প্রাণায়াম কাকে বলে ? প্রাণায়ামের বিভিন্ন নিয়মবিধিগুলি আলোচনা করো।
প্রাণায়াম কাকে বলে ? প্রাণায়ামের বিভিন্ন নিয়মবিধিগুলি আলোচনা করো।
প্রাণায়াম : ধারণা।
অষ্টাঙ্গযোগের চতুর্থ অঙ্গ হল প্রাণায়াম। প্রাণায়াম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পতঞ্জলি বলেছেন -
" তস্মিন সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতি বিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ ''
অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে যখন বিচ্ছেদ করে দেওয়া হয় , তখন তাকে প্রাণায়াম বলা হয়। বিচ্ছেদ মানে নিয়ন্ত্রণ করা। শ্বাস ও প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করাকেই প্রাণায়াম বলা হয়। এখানে মনে রাখতে হবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে বাতাস ভিতর আসছে আর বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে ; প্রাণের ক্ষেত্রে এগুলির খুব একটা গুরুত্ব নেই ; গুরুত্ব হল আমাদের শরীরে যে প্রাণন ক্রিয়া বা প্রাণের যে গতি চলছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল আয়ত্ত করা।
প্রাণ হলো মহাজাগতিক শক্তি ; প্রাণের মুখ্য দ্বার হল নাসিকা। নাসিকা ছিদ্র দ্বারা আসা-যাওয়া করতে থাকা শ্বাস - প্রশ্বাস হচ্ছে জীবন এবং প্রাণায়ামের আধারস্বরূপ। শ্বাস-প্রশ্বাসরুপী রজ্জুর আশ্রয় নিয়ে এই মন দেহগত অভ্যন্তরীণ জগতে প্রবিষ্ট করে সাধককে সেখানকার দিব্যতা অনুভব করাবে , এই উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাণায়াম বিধির আবিষ্কার করেছিলেন ভারতের প্রাচীন মুনি - ঋষিরা।
প্রাণায়ামের নিয়মবিধি :-
১. প্রাণায়াম শুদ্ধ সাত্বিক নির্মল স্থানে করা উচিত। যদি সম্ভব হয় তবে , জলের কাছে বসে অভ্যাস করা ভালো।
২. শহরে যেখানে দূষণের প্রভাব বেশি , সেখানে প্রাণায়াম করার আগে ঘি এবং গুলগুল দ্বারা সে স্থানটিকে সুগন্ধিত করতে হবে। আর তা না হলে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালাতে হবে।
৩. প্রাণায়াম এর জন্য সিদ্ধাসন , বজ্রাসন , পদ্মাসনে বসাই উপযুক্ত। তবে বসার জন্য যে আসন ব্যবহৃত হবে , সেটা যেন বিদ্যুতের কু - চালক হয়। যেমন - কম্বল বা কুশাসন ইত্যাদি।
৪. শ্বাস সবসময় নাক দিয়েই নেওয়া উচিত। এতে শ্বাস ফিল্টার হয়ে ভিতরে ঢুকবে।
৫. যোগাসনের মত প্রাণায়াম করার জন্য কমপক্ষে 4 - 5 ঘন্টা আগে ভোজন করা উচিত। প্রাতঃকালে শৌচাদির পর যোগাসন করার আগে যদি প্রাণায়াম করা যায় , তবে সেটা সর্বোত্তম হয়। শুরুতে 5 - 10 মিনিট অভ্যাস এবং ধীরে ধীরে সময় বাড়িয়ে এক ঘন্টা পর্যন্ত করা যেতে পারে। প্রাণায়াম সর্বদা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যাতেই করা উচিত , কম বা বেশি না করাই ভালো।
৬. প্রাণায়াম করার সময় মন শান্ত ও প্রসন্ন থাকা উচিত। এমনিতে প্রাণায়াম দ্বারাও মন শান্ত , প্রসন্ন এবং একাগ্র হয়ে ওঠে।
৭. প্রাণায়াম করার সময় যদি ক্লান্তি অনুভব হয় , তবে পরের প্রাণায়াম শুরু করার আগে ৫ - ৬ বার স্বাভাবিক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিশ্রাম করে নেওয়া উচিত।
৮. প্রাণায়ামকে নিজের নিজের প্রকৃতি এবং ঋতু অনুযায়ী করা উচিত। কিছু প্রাণায়াম দ্বারা শরীরের গরমভাব বেড়ে ওঠে , আবার কিছু প্রাণায়ামে ঠান্ডাভাব কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
৯. গর্ভবতী মহিলা , ক্ষুধার্ত ব্যক্তি , জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাণায়াম করা উচিত নয়। রোগী ব্যক্তিদের প্রাণায়ামের সঙ্গে দেওয়া সর্তকতাগুলিকে মাথায় রেখে প্রাণায়াম করা উচিত।
১০. প্রাণায়ামের দীর্ঘ অভ্যাসের জন্য পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করা উচিত। ভোজন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। দুধ , ঘি এবং ফলের সেবন লাভকারী হয়।
১১. প্রাণায়ামে শ্বাসকে জোর করে আটকে রাখা উচিত নয়। প্রাণায়াম করার জন্য শ্বাসকে শরীরের ভিতরে নেওয়াকে ' পূরক ' , শ্বাসকে শরীরের ভিতরে আটকে রাখাকে ' কুম্ভক ' এবং শ্বাসকে বাইরে ছাড়াকে ' রেচক ' ও শ্বাসকে বাইরেই আঁটকে রাখাকে 'বাহ্যকুম্ভক' বলে।
১২. প্রাণায়ামের অর্থ কেবলমাত্র পূরক ,কুম্ভক এবং রেচকই নয় ; বরং এটি শ্বাস এবং প্রাণের গতিকে নিয়ন্ত্রিত করে ও মনকে স্থির এবং একাগ্র করার অভ্যাসও বটে।
১৩. প্রাণায়ামের আগে বেশ কয়েকবার 'ওঁম' শব্দে লম্বা উচ্চারণ করা উচিত। এতে মন শান্ত হয়।
১৪. প্রাণায়াম করার সময় চোখ , মুখ , নাক ইত্যাদি অঙ্গের উপর কোনো প্রকারের টেনশন না এনে সহজ অবস্থায় রাখা উচিত। প্রাণায়াম অভ্যাস করার সময় গলা , মেরুদন্ড , কটি , বক্ষ - সবসময় সোজা রাখা উচিত।
১৫. প্রাণায়ামের অভ্যাস ধীরে ধীরে , কোনরকম উতলা ভাব ছাড়া , ধৈর্যসহকারে , সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত।
১৬. স্নানের পর ধ্যান - উপাসনার আগে প্রাণায়াম করা উচিত। প্রাণায়াম করার পনেরো-কুড়ি মিনিট পরেও স্নান করা যেতে পারে। বই পড়ে কখনো নিজে নিজে প্রাণায়াম অভ্যাস করা উচিত নয়। অভিজ্ঞ আচার্যের অধীনে প্রাণায়াম করা উচিত।
0 comments