্রচেষ্টা করা হয়। ধ্যানের পাঁচটি বৈশিষ্ট হল - একক চিন্তন , নিশ্চেষ্টতা বা অলসতা , মন্থরতা , অনিদ্রা এবং অনায়াস সম্প্রসারণ। মনের কোনো অবস্থা যেখানে এই পাঁচটি বৈশিষ্ট বর্তমান থাকে , তাকে ধ্যান বলা যেতে পারে। 


প্রাক শাস্ত্রীয় যুগ ও যোগের বিকাশ :- 
প্রাক শাস্ত্রীয় যুগে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যোগ গ্রন্থ হল ভগবদ্গীতা। ভগবদ্গীতা অনুসারে , যোগের তিনটি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পথ আছে , যা মহত্তমের সঙ্গে বা ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেয়। সেই তিনটি পথ হল - নিখুঁত কর্মের যোগ বা কর্মযোগ , নিখুঁত ভক্তির যোগ বা ভক্তিযোগ এবং নিখুঁত জ্ঞানের যোগ বা জ্ঞানযোগ। 

ভগবদ্গীতা 18 টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত। প্রতিটি অধ্যায়কে বলা হয় একটি যোগ। প্রতিটি অধ্যায়ের একটি অত্যন্ত বিশেষ চরম সত্য অর্জনের উপলব্ধির পথ যোগের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ভগবদ্গীতা মানব অস্তিত্বের উদ্দেশ্য , আত্মার অমরত্ব এবং ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের শাশ্বত বা চিরস্থায়ী সম্পর্কের ব্যাপারে নির্দিষ্ট জ্ঞান দেয়। এই জ্ঞান আমাদের প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য। 

শাস্ত্রীয় যুগ :- 
শাস্ত্রীয় যুগে প্রায় 200 খ্রিস্টপূর্বাব্দে পতঞ্জলি যোগসূত্র লিখেছিলেন , যেখানে 196 টি সূত্র আছে , যা আট অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বর্ণনা দ্বারা মানবজীবনের লক্ষ্য এবং জন্ম ও মৃত্যু দুর্দশার থেকে স্বাধীনতায় পৌঁছনো সম্ভব হয়। এটি ইচ্ছাশক্তির যোগ বা রাজযোগ বা অষ্টাঙ্গযোগ নামে পরিচিত। বুদ্ধ এই সময়কালের সমসাময়িক ছিলেন এবং তিনি আটটি পথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গের সন্ধান দেন। 

মানুষের মানবতা ও ধর্ম যখন সমাজজীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল , ঠিক সেই সময়ে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। গৌতম বুদ্ধের মাধ্যমে বিপাসনা প্রক্রিয়া পুনর্জাগরিত হয়। বিপাসনা হল প্রাচীন একটি ধ্যান কৌশল যা সংসারধর্মের অসাড়তাকে প্রমান করতে সহায়তা করে। 


মধ্যযুগে যোগ :- 
গৌতম বুদ্ধের পর মৎসেন্দ্রনাথ , গোরক্ষনাথ - প্রমুখ মহান যোগী হঠযোগের উপর আলোকপাত করেন। সেই সময়কালের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল - স্বামী আত্মারাম লিখিত '' হঠযোগ প্রদীপিকা '', 
'' ঘেরন্ড সংহিতা '' ; শ্রীনিবাস যোগী লিখিত '' হঠরত্নাবলী '' , '' শিবসংহিতা '' ; নিত্যনাথ লিখিত '' সিদ্ধ সিদ্ধান্ত পদ্ধতি '' ইত্যাদি। 

এছাড়া গুরু গোরক্ষনাথ , 9 টি নাথ ও 84 সিদ্ধের কথা বলেন - যা এমন একটি অবস্থা যা ব্যক্তিকে যোগীতে পরিণত করে। গুরু গোরক্ষনাথ রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল - গোরক্ষ সংহিতা , গোরক্ষ গীতা , যোগচিন্তামনি - ইত্যাদি। 

আধুনিককালে যোগ :- 
শ্রী অরবিন্দ দ্বারা সম্পূর্ণ যোগ বা পূর্ণযোগ যা ঐশ্বরিক বা দৈবশক্তির কাছে আত্মসমর্পনের উপর জোর দিয়েছিল। এরপর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভক্তিযোগ ও দৈব প্রেমের পথের জন্য সকলের কাছে পবিত্র দেবতুল্য মানুষ ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মতে , সকল ধর্মের মানুষ ঈশ্বরের বিস্ময়কর প্রকাশ। 

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ চারপ্রকার যোগের কথা বলেন। যথা - রাজযোগ , ভক্তিযোগ , জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ। তিনি এর মধ্যে একাধিক বা সবগুলিই অভ্যাস করার উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে , বেদান্ত হল ধর্মের সমগ্র। বিভিন্ন মতবাদ বা বিরোধী শক্তি বা ধর্মানুষ্ঠান বা বই বা মন্দির - ইত্যাদি হল গৌণ বিষয়।  স্বামী বিবেকানন্দ সকল প্রকার যোগের মাধ্যমে মানবজন্মের সর্বোত্তম লক্ষ্য আত্মোপলব্ধির বাণী প্রচার করেছিলেন।

    

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।

    

You May Also Like

0 comments