Relation between Education and Sociology

by - May 24, 2021

শিক্ষা ও সমাজতত্ত্বের সম্পর্ক :-  


সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য শিক্ষা বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাদানের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে এবং আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী ও সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এক উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।বস্তুত সমাজ জীবনের পরিবর্তন , পরিবর্ধন রূপান্তরের সাথে সার্থক অভিযোজন প্রক্রিয়ায় শিক্ষা ছাড়া ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের প্রগতিই অসম্ভব। 


শিক্ষায় ব্যক্তি , সমাজ ও সমাজবিজ্ঞান :- 
ব্যক্তির সার্থক অভিযোজন দক্ষতা জীববিদ্যার ফল হলেও সামাজিক সম্পর্কের নীতিগুলোর অবমাননার মাধ্যমে সেই অভিযোজন দক্ষতাকে সমাজ উপযোগী করা যায় না। তাই শিক্ষায় সামাজিক সম্পর্কের অনুশীলনকারী বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন নীতিগুলি মূল্যবান প্রভাবকে কখনোই অবহেলা করা সঙ্গত নয়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া এবং পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করায় শিক্ষার সাথে এর এক নিবিড় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। 
শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক পটভূমিকায় শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনকে চরম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষার বিভিন্ন উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ককে অর্থপূর্ণ ও মূল্যবান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 

শিক্ষার সমন্বিত রূপ এবং সমাজবিজ্ঞান :-
আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার যুগে শিক্ষাক্ষেত্রে সকল রকম পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারার সমন্বয়সাধনকে বাস্তবে মূর্ত করে তোলা হয়েছে। এই বিংশ শতাব্দীর সমন্বয়ধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থায় মনোবিদ্যা , জীববিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের মত সমাজবিজ্ঞানের অবদানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন যুগধর্মের প্রভাবে মানুষের চিন্তার রাজ্যে পরিবর্তন এলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও যে পরিবর্তন ঘটে তা অনস্বীকার্য এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন শিক্ষার সীমানায় সমানভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। 
অনুরূপে বিংশ শতাব্দীর পরস্পরবিরোধী চিন্তার সংঘাত শিক্ষাক্ষেত্রে যে সংঘাতএনেছে তারই পরিণতিতে এসেছে সমন্বয়ধর্মী শিক্ষার রূপ এবং এই শিক্ষার রূপে অন্যান্য সমাজ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞানের মতো সামাজিক সম্পর্কের অনুশীলনকারী সমাজ বিজ্ঞানের অবদানও কম নয়। 


শিক্ষার অর্থ , তাৎপর্য এবং সমাজ :- 
শিক্ষার বিভিন্ন দিকে সমাজবিজ্ঞানের প্রভাবকে আরো স্পষ্টভাবে নির্ণয় করতে পারলে শিক্ষার সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আমরা বর্তমানে শিক্ষা বলতে বয়স্ক ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী শিক্ষার্থীর উপর জ্ঞানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়াকে বুঝি না। আধুনিক অর্থে মানুষ জীবনব্যাপী প্রক্রিয়ায় মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তাই হলো শিক্ষা। 
এই অভিজ্ঞতা লাভের আধুনিক শিক্ষায় মানুষ কখনোই পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের রীতিনীতিকে অবহেলা করতে পারে না। আর এখানেই শিক্ষা হচ্ছে এক সামাজিক প্রক্রিয়া এবং সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যুক্ত এক বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত্তিতেই শিক্ষা সমাজ সংরক্ষণের কাজ করে , সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশের যুগান্তরে পরিবাহনের কাজ করে এবং সমাজ প্রগতির উল্লেখযোগ্য উপায় হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত রাখে। সুতরাং আধুনিক শিক্ষার অর্থ ও তাৎপর্য সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্বের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। 

শিক্ষার লক্ষ্য ও সমাজবিজ্ঞান :- 
শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণেও সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাব সুস্পষ্ট। খুব সংক্ষেপে আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে , শিক্ষাকে ব্যক্তিত্বমন্ডিত এবং শিক্ষার্থীকে সমাজমন্ডিত করে তোলা। আধুনিক শিক্ষার এই লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের চাহিদাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার লক্ষ্যের এক সুসংহত ও সমন্বিত রূপ। 
যে সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষার এই সমন্বয় সম্ভব শিক্ষাবিদ ডিউই এর ভাষায় তাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এই সমাজ ব্যবস্থায় যে বিশেষ ধরনের শিক্ষা প্রবর্তিত হয় তা প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সকল সমাজ সম্পর্ক ও সমাজ নিয়ন্ত্রণের নিজস্ব আগ্রহবোধ বিকাশে সহায়তা করে এবং প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা প্রদান করে। মুদালিয়র কমিশনে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন স্পষ্ট। 

পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞান :- 
কেবল শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য নয় , আধুনিক শিক্ষার পাঠক্রম রচনাতেও সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাব সমানভাবে সুস্পষ্ট।  এই পাঠক্রম রচনার নীতি গুলিতে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন এত প্রকট যে , আধুনিক শিক্ষার পাঠক্রম রচনায় পাঠক্রমকে কেবল বিষয়ের সমষ্টি হিসাবে দেখা হয় না -  দেখা হয় বিদ্যালয় প্রদত্ত সকল রকম অভিজ্ঞতার সমষ্টি হিসেবে। এখানে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত চাহিদা ও তার বিভিন্ন সামাজিক চাহিদার সমন্বিত রূপকে লক্ষ্য করা যায় ,
বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠক্রমকে এমন ভাবে রচনা করা হচ্ছে যাতে তার পশ্চাতে দুটি উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে - একটি উপাদান হলো শিশুর স্বভাব বা স্বাভাবিক আগ্রহ এবং অপর উপাদানটি হল সামাজিক প্রয়োজনীয়তা। আর পাঠক্রম রচনার কাজে সামাজিক চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়ার মূলে রয়েছে সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাব। সুতরাং আধুনিক শিক্ষার পাঠক্রম পরিকল্পনা সমাজবিজ্ঞানের নীতি ও তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। 

শিক্ষণপদ্ধতি ও সমাজবিজ্ঞান :- 
পাঠক্রম পরিকল্পনায় সমাজবিজ্ঞানের প্রভাব যেমন গুরুত্বপূর্ণ ; আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির সামাজবিজ্ঞানের প্রভাব তেমনি উপেক্ষা করা যায় না। বর্তমানে শিক্ষাপদ্ধতির মূল কথা হচ্ছে শিক্ষার্থী আত্মসক্রিয়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে অভিজ্ঞতা গ্রহণে সহায়তা করা। এই আত্মসক্রিয়তার নীতির পরিপূরক হিসাবেই বর্তমানে শিক্ষায় কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার নীতি কে গ্রহণ করা হয়েছে। এমন শিক্ষাপদ্ধতিকে বর্তমানে বিজ্ঞানসম্মত ও গতিশীল বলা হচ্ছে যে কাজের মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে সক্ষম। 
এই সকল কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতির পশ্চাতে যে তত্ত্ব ও নীতি সুস্পষ্ট তা মানুষকে যৌথ কাজের প্রেরণা দেয় , তার সহযোগিতার মানসিকতা বৃদ্ধি করে এবং সামাজিক দক্ষতা , যোগ্যতা এবং অন্যান্য পারস্পরিক সম্পর্কের গুণরাজি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সুতরাং আধুনিক কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতির নীতি সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও নীতিগুলির উপর প্রতিষ্ঠিত। 


বিদ্যালয় সংগঠন , পরিচালনা ও সমাজবিজ্ঞান :- 
আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যালয় সংগঠন ব্যবস্থায় সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাব খুবই স্পষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ।  বিদ্যালয় সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে বিবেচিত এবং শিক্ষাবিদ ডিউই এর মতে , এটা হচ্ছে প্রকৃত সরলীকৃত এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ। 
কেবল সংগঠনের দিক থেকে নয় , সামাজিক দায়িত্ব পালনেও বিদ্যালয়ের কাজ তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুতঃ শিক্ষার্থীর সামাজিকীকরণের কাজে বিদ্যালয়ের অবদান সমাজবিজ্ঞানের প্রভাবকে মূর্ত করে তোলে।  সমাজ সংরক্ষণ ,  সমাজ-সংস্কৃতির পরিবাহন এবং সমাজ প্রগতির উন্মেষনে বিদ্যালয়ের সামাজিক দায়িত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। 
তাছাড়া বিদ্যালয় ভিন্ন অন্যান্য বিভিন্ন অন্যান্য সামাজিক সংস্থাও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে এবং বিদ্যালয়কে এদের সাথে পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নিজের দায়িত্ব পালনে ব্রতী হতে হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আধুনিক শিক্ষায় বিদ্যালয় সংগঠনে ,  বিদ্যালয়ের কর্তব্য নির্ধারণে  এবং বিদ্যালয়ের সাথে অন্যান্য সামাজিক শিক্ষা সংস্থার সম্পর্ক নিরূপণে সমাজবিজ্ঞানের প্রভাব বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। 

আধুনিক শিক্ষকের কর্তব্য , দায়িত্ব এবং সমাজ বিজ্ঞান :- 
আধুনিক শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে যে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে তাও কমবেশি সমাজবিজ্ঞানের নীতি ও তত্ত্বকেন্দ্রিক। আধুনিক শিক্ষায় একজন শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষার্থীর বন্ধু , দার্শনিক ও নির্দেশক। এই কাজে শিক্ষককে সুষ্ঠভাবে ব্রতী হতে হলে পারস্পরিক সুসম্পর্কের নীতি গুলিকে বিজ্ঞানসম্মত পথে অনুধাবন করতে হয়। 

ব্রাউন বলেছেন যে , শিক্ষক নিজে শিক্ষার্থীদের কৃষ্টিগত উত্তরাধিকার সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করবেন এবং তাদের সামাজিক সম্পর্কের প্রক্রিয়াজনিত ব্যবহারে পরিচালকের ভূমিকা গ্রহণ করবেন। শিক্ষকের এই পরিবর্তিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতায় সমাজবিজ্ঞানের প্রভাব সুস্পষ্ট। 

শিক্ষায় মানবীয় সম্পর্ক ও সমাজবিজ্ঞান :- 
পরিশেষে , আধুনিক শিক্ষায় মানবীয় সম্পর্কের বিকাশ ও বৃদ্ধিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী - শিক্ষক ,  শিক্ষার্থী - শিক্ষার্থী ,  শিক্ষক - শিক্ষক , প্রধান শিক্ষক - শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক - অভিভাবক প্রভৃতির সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্কেকে খুবই মূল্যবান মনে করা হয়েছে। এখানেও সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাব বিদ্যমান। শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে উপরোক্ত মানবীয় সম্পর্ক নির্ধারণ ব্যবস্থা সমাজবিজ্ঞানের প্রভাবকেই মূর্ত করে তুলেছে। 

উপসংহারে বলা যায় যে , সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন নীতি ও তত্ত্ব শিক্ষার বিভিন্ন উপাদানের উপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই সামাজিক বিজ্ঞানের নীতি ও তত্ত্বের বিবেচনা ব্যতিরেকে আধুনিক শিক্ষা প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অসম্ভব এবং এরকম কোন প্রচেষ্টা অলীক প্রচেষ্টার  নামান্তর। 

You May Also Like

1 comments