সামাজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞা , বৈশিষ্ট ও গুরুত্ব।

by - May 27, 2021

সামাজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট আলোচনা কর। 


সামাজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞা : - 


সামাজিক গোষ্ঠীর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে অধ্যাপক বটোমর বলেছেন - 
'' সামাজিক গোষ্ঠী এমন কিছু ব্যক্তির সমষ্টি - ১. যাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে এবং ২. যারা প্রত্যেকে গোষ্ঠীজীবন ও তার প্রতীকী রূপগুলি সম্পর্কে সচেতন। 

ম্যাকাইভার ও পেজ - এর মতে , 
গোষ্ঠী বলতে আমরা বুঝি পারস্পরিক নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তির সমষ্টিকে। এখানে গোষ্ঠী হল ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্বন্ধ। 

জিসবার্ট - এর মতে , 
সামাজিক গোষ্ঠী হল পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়াশীল ও একটি স্বীকৃত সংগঠন সম্বলিত মনুষ্য সমষ্টি। 

বোগারদাসের মতে , 
যখন একাধিক ব্যক্তি একই প্রকার উদ্দেশ্যযুক্ত হয় ও একে অন্যের ওপর প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে সাধারণ একটি দায়বদ্ধতা থেকে একই প্রকার কাজকর্ম করে থাকে , তাকে সামাজিক গোষ্ঠী বলে।  

অর্থাৎ , সামাজিক গোষ্ঠী হতে হলে - ১. একের অধিক জনসংখ্যা থাকতে হবে , ২. জনসংখ্যার মধ্যে একটি লক্ষ্যের ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকতে হবে। 
সুতরাং আমরা বলতে পারি যে , পরস্পরের প্রতি পরস্পর প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিতে ক্রিয়াশীল দুই বা ততোধিক মানুষ সংঘবদ্ধ হলে তাকে গোষ্ঠী বা দল বলে। 


সামাজিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট :- 


১. ব্যক্তি সমষ্টি বা জনসমষ্টি :- সামাজিক গোষ্ঠী হল ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে গোষ্ঠী তৈরী হতে পারে না। ব্যক্তি গোষ্ঠীর একক। গোষ্ঠী গঠনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ , ব্যক্তি সমষ্টিগতভাবে পারস্পরিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলে তাকেই গোষ্ঠী হিসাবে গণ্য করা হয়। 

২. ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক :- শুধুমাত্র যে কোনো ব্যক্তি সমষ্টিকে গোষ্ঠী বলা হয় না। গোষ্ঠীর সদস্যগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গোষ্ঠী সৃষ্টির অপরিহার্য বিষয়। এটি গোষ্ঠীর ভিত্তি স্বরূপ। সমাজতাত্ত্বিকগণের মতে , এই সম্পর্ক সবসময় দৈহিক হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই , তা মানসিকও হতে পারে। 

৩. পারস্পরিক বোঝাপড়া :- গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতা , সহচর্য ও ভাবের আদান প্রদান লক্ষ্য করা যায়। 

৪. গোষ্ঠী চেতনা :- গোষ্ঠীর সদস্যদের মনে একপ্রকার চেতনা জাগ্রত হয় , যার দ্বারা সে তার গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজের সম্পর্ককে খুঁজে পায়। সে উপলব্ধি করে যে , সে বিচ্ছিন্ন নয় ; সে এক বৃহৎ সমগ্রতার অংশ। এই গোষ্ঠীচেতনা ব্যক্তিকে অন্যের প্রতি সহযোগী ও সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করে। এই গোষ্ঠী চেতনা ব্যক্তির সদস্যদের মধ্যে দলীয় মনোভাব বা Team Spirit জাগ্রত করে এবং এই মনোভাব ব্যক্তি স্বার্থের তুলনায় গোষ্ঠী স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। 

৫. আমরা - বোধ :- গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে আমরা একই গোষ্ঠীর বা একই সাধারণ জীবনের অংশীদার -  এরকম এই বোধ কাজ করে। এই বোধ গোষ্ঠীর সদস্যদের অন্য গোষ্ঠীর সদস্যদের থেকে আলাদা করে রাখে। স্বভাবতই আমরা বোধ বা We feeling  থেকেই গোষ্ঠীর নিজস্বতা বা স্বতন্ত্রতা তৈরি হয়। আমরা সকলে মিলে একটি একক , আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য - গোষ্ঠীবদ্ধ সদস্যদের এরূপ মানসিকতা গোষ্ঠী গঠনে ও সংরক্ষণে অত্যন্ত সহায়ক। এরূপ মনোভাব থাকলে অনেক সময় দৈহিক সান্নিধ্যের বিষয়টিও গৌণ হয়ে পড়ে। 

৬. ঐক্য ও সংহতি :-  গোষ্ঠীর সদস্যরা একটি ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ।  এই ঐক্য থেকেই জন্ম হয় গোষ্ঠী সংহতি বা group solidarity - র।  এই একাত্মতা বা ঐক্যবোধ সদস্যদের পরস্পরের আবেদনে সাড়া দিতে শেখায় ও অনুপ্রাণিত করে। গোষ্ঠীর মধ্যেকার এই ঐক্য ও সংহতি সদস্যদের একই বন্ধনে বেঁধে রাখে। 

৭. সাধারণ উদ্দেশ্য :- গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বার্থ ও আদর্শ সমজাতীয় হয়। মানুষ তখনই কোন গোষ্ঠীভুক্ত হয় , যেখানে তার স্বার্থ সেই গোষ্ঠীর অন্যান্যদের সাথে সমগোত্রীয় বা অভিন্ন হয়ে থাকে। এইভাবে গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে একটি সাধারণ সাধারণ উদ্দেশ্য দেখা যায়। 

৮.অভিন্ন আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রা :- গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বার্থ বা প্রয়োজন অভিন্ন ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক থাকায় তারা সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য যৌথভাবে সচেষ্ট হয়। এইভাবে দেখা যায় , তাদের আচার-আচরণও অভিন্ন হয়ে থাকে। এই আচরণগত অভিন্নতা থেকেই তারা অভিন্ন জীবনযাত্রার অংশীদার হয়ে পড়ে। 

৯. নিয়মকানুন :- প্রত্যেক গোষ্ঠীরই কোনো না কোনো নিয়ম-কানুন থাকে। গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণত এগুলিকে মেনে চলে বা কোনো কোনো সময় মেনে চলতে বাধ্য থাকে। গোষ্ঠীর তার সদস্যদের এগুলোকে মান্য করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করে থাকে। ব্যক্তি তা স্বত্তেও এগুলি না মানলে তাকে গোষ্ঠী থেকে খারিজ করা হয়। 

১০. গোষ্ঠীর আকার :- ক্ষুদ্রাকৃতি ও বৃহদাকৃতির উভয়ই হতে পারে। মাত্র দুইজন ব্যক্তিকে নিয়েও গোষ্ঠী তৈরি হতে পারে , আবার লাখ লাখ লোক জন নিয়েও একটিমাত্র গোষ্ঠী তৈরি হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ,  স্বামী-স্ত্রী এই দুজন কে নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয় যার নাম পরিবার।  আবার কোনো রাজনৈতিক দলও একটি গোষ্ঠী যাতে লাখ লাখ সদস্য থাকতে পারে। 

১১. গোষ্ঠী গতিশীল :- গোষ্ঠী স্থিতিশীল নয়। এর আকার , আকৃতি , সদস্যসংখ্যা , উদ্দেশ্য , কার্যাবলী প্রভৃতির পরিবর্তন হয়। গোষ্ঠীর সদস্যদের একদিকে যেমন মৃত্যু হয় , আবার অন্যদিকে নতুন সদস্য জন্মায়। আবার বাইরের কোনো শক্তির প্রভাবে এর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। 

১২. স্থায়িত্ব :-  গোষ্ঠী মোটামুটি একটি স্থায়ী সংগঠন। তবে কিছু কিছু গোষ্ঠী আছে যাদের উদ্দেশ্য সীমিত , সেগুলি অল্প সময়ের মধ্যে উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেলেই বিলুপ্ত হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে বলা হয় , সমষ্টিগত জীবনধারণের জন্য কিছুটা দীর্ঘসময়ের স্থায়িত্ব বা অবিচ্ছিন্নতার প্রয়োজন হয়। তা না হলে গোষ্ঠী গড়ে ওঠে না। 

১৩.  সম্পত্তি :-  প্রত্যেক গোষ্ঠীরই কোনো না কোনো সম্পত্তি থাকে। তবে সম্পত্তি বলতে শুধুমাত্র বস্তুগত বিষয়াদিকে বোঝায় না।  এগুলি ভাবমূলক এবং আধ্যাত্মিক প্রভৃতিও হতে পারে। অট্টালিকা ,অর্থ,  পতাকা ,  বিশেষ ভাবাদর্শ প্রভৃতি গোষ্ঠীর সম্পত্তি বলে বিবেচিত হয়। 

১৪. ব্যক্তিত্বের প্রভাবক :- গোষ্ঠীর মধ্যেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে।  অর্থাৎ গোষ্ঠীই  ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রভাবিত করে থাকে। 



সামাজিক গোষ্ঠীর গুরুত্ব :- 


মানবসমাজধারার অন্যতম ভিত্তি হলো গোষ্ঠী জীবন। সমাজের অবস্থান , কাঠামো , ধারাবাহিকতা ,  পরিবর্তন এসব কিছুই গোষ্ঠীগুলির ক্রিয়াশীলতার ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি জন্ম থেকে মৃত্যু অর্থাৎ তার সামগ্রিক জীবনধারা প্রবাহিত হয় গোষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে। এখানেই সে খুঁজে পায় ''সামাজিক জীব'' হিসেবে পরিচিতি ও পরিব্যাপ্তি। গোষ্ঠীজীবনে অন্তর্ভুক্তি ছাড়া ব্যক্তি দৈনন্দিন প্রয়োজনাদি মিটিয়ে নিতে পারে না ,  আবার সামাজিকতা থেকেও সরে থাকতে পারেনা। তাই তাকে পরিবার থেকে শুরু করে ক্লাব , সংগঠন,  বন্ধুগোষ্ঠী , পেশাগত সংস্থা প্রভৃতি একাধিক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে থাকতে হয়। এগুলির হাত ধরেই ব্যক্তি খুঁজে পায় তার সামাজিক সম্পূর্ণতা। যাইহোক , সামাজিক গোষ্ঠীর গুরুত্বসমূহকে  নিন্মলিখিতভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। 

১. গোষ্ঠী ব্যতীত মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কষ্টকর। কারণ , মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার , নানারকম স্বার্থ চরিতার্থ করার এবং উদ্দেশ্য পূরণের সুযোগ লাভ করে গোষ্ঠীর মাধ্যমেই। 

২. সামাজিক পরিবেশ বাদ দিয়ে মানুষ একটি প্রাণী থেকে সামাজিক জীব হয়ে উঠতে পারে না। সে সামাজিক হয়ে ওঠে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে এবং এই সামাজিকীকরণ হয়ে থাকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহায়তায়। অর্থাৎ গোষ্ঠীগুলিই ব্যক্তিকে ''মানুষে'' পরিণত করে এবং তার সামাজিক চরিত্রের বিকাশ ঘটায়।  তাই বলা হয় Man only becomes man among men  । 

৩. গোষ্ঠীজীবন হলো সমাজ জীবনের অংশবিশেষ। এটি সমাজজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে , আবার এই পারস্পরিক সম্পর্কের জটাজালই হল সমাজ। তাই শুধুমাত্র ব্যক্তির অস্তিত্বের প্রয়োজনেই নয় , সমাজের অস্তিত্বও গোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল। 

৪. গোষ্ঠী তার সদস্যদের মধ্যে এক প্রকার গোষ্ঠী চেতনার উন্মেষ ঘটায় , যার দ্বারা ব্যক্তির মধ্যে এই উপলব্ধি কাজ করে যে , সে পৃথিবীতে একা নয় , সে সমগ্রতার অংশবিশেষ। এইভাবে গোষ্ঠী ব্যক্তির  মনে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা প্রদান করে। 

৫. গোষ্ঠীর নিয়মকানুন বর্তমান। গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণত এগুলো মেনে চলে। ব্যক্তি স্বতঃস্ফূর্তভাবে না মানতে চাইলে গোষ্ঠী তার সদস্যদের এগুলি মানতে বাধ্য বাধ্য করে। এভাবে গোষ্ঠী জীবনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ব্যক্তি নিয়মানুবর্তী হতে শেখে। 

৬. গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে একটি গোষ্ঠীগত মনোভাব কাজ করে। এই মনোভাব ব্যক্তির মধ্যে শ্রদ্ধা , সহানুভূতি , প্রেম-ভালোবাসা , দয়া-মায়া , মমতা প্রভৃতি জাগ্রত করে। অন্যভাবে বলা যায় , এই জাতীয় মানব গুণাবলী ও আবেগ অনুভূতির প্রকাশ গোষ্ঠী জীবনেরই ফসল। 

৭. গোষ্ঠী তার উদ্দেশ্যসমূহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা পূরণ করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি নানা প্রকারের হয়ে থাকে। তাই বলা হয় , সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো গোষ্ঠীই তৈরি করে থাকে। 

৮. ব্যক্তিত্ব গঠনে গোষ্ঠী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিত্ব বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলির এক সমন্বিত রূপকে। গোষ্ঠীর মধ্যেই কোনো ব্যক্তির এই বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ব্যক্তিত্ব গঠিত ও বিকশিত হয়। 

৯. গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তি তার সাংস্কৃতিক উপাদানগুলিকে অধিগত করে ও প্রয়োগ করে। আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হল আমাদের গোষ্ঠী। 

১০. পরিশেষে বলা যায় , ব্যক্তির সামগ্রিক পরিচয় বহন করে তার গোষ্ঠী। 

   














        

You May Also Like

0 comments