বৌদ্ধ শিক্ষার বৈশিষ্ট :-

by - July 14, 2021

বৌদ্ধ শিক্ষার বৈশিষ্ট :- 




১. শিক্ষার লক্ষ্য :- 
বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য ছিল জীবন ও জগৎ থেকে মুক্তি। কিন্তু এক্ষেত্রে বৈদিক ও বৌদ্ধদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। বৈদিক মতে , মুক্তি আসবে জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু বৌদ্ধ শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আদর্শ পরিনির্বাণ ; অর্থাৎ গার্হস্থ্যের এখানে কোনো গুরুত্বই নেই। সাধনা , নীতিজ্ঞান , নৈতিক জীবন যাপন , বন্ধনহীন সংঘ জীবনে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা ও সেবা ধর্মই ছিল শিক্ষার লক্ষ্য। মূলতঃ বাসনার অবলুপ্তিই ছিল শিক্ষার লক্ষ্য। 


২. আনুষ্ঠানিক শিক্ষারম্ভ :- 
বৌদ্ধ শিক্ষা শুরু হত '' প্রব্রজ্যা '' নামক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। বৌদ্ধ ধর্মে জাত বিচার না থাকায় যেকোনো বর্ণের ব্যক্তিই প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারত। তবে আট বছরের কম বয়সে পিতা - মাতার অনুমতি ছাড়া প্রব্রজ্যা গ্রহণ ও ভিক্ষুসঙ্ঘে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। প্রথম প্রবেশকারী তরুণ শিক্ষার্থীকে বলা হত '' শ্রমণ ''। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংঘে শ্রমণ হিসেবে বারো বছর কাটানোর পর উপযুক্ত বিবেচিত হলে শ্রমণকে '' উপসম্পদা '' দেওয়া হত। 


৩. পাঠক্রম - ধর্মশিক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সমন্বয় :- 
বৌদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ধর্ম ও তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেওয়া। প্রথম অবস্থায় বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রমে লৌকিক শিক্ষার কোনো স্থান ছিল না। ভিক্ষুদের জন্য সূত্র , ধর্ম ও বিনয় ছিল অবশ্যপাঠ্য। ব্যাকরণ , জ্যোতির্বিদ্যা - প্রভৃতিও ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুমাত্র ভিক্ষুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গৃহী শিক্ষার্থীরা ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার জন্য নির্ভর করতেন বিহারের ওপর। ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষার জন্য মঠের বাইরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা হত। ধর্মনিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষায় চিকিৎসা , আইন , শিল্পকলা - ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৌদ্ধ শিক্ষা সমৃদ্ধ ছিল। 
বিহারবাসী ভিক্ষুরাও বয়ন - প্রভৃতি হস্তশিল্প শিখতেন। চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও ব্যবহারিক শিক্ষার সমন্বয়ে সাত বছরের পাঠক্রম তৈরী হয়েছিল। চিকিৎসাবিদ্যার প্রথাগত কেন্দ্র ছিল - তক্ষশীলা , রাজগৃহ ও বারাণসী। 


৪. স্তরভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি :- 
পূর্ণ ভিক্ষুত্বের জন্য শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন স্তর পার করতে হত। শিক্ষা পদ্ধতি ছিল স্তর - অনুযায়ী। প্রথম পর্যায়ের পদ্ধতি ছিল আবৃত্তিমূলক , দ্বিতীয় পর্যায়ের পদ্ধতি ছিল আলোচনামূলক , তৃতীয় পর্যায়ে ছিল শিক্ষক শিক্ষণ। বৌদ্ধ শিক্ষার প্রসার ও শিখন পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল - এই শিক্ষা যতই জনগণের কাছে পৌঁছল ততই শিক্ষায় ভাষা সমস্যার সৃষ্টি হল। সকলে যাতে বৌদ্ধ ধর্মের বাণী ও অর্থ উপলব্ধি করতে পারে , সেজন্য বুদ্ধদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে বলেছিলেন। এই সময় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পালি ভাষা গুরুত্ব পায়। পরে পালি ও সংস্কৃত উভয় ভাষাই বৌদ্ধ শিক্ষায় গুরুত্ব লাভ করে। 

৫. গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক :- 
বৌদ্ধ বিহারে শিক্ষক ছিলেন দুই শ্রেণির। ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক ছিলেন উপাধ্যায়। নৈতিক জীবনের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন আচার্য বা কর্মাচার্য। উপাধ্যায় ও আচার্য উভয়ের সঙ্গে শ্রমণের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মত। শ্রমণ নানাভাবে গুরু সেবা করত। ব্রহ্ম মুহুর্তে শয্যা ত্যাগ করে , নিজ কর্ম সমাধা করে , গুরুর সেবার প্রস্তুতি শুরু করত এবং গুরুর বিভিন্ন কাজে তার সহযোগিতা করত। গুরুর অনুমতি ছাড়া কোনো উপহার গ্রহণ করতে পারত না। গুরু অসুস্থ হলে তার সেবা করা শিষ্যের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু এত আনুগত্য সত্ত্বেও কোনো কোনো কারণে গুরুকে ত্যাগ করা শিষ্যের পক্ষে অবৈধ ছিলনা। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বভাব চরিত্র ও আচরণের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হত।  গুরু সংঘের আদর্শ বিরোধী কাজ করলে তা সংঘের দৃষ্টিগোচরে আনা শিষ্যের দায়িত্ব ছিল। অপরদিকে গুরুও শ্রমণের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং তার সঠিক আচরণের প্রতি সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। 

৬. শিক্ষার সর্বজনীনতা :-
সংঘ বিদ্যালয়ে সব বর্ণের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। বিধিনিষেধ যে মোটেই ছিল না - তা নয়। বৌদ্ধ শিক্ষায় নৈতিক ও চারিত্রিক শুদ্ধতার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হত। এজন্য শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে কয়েকটি নিয়ম ছিল। নির্দিষ্ট বয়সসীমা পেরিয়ে গেলে সংঘে প্রবেশ করা যেত না। তাছাড়া , দুশ্চরিত্র ,  ব্যাধিগ্রস্থদের শিক্ষা লাভের অধিকার ছিলনা। রাজকার্যে নিযুক্ত ব্যক্তি , দেশ রক্ষার সৈনিক বা অপরাধীর শিক্ষালাভের অধিকার ছিল না। 


৭. বিহার জীবন :- 
বৌদ্ধ বিদ্যালয়গুলিকেই বৌদ্ধবিহার বলে। বিহারকে কেন্দ্র করেই বৌদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। বিহারের প্রশাসন ছিল গণতান্ত্রিক। নিয়মানুবর্তিতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ছিল বিহারের সফলতার অন্যতম কারণ। জ্ঞানার্জনের শিক্ষার পাশাপাশি বিহার জীবনে শিল্পকলা ও ব্যবহারিক শিক্ষার সুবন্দোবস্ত ছিল।  বিহারের মধ্যে বিতর্কসভা আয়োজিত হত। বিহার প্রধানদের নিয়ে বসত বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব ও জীবনদর্শন সম্পর্কে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা সভা।  ভিক্ষুর পোশাক , ভিক্ষা পাত্র - ইত্যাদি আটটি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য ছিল ভিক্ষুর নিজস্ব। 

৮. নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা :- 
নিয়মানুবর্তিতা ও কঠোর শাসন ছিল বিহারজীবনের অঙ্গ। ত্রিশরণ মন্ত্র জপ , অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ এবং দশটি শীল পালন করা ছিল বিহারবাসীদের জীবনদর্শন। ভিক্ষুদের আচরণে নিষেধগুলিকেই শীল  বলা হয়। এরকম দশটি শীলের উল্লেখ বৌদ্ধ দর্শনে আছে। কঠোর নিয়ম কানুনের বাধা বিহার জীবনে বিশৃঙ্খলার কোন প্রশ্ন ছিল না। 

৯. স্ত্রীশিক্ষা :- 
বৌদ্ধধর্মে জন্মগ্রহণকে দুঃখের কারণ বলা হয়েছে। যেহেতু নারীজাতি জন্মের মূল কারণ বলে বিবেচিত হত , তাই নারীদের শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হত। তাছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন কারণে বুদ্ধদেব স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন। তবুও তার প্রিয় শিষ্য আনন্দ ও পালকমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমীর  অনুরোধে নারীদের শিষ্যা করতে সম্মত হয়েছিলেন। সংঘে ভিক্ষুণীদের গ্রহণ করা হলেও ভিক্ষুদের প্রাধান্য মেনে চলতে হত। বহু নিষেধের মধ্যে থেকে তাদের পড়াশোনা করতে হত। ভিক্ষুণীদের জন্য মোট বারোটি টি নিষেধ ছিল। যেমন - একা ভ্রমণ না করা , নদী পার না হওয়া , পুরুষ অঙ্গ স্পর্শ না করা , পুরুষের সঙ্গে এক গৃহে বাস না করা ইত্যাদি। এত বাধা নিষেধ সত্ত্বেও বহু ধনী কন্যা ভিক্ষুণী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করত। বৌদ্ধ গ্রন্থে বিশাখা , শুভা , অনুপমা , সুমেধা - প্রমুখ উচ্চশ্রেণীর ভিক্ষুণীর উল্লেখ আছে।  উচ্চ দার্শনিক জ্ঞান সম্পন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের '' মেরা '' বলা হত। 

১০.  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান :- 
বৌদ্ধযুগের শিক্ষা ছিল মঠকেন্দ্রিক বা সঙ্ঘকেন্দ্রিক। যদিও আবাসিক বিহারগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষাদানের কাজও পরিচালনা করত। বৌদ্ধযুগের শিক্ষা ভারতবর্ষের বাইরের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করত। বৌদ্ধযুগের উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল -  নালন্দা , বিক্রমশীলা , বল্লভী, জগদ্দল , ওদন্তপুরী - প্রভৃতি। এগুলি প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হত। 

১১. মূল্যায়ন পদ্ধতি :- 
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় বিহার বা সংঘ জীবনের বারো বছর ব্যাপী আবাসিক শিক্ষা শেষ হত উপসম্পদা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। উপসম্পদা প্রদানের সময় শ্রমণকে ভিক্ষুদের সভায় উপস্থিত হয়ে নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দান করতে হত। ভিক্ষুদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করতে পারলেই শ্রমন উপসম্পদা উপাধি লাভ করতে পারত। উপসম্পদা ছিল চূড়ান্ত সন্ন্যাসের সূচনা পর্ব। 

 

You May Also Like

0 comments