বৈদিক ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :-

by - July 14, 2021

বৈদিক ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :- 




১. শিক্ষার লক্ষ্য :- 
বৈদিক যুগে শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষা দর্শনের ভিত্তিতেই সে যুগে শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা গড়ে উঠেছিল। অজ্ঞানতাই বন্ধন ,জ্ঞানই মুক্তি - এই ছিল প্রাচীন ঋষিদের মত। তাই প্রাচীন ঋষিরা শিক্ষা বলতে বুঝিয়েছেন অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণ , বন্ধন থেকে মুক্তি। তাই তৎকালীন শিক্ষার প্রধান দার্শনিক ভিত্তি ছিল মনের সাহায্যে নিজের ও পরমাত্মার শক্তিকে আবিষ্কার করাই ছিল প্রকৃত শিক্ষা। 
বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার চরম লক্ষ্য ছিল আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি। জাগতিক বিষয়কে ঋষিরা  জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেন নি। তারা নিজেদের স্বরূপকে জানতে চেয়েছেন। পূর্ণতার মধ্যে দিয়েই এই স্বরূপকে জানা যায়। 
স্বামী বিবেকানন্দ তার শিক্ষার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন , মানুষের মধ্যেকার পূর্ণতার প্রকাশ হলো শিক্ষা। 


২. পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা :- 
বৈদিক শিক্ষায় আত্মার মুক্তি জীবনের চরম লক্ষ্য হলেও ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্পর্কে আর্য ঋষিরা উদাসীন ছিলেন না। তারা দু'প্রকারের শিক্ষার কথা বলেছেন - পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা। ব্রহ্মবিদ্যা বা অধ্যাত্মবিদ্যা হল পরাবিদ্যা আর যাবতীয় বিজ্ঞান , শিল্পকলা হল অপরাবিদ্যা। 

৩. আনুষ্ঠানিক বিদ্যারম্ভ :- 
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় তপবনে অবস্থিত গুরুগৃহই ছিল বিদ্যার্থীর পুণ্যতীর্থ। পাঁচ বছর বয়সে চূড়াকার্য বা চৌলকর্মের মধ্যে দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হত। ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য শিশু যথাক্রমে আট বছর , এগারো বছর এবং বারো বছর পর্যন্ত গৃহে পিতার তত্ত্বাবধানে শিক্ষা গ্রহণ করত। 
এরপর '' উপনয়ন '' এর মধ্যে দিয়ে আর্য শিশু বিদ্যাগ্রহণের উপযুক্ত হত। নবজন্ম হত তার। তাকে বলা হত দ্বিজ। দ্বিজ হলে সে গুরুর কাছে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করত। বর্ণভেদে উপনয়নের বয়স ও  সময়কাল নির্দিষ্ট ছিল। ব্রাহ্মণ সন্তানদের আট , ক্ষত্রিয়দের এগারো ও বৈশ্যদের বারো বছর বয়সে উপনয়ন হত। 


৪. বৈদিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান :- 
বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগের বিদ্যালয় ছিল গুরুকুল। গুরুর কাছে ছাত্ররা সমবেত হত। একজন গুরুকে কেন্দ্র করে একেকটি গুরুকুল গড়ে উঠত। সে যুগে গ্রন্থ ছিল না। গুরুই শিষ্যপরম্পরায় জ্ঞানের ভান্ডার সচল রাখতেন। পরা ও অপরাবিদ্যা অর্জন কিংবা চরিত্র গঠন - কোনোটিই গুরুর সান্নিধ্য ছাড়া সম্ভব ছিলনা।  গুরুকুল মাত্রই যে তা অরণ্যে অবস্থিত ছিল - তেমন নয়। 

৫. ব্রহ্মচর্য :- 
ব্রহ্মচর্য , গার্হস্থ্য , বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস - এই চারটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত ছিল চতুরাশ্রম। এর মধ্যে ব্রহ্মচর্য ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কাল। উপনয়নের পর তরুণ ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে প্রবেশ করত। সমগ্র শিক্ষাকাল গুরুগৃহে থাকতে হত। চিন্তায় ,বাক্যে ও কর্মে ব্রহ্মচারীকে সংযত জীবনযাপন করতে হত। কঠোরভাবে নিয়ম পালন করতে হত। নিয়ম পালনের দুটি দিক ছিল - শারীরিক ও আধ্যাত্বিক। এছাড়া তাকে গুরুগৃহে সমস্ত রকমের কাজ করতে হত। যেমন ভিক্ষা করা , গোধন রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও গুরুর গৃহের দৈনন্দিন কাজে শিষ্যকে অংশগ্রহণ করতে হত। শিষ্যদের সমস্ত রকম ইন্দ্রিয়সুখ থেকে বিরত থাকতে হত ,  সবরকম স্বাচ্ছন্দ্য  বর্জন করতে হত। সমস্ত শিক্ষার্থী ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষা করতে হত। 

৬. বাৎসরিক অধ্যায়নকাল :- 
প্রতি বছর চার মাস থেকে সাড়ে পাঁচ মাস বা ছয় মাস ধরে শিক্ষাকার্যক্রম চলত। শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন ''উপকর্ম ''  উৎসবের মধ্যে দিয়ে পাঠ শুরু হত এবং চলত পৌষ মাস বা মাঘ মাস পর্যন্ত। তারপর দীর্ঘ বিরতি। সাধারণত মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিন ''উৎসর্জন ''  অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বাৎসরিক অধ্যায়ন শেষ হত। 


৭. দীর্ঘ সময়ব্যাপী শিক্ষা :- 
বেদ শিক্ষার জন্য অত্যন্ত দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হত। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে , উপযুক্ত বয়সে গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সমস্ত বেদ পড়া শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ছিল না। 

৮. অবৈতনিক শিক্ষা :- 
প্রাচীন বৈদিক শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। বেতন নেওয়া ছিল অনৈতিক। দরিদ্রতম শিক্ষার্থীকেও গুরু  ফিরিয়ে দিতে পারতেন না। শিক্ষা শেষে অবশ্য স্নাতক গুরুদক্ষিণা দিতেন। এক্ষেত্রেও গুরুর অনুমতি নিয়ে সাধ্যমত দক্ষিণা দিতে হত। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন না নিয়েও যাতে আচার্য সুষ্ঠভাবে তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে পারেন , সমাজ সে ব্যবস্থা করেছিল। বিভিন্ন যাগযজ্ঞ , নানারকম অনুষ্ঠানে রাজা এবং বিত্তবানরা আচার্যদেব প্রচুর অর্থ প্রদান করতেন। এমনকি অনেক সময় গ্রাম দানও করা হত। 

৯. বর্ণভেদে পাঠক্রম নির্ধারণ :- 
ব্রাহ্মণ্য যুগের বর্ণভেদে শিক্ষার পাঠক্রম নির্দিষ্ট ছিল। যেমন ব্রাহ্মণদের জন্য বেদাঙ্গ , তর্কশাস্ত্র , ইতিহাস, পরা ও অপরাবিদ্যা , নক্ষত্রবিদ্যা , দেবজান প্রভৃতি বিদ্যাচর্চার উল্লেখ আছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী সাধারণভাবে বেদ পাঠ ও মৌলিক আচার পালনের জন্য যজ্ঞীয় আচরণ সম্পর্কে শিক্ষা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকত। 
ক্ষত্রিয়দের জন্য উপনয়নের পর গুরুগৃহে বেদপাঠ করতে হত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে ক্ষত্রিয়রা  বেদবিদ্যা পরিহার করতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সম্প্রদায় বেদ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ক্ষত্রিয়দেরকে প্রধানত তার জাতিগত বৃত্তি ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হতে হত। এছাড়া অর্থনীতি , রাজনীতি , সমাজনীতি , ইতিহাস - ইত্যাদি বিষয়ে ক্ষত্রিয়দের জ্ঞান প্রদান করা হত। 
বৈশ্যদের ক্ষেত্রে কৃষি ও বাণিজ্যিক বিষয় সম্পর্কিত বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করা হত। জ্ঞান অর্জনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল উৎপাদন ব্যবস্থা , অর্থনীতি , জমির গুনাগুন নির্ণয় , কৃষিবিদ্যা , পশুপালন - ইত্যাদি বিভিন্ন প্রথা বা বিষয়গুলি সম্পর্কে তাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হত। এছাড়া দ্রব্য সংরক্ষণের উপায় , ধাতুর মূল্য নির্ধারণ - ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হত। 


১০. মন্ত্রোচ্চারণ ও ব্যাখ্যা নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি :- 
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু কখনো ব্যক্তিগতভাবে আবার কখনো সমষ্টিগত ভাবে শিক্ষা প্রদান করতেন।  সমষ্টিগত ভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও গুরু প্রতিটি ছাত্রের সামর্থ্য বিচার করে শিক্ষা দিতেন। বৈদিক শিক্ষার পাঠ্যবস্তু ছিল মন্ত্র। সুতরাং স্বাভাবিক শিক্ষণ পদ্ধতি ছিল আবৃত্তি। গুরু দুটি কি তিনটি শব্দ উচ্চারণ করতেন। শিক্ষার্থীগণ গুরুর আবৃত্তির পর সমস্বরে আবৃত্তি করত। আবৃত্তির সাথে ব্যাখ্যার ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ ও শুদ্ধতার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হত। গুরু প্রতিটি শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। শ্রবণ , মনন ও নিদিধ্যাসন - এই তিনের দ্বারা শিক্ষার্থী জীবনের সত্য উপলব্ধি করত। 

১১. ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক :- 
প্রাচীন ভারতে বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র - শিক্ষক তথা গুরু - শিষ্য সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। শিষ্য গুরুকে দেবতার মত ভক্তি - শ্রদ্ধা করত এবং গুরু শিষ্যকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন। গুরু পক্ষপাতহীনভাবে , স্বগৃহে , বিনা বেতনে , অকুণ্ঠচিত্তে শিষ্যদের জ্ঞান দান করতেন। গুরু ছিলেন ধৈর্য , সহিষ্ণুতা ও জ্ঞানের প্রতিমূর্তি। 

১২. নিয়মানুবর্তিতা :- 
বৈদিক শিক্ষার আদর্শ ও পদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মানুবর্তিতার কোনো সমস্যা ছিল না। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল আত্মানুভূতি ও পরিপূর্ণতা। তাই শিক্ষার পরিবেশ ছিল শান্ত ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল একাগ্রতা। কাজেই বৈদিক যুগে শিক্ষা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল সমার্থক। 

১৩. মূল্যায়ন পদ্ধতি :- 
প্রাচীন শিক্ষায় পরীক্ষাব্যবস্থা ছিলনা। বিতর্কসভার মধ্যে দিয়েই পান্ডিত্যের পরীক্ষা হত। বৈদিক গ্রন্থে এই বিতর্ককে বলা হয় ব্রহ্মদয়। তপোবন , রাজ্যসভা ও যজ্ঞক্ষেত্রে বিতর্ক বা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হত।এর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানের মূল্যায়ন হত। 

১৪. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তি :- 
সমাবর্তন উৎসবের মধ্যে দিয়ে গুরুগৃহে বাসের সমাপ্তি পর্ব সুচিত হত। পাঠ শেষ করে শিক্ষার্থীগণ তাদের সাধ্যমতো গুরুদক্ষিণা দিয়ে , গুরুর সন্তুষ্টি বিধানের পর , গুরুর অনুমতি নিয়ে গৃহে ফিরে আসত।  স্নাতক ছিল তিন শ্রেণীর - 
(ক ) যিনি বেদ অধ্যয়ন করেছেন কিন্তু সমস্ত ব্রত পালন করেননি - তাকে বিদ্যা স্নাতক বলা হত। 
(খ )  যিনি সমস্ত ব্রত পালন করেছেন কিন্তু সমস্ত বেদ পাঠ করেন নি - তাকে বলা হত ব্রত স্নাতক। 
(গ )  যিনি সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন এবং সমস্ত ব্রত পালন করেছেন তাকে বলা হত বিদ্যাব্রত স্নাতক। 

সমাবর্তন উৎসব যথেষ্ট জাঁকজমকপূর্ণ হত। স্নান করে , নতুন বস্ত্র পরিধান করে , গলায় মালা পড়ে , রথে বা হাতিতে চড়ে শিক্ষার্থী সমাবেশে উপস্থিত হত। পন্ডিতদের কাছ গুরু তাকে স্নাতক বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। শিক্ষা শেষে সমাবর্তন উৎসবে ভবিষ্যৎ জীবনে চলার পথে পাথেয় হিসেবে যে উপদেশ গুরু শিষ্যকে প্রদান করতেন - তা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আচরণীয় ধর্ম বলে বিবেচিত হত।  

You May Also Like

0 comments