মূল্যায়নের সংজ্ঞা , বৈশিষ্ট , গুরুত্ব।

by - June 18, 2021

মূল্যায়নের সংজ্ঞা দাও। মূল্যায়নের বৈশিষ্টগুলি লেখ। মূল্যায়নের বিভিন্ন কৌশলগুলি কী কী ? মূল্যায়নের গুরুত্ব আলোচনা করো। 



এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


মূল্যায়ন - এর সংজ্ঞা :- ( Definition of Evaluation )  


মূল্যায়ন শব্দটির সাধারণ অর্থ হল '' মূল্য আরোপ করার কাজ '' । এই মূল্যায়ন শব্দটি শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত হয়ে এসেছে শিক্ষাগত মূল্যায়ন শব্দটি। আভিধানিক অর্থে তাই শিক্ষাগত মূল্যায়ন হল শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অতীত আচরণের প্রেক্ষাপটে , বর্তমানে সম্পাদিত আচরণের সাপেক্ষে ভবিষ্যৎ আচরণ সম্পাদনা সম্বন্ধে মূল্য আরোপ প্রক্রিয়া। 

আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান দার্শনিক , মনোবিজ্ঞানগত , বৈজ্ঞানিক , সামাজিক , নৈতিক ও প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্তের সমন্বয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাগত মূল্যায়ন তাই এখানে শিশুর সামাজিক বিকাশ পরিমাপক একটি প্রচেষ্টা বা উপায়। অতএব , শিক্ষাগত মূল্যায়ন এমন একটি জটিল প্রক্রিয়া যার সাহায্যে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন আচরণের উপর সামগ্রিক প্রভাব আরোপ করা যায় এবং যা সমাজ , ব্যক্তি বা উভয়ের বিচারে  গ্রহণীয়। 

শিক্ষার্থীর বহুমুখী পরিবর্তনের ধারাকে সামগ্রিকভাবে পরিমাপ করতে হলে পরিমাপের যান্ত্রিক কৌশল ও তাত্ত্বিক ভিত্তিকে সামগ্রিক গুণসম্পন্ন করে শিক্ষার লক্ষ্য পূরণের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য মূল্যায়নের ধারণা  ও কৌশলকে গ্রহণ করা হয়েছে।  তাই Wesley বলেছেন , '' Evaluation is a total and final estimate .''

শিক্ষা প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাবিদগণ শিক্ষাগত মূল্যায়নের সংজ্ঞায় বলেছেন , যে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রক্রিয়ায় কোন একটি স্তরের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার লক্ষ্য পূরণের পথে কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে , তা বিচার করা হয় এবং পারদর্শিতা নির্ণয় করা হয় - তাকে বলা হয় শিক্ষাগত মূল্যায়ন। এই মূল্যায়ন দ্বারা শিক্ষার্থীর আচরণের গুণগত ও পরিমাণগত মূল্যমান বিচার করা হয় এবং নির্ণয় করা হয়। 

শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্যে মূল্যায়নকে অন্তর্ভুক্ত করে বলা যায় যে , শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি বিচারের জন্য বা মান নির্ণয়ের জন্য বা তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য যে কৌশল প্রয়োগ করা হয় তাকে বলা হয় মূল্যায়ন। তাই ব্যাপক অর্থে Quillen ও  Hanna - র সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে আমরা পাই - 
(ক ) শিশুর আচরণের সামগ্রিক বিচার-বিবেচনার মান নির্ধারণকারী কৌশল হলো মূল্যায়ন। 
(খ ) শিক্ষার্থীর ক্রমিক পরিবর্তনশীল বিকাশ নির্ণয়ের কৌশল হল মূল্যায়ন। 
(গ ) শিক্ষণ ও শিখন - এর গতি নির্ণায়ক ব্যবস্থা হল মূল্যায়ন। 
(ঘ ) শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার মূল্যায়ন - এর গুণগত ও পরিমাণগত পরিমাপ হল মূল্যায়ন কৌশল। 
(ঙ ) শিক্ষার্থীর সমগ্র ব্যক্তিত্ব বিকাশকারী ও প্রকাশকারী ব্যবস্থাপনা হল মূল্যায়ন। 
(চ ) শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ প্রচেষ্টা রচনাকারী ব্যবস্থা হল মূল্যায়ন। 

মুদালিয়র কমিশনের মতে , পুঁথিগত পারদর্শিতা নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক্রম বহির্ভূত দিকগুলোতে শিক্ষার্থীর মনোভাব , আগ্রহ , চিন্তাদর্শ , স্বাস্থ্য ও কাজের অভ্যাস এবং সামাজিক অভিযোজন ক্ষমতা পরিমাপক ব্যবস্থা হল মূল্যায়ন। 


মূল্যায়নের বৈশিষ্ট্য : - ( Characteristics of Evaluation ) 


' শিক্ষা ' একটি কাজ বা প্রক্রিয়া। প্রতিটি কাজের বা প্রক্রিয়ার যেমন মূল্যায়ন প্রয়োজন , তেমনি শিক্ষা প্রক্রিয়াতেও মূল্যায়ন অপরিহার্য। শিক্ষায় এই মূল্যায়নের বৈশিষ্ট্য গুলি হল - 

১. মূল্যায়ন শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে মূল্যায়ন গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করে। 

২. শিখন-শিক্ষণ পরিচালিত হয় পাঠ একক অনুসারে। তাই মূল্যায়ন শিক্ষাক্রমের পাঠভিত্তিক। 

৩. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর শিখন ও শিক্ষকের পাঠ পরিচালনায় সহায়ককারী মুখ্য প্রক্রিয়া হল মূল্যায়ন। 

৪. মূল্যায়ন গঠনমূলক। শিক্ষার্থীর শিখনকে যথার্থ করে। 

৫. মূল্যায়ন সংশোধনাত্মক প্রক্রিয়া , যার দ্বারা শিক্ষার্থীর কাম্য সামর্থ্য অর্জিত হয় এবং কৃতিত্ব বা পারদর্শিতা অর্জন করে। 

৬. মূল্যায়ন লক্ষ্যভিত্তিক। শিক্ষার বহুমুখী লক্ষ্য সাপেক্ষে মূল্যায়ন পরিচালিত হয় বলে মূল্যায়ন সর্বদা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখী হয়। 

৭. মূল্যায়ন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বাস্তবায়িত হয়। শিক্ষার্থীর একই আচরণকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা সাপেক্ষে মূল্যায়নকেও ভিন্ন ভিন্ন ভাবে করা হয়। 

৮. মূল্যায়ন সর্বদা শিক্ষার লক্ষ্য ও শিক্ষার্থীর শিখনলব্ধ অভিজ্ঞতার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অগ্রসর হয়। 

৯. মূল্যায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীর কোনো আচরণকে তার বিভিন্ন দিকের তাৎপর্য বিচার-বিশ্লেষণ দ্বারা বিচার করা হয় এবং এই বিচার সাপেক্ষে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার মূল্যায়ন নির্ধারিত হয় বলে মূল্যায়ন একটি জটিল কিন্তু সামগ্রিক মূল্য আরোপের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ , মূল্যায়ন শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ভিত্তিক প্রক্রিয়া। 

১০. মূল্যায়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কারণ মূল্যায়ন শিক্ষার্থীকে তার বিভিন্ন শিক্ষাক্রমের মধ্যে দিয়ে সর্বাঙ্গীণ বিকাশের স্তরে বা তার ইন্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। 

১১. মূল্যায়ন শিক্ষার্থীকে আত্মশিক্ষনে উৎসাহিত করে। শিক্ষার্থী যথার্থ মূল্যায়নে নিজের যোগ্যতা যেমন নির্ণয় করতে পারে তেমনি নিজের শিক্ষা নির্ধারিত পথে অগ্রসর হতে পারে। 

১২. মূল্যায়ন শিক্ষার্থীর দুর্বলতা নির্ণায়ক। 

১৩. মূল্যায়ন পারদর্শীতাকে জন্মগত ও পরিমাণগতভাবে প্রকাশ করে। 


মূল্যায়নের বিভিন্ন কৌশল :- ( Method of Evaluation ) 


শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিক্ষন সাপেক্ষে শিখনকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে হলে বহুমুখী তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। কোন বিষয়ে উপায় অবলম্বন করে একক প্রচেষ্টা দ্বারা শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন সম্ভব নয়।  শিক্ষণ দ্বারা শিক্ষার্থীর নানাবিধ আচরণগত পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনসমূহ মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়। কখনও একটি আচরণগত পরিবর্তন পরিমাপ করতে একাধিক কৌশলও  ব্যবহার করতে হয়। 

শিক্ষণ-শিখন সাপেক্ষে যেসকল মূল্যায়ন কৌশল প্রয়োগ করা হয় , সেগুলি হল - 
১. পরীক্ষা ( Examination ) 
২. অভীক্ষা ( Test ) 
৩. তথ্য সংগ্রহ ( Data Collection ) 
৪. পর্যবেক্ষণ ( Observation ) 
৫. সাক্ষাৎকার ( Interview ) 
৬. গৃহ পরিদর্শন।  

মূল্যায়নের গুরুত্ব :-  ( Significance of Evaluation ) 


শিক্ষার ধারাবাহিক পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার পথে একজন শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে বর্ধিত ও বিকশিত হয়। এই শিক্ষা প্রক্রিয়াকে আদর্শ এবং শিক্ষার্থীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে কার্যকরী করে তোলে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হলেও এর গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বহুমুখী। 

১. শিক্ষার ধারা ঘটমান পরিবর্তনকে যথার্থভাবে বিচার করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়ন। 

২. আজকের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশের সঙ্গে সমন্বয় দ্বারা শিক্ষার্থীরা অকারণ পরিবর্তনকে বিচার করে মূল্যায়ন। 

৩. আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্যাভিমুখী মূল্যায়ন ব্যবস্থাও পরিবর্তিত পরিবর্ধিত। 

৪. শিক্ষার্থীর বহুমুখী আচরণধারার প্রকৃত তাৎপর্য বিচারকরণের জন্য প্রয়োজন হয় মূল্যায়ন। 

৫. মূল্যায়ন শ্রেণি শিক্ষনে বিভিন্নতা নিয়ে আসে। 

৬. মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত পাঠক্রমেও যথার্থতা নির্ধারণ করে। 

৭. শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কর্মসূচির নির্ধারক হলো মূল্যায়ন। 

৮. শিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ ও দক্ষতার যথার্থতা নির্ধারণ করে মূল্যায়ন। 

৯. মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষা প্রশাসকের দক্ষতা নির্ণয়ে সহায়তা করে। আবার শিক্ষা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনারও উপযুক্ততা নির্ণয় করে মূল্যায়ন। 

১০. পশ্চাৎপদ শিক্ষার্থীদের যথার্থ শিক্ষার ব্যবস্থাপনা করতে সহায়তা করে মূল্যায়ন। 

১১. মূল্যায়ন শিক্ষার্থীকে উন্নততর শিখনের সহায়ক। 

১২. মূল্যায়ন বহুমুখী শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে থাকে।  

১৩. শিক্ষক / শিক্ষিকা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখনের জন্য যে পদ্ধতি ও কৌশলগুলি ব্যবহার করছেন তার যথার্থতা নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন মূল্যায়ন। 

You May Also Like

0 comments