শিক্ষন কৌশলের মূল বৈশিষ্ট ও শিক্ষন কৌশল নির্মাণের নীতিসমূহ।
শিক্ষন কৌশল কাকে বলে ? শিক্ষন কৌশলের মূল বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করো। শিক্ষন কৌশল নির্মাণের নীতিসমূহ আলোচনা করো।
শিক্ষন কৌশলের ধারণা :-
কৌশলের ইংরেজি প্রতিশব্দ Strategy যা যুদ্ধ বা সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বর্তমানে কৌশল শব্দটিকে শিক্ষাবিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিকগণ সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। বিশেষ করে শ্রেণি শিক্ষনের ক্ষেত্রে কৌশল শব্দটির ব্যবহার চোখে পড়ার মত।
বি.ও. স্মিথ এর মতে , শিক্ষন কৌশল হল শিক্ষন ক্রিয়ার একটি ধাঁচ বা শৈলী যা শিক্ষনের নির্দিষ্ট ফলশ্রুতি লাভে সহায়তা করে। উদ্দেশ্যগতভাবে নির্ধারিত ও গৃহীত কর্মপরিকল্পনা হল শিক্ষন কৌশল।
শিখন অভিজ্ঞতা সরবরাহ এবং শিক্ষক - শিক্ষার্থী ক্রিয়াকলাপের সংগঠনের জন্য যথাযথ কৌশল নির্বাচন পাঠক্রমের বিষয়বস্তুর কার্যকরী ও পাঠক্রমের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করে।
শিক্ষন কৌশলের মূল বৈশিষ্টসমূহ :-
১. শিক্ষন কৌশলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো একজনের মধ্যে যে ধরনের কর্মক্ষমতা আছে তার সর্বোচ্চ কার্যকারিতাকে সুনিশ্চিত করা এবং কর্ম সম্পাদনের সদিচ্ছার বিকাশ ঘটানো।
২. শিক্ষণ কৌশলগুলি অবশ্যই স্বচ্ছভাবে চিন্তাভাবনা করার সক্ষমতা বিকাশ ঘটাবে।
৩. এটি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের পরিধির বিস্তার ঘটাবে।
৪. শৃঙ্খলা ও সহযোগিতার নীতিকে বজায় রেখে শিক্ষণ কৌশলগুলি স্বাধীনভাবে গৃহীত বিভিন্ন কার্যাবলীতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে নানা রকম সুযোগ তৈরি করবে।
৫. শিক্ষণ কৌশলগুলি শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার বাঞ্ছনীয় সুযোগ সৃষ্টি করবে।
৬. শিক্ষন কৌশলগুলি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সহায়ক পত্রপত্রিকা কীভাবে পাঠের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয় সেই বিষয়ে শিক্ষা দেবে।
৭. শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিমত্তার স্তরের পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলগুলি গৃহীত হবে।
৮. শিক্ষণ কৌশল গুলি অবশ্যই ব্যক্তিগত কার্যকলাপের সঙ্গে দলগত সহযোগিতামূলক কার্যকলাপের ভারসাম্য বজায় রাখবে।
শিক্ষণ কৌশল নির্মাণের নীতিসমূহ :-
১. নির্বাচনের নীতি :-
শিক্ষণ-শিখন পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য যেসব উপাদানের উপর শিক্ষন কৌশল নির্ভর করে সেগুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। এগুলি হলো - শিক্ষার্থীর সক্ষমতা , বিভিন্ন সম্পদের প্রাপ্তির সুবিধা , প্রারম্ভিক পর্যায়ে আচরণ , প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের উপস্থিতি , শিক্ষকের প্রস্তুতির গুণগতমান , যে সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি অর্জন করতে হবে এবং পাঠক্রমের বিষয়বস্তুর প্রকৃতি ইত্যাদি।
২. প্রেষণার নীতি :-
শিক্ষনের ভিত্তি হলো প্রেষণা। সেই কারণে শিক্ষককে সমস্ত বিচার-বিবেচনা মাধ্যমেই কৌশল নির্বাচন করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের ধনাত্মক উৎসাহবর্ধক , যেমন - প্রশংসা , পুরস্কার এর অধিক প্রয়োগ করতে হবে। কারণ এগুলি শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে প্রেষণা জোগায়। আবার নেতিবাচক উৎসাহবর্ধক , যেমন - শাস্তি , তিরস্কার ইত্যাদি প্রেষণা জাগরণে অনেক বিলম্ব ঘটায়। এগুলি প্রয়োগে অনেক সময় শিক্ষার্থীর শিখন আগ্রহ হ্রাস পেতে থাকে।
৩. শিক্ষনের মূল সূত্রের নীতি :-
একজন শিক্ষক শিক্ষনের ক্ষেত্রে যখন যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি গ্রহণ করবেন তখন তিনি অবশ্যই শিক্ষনের মূল সূত্রগুলি ব্যবহার ও অনুসরণ করবেন। এগুলি হল সরল থেকে জটিলের দিকে , সহজ থেকে কঠিনের দিকে , জানা থেকে অজানার দিকে , সমগ্র থেকে অংশের দিকে , মূর্ত থেকে বিমূর্তের দিকে ও নির্দিষ্ট থেকে সাধারণের দিকে।
৪. বৈচিত্রের নীতি :-
শিক্ষন শিখন কৌশলগুলি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলি নানা রকমের ক্রিয়া-কলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে। যেমন পর্যবেক্ষণ , বিভিন্ন বিষয় ও তথ্যাদি সংগ্রহ , খেলাভিত্তিক ক্রিয়া-কলাপ , শিক্ষামূলক খেলা , শিক্ষামূলক ভ্রমণ , নাটক মঞ্চস্থকরণ ও ভূমিকাভিনয় , আরোহী - অবরোহী শিক্ষণ , সমস্যা সমাধান মূলক শিক্ষন ইত্যাদি।
৫.পরিবেশের সঙ্গে অনুবন্ধ নীতি :-
শিখনকে সুদৃঢ় ও অর্থবহ করে তোলার জন্য বিদ্যালয়ের চারপাশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে শিক্ষনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচনা করা উচিত। শিক্ষক এক্ষেত্রে এই সমস্ত পরিবেশগত উপাদানগুলির সঙ্গে পাঠক্রমের বিষয়বস্তুর একটি অনুবন্ধ নির্মাণ করবেন। যেমন পৌরবিজ্ঞান শিক্ষনের ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন পৌরসভা , পঞ্চায়েত ইত্যাদি পরিদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন অভিজ্ঞতাগুলিকে আরো সজীব ও সুদৃঢ় করে তুলতে পারেন।
৬. প্রতিক্রিয়ার নীতি :-
প্রত্যহ ফিডব্যাক গ্রহণ বা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া শিক্ষণ শিখন প্রক্রিয়ার একটি অত্যাবশ্যকীয় কৌশল। একটি ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ফিডব্যাক প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে , যার মাধ্যমে শিক্ষন প্রক্রিয়ার শক্তি ও দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে সহজে অবগত হওয়া সম্ভব।
৭. ব্যক্তিগত পার্থক্যের নীতি :-
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে মনোযোগ দানের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থা করা শিক্ষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। উন্নত বুদ্ধির অর্থাৎ মেধাসম্পন্ন শিশুদের জন্য তাদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষণ দান এবং স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুদের জন্য সংস্কারমূলক শিক্ষনের ব্যবস্থা করা শিক্ষনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তথা কৌশল।
৮. শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের নীতি :-
শিক্ষন কৌশলগুলি নির্মাণের সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে , সেগুলি শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের পক্ষে সহায়ক কিনা। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীও বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এগুলি বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকলাপের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যেমন - বিদ্যালয়ে সম্মেলনের কার্যক্রম , বিদ্যালয় পরিবেশের সৌন্দর্য বর্ধন করা , সৃজনাত্মক কার্যাবলী , বিশেষ বিশেষ দিবস উদযাপন , জাতীয় দিবস পালন - ইত্যাদি। এই ধরনের কৌশল নির্মাণ শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী।
0 comments