শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক গোষ্ঠীর ভূমিকা। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক ও গৌণ গোষ্ঠীর ভূমিকা।

by - May 27, 2021

শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক গোষ্ঠীর ভূমিকা :- 

কোনো ব্যক্তিই সমাজ বহির্ভুত নয় , ব্যক্তি ও সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে সমাজ পরিচালিত ও বিবর্তিত হয়। ব্যক্তিজীবনের সাথে জড়িত প্রতিটি উপাদানকে সমাজ ও তার মধ্যস্থ গোষ্ঠীগুলি প্রভাবিত করে। ব্যক্তিজীবনের এইরূপ একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হল শিক্ষা। সমাজ যেহেতু গতিশীল , তাই সেই সূত্র ধরে শিক্ষা ধারাও গতিশীল। আবার সামাজিক গোষ্ঠীগুলি দুই ভাগে বিভক্তি - প্রাথমিক গোষ্ঠী ও গৌণ গোষ্ঠী। শিক্ষা ও বিবর্তনের ক্ষেত্রে সামাজিক গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা নিচে আলোচনা করা হল। 


শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক গোষ্ঠীর ভূমিকা :- 


১. প্রাথমিক গোষ্ঠীকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের মুক্তাঙ্গন হিসাবে গণ্য করা হয়। পরিবার , বন্ধুগোষ্ঠী প্রভৃতি সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় , ব্যক্তিত্ব গঠনে এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

২. প্রাথমিক গোষ্ঠীর অভ্যন্তরেই ব্যক্তির আপন সত্তা প্রকাশিত হয়। ব্যক্তি সম্পর্কভিত্তিক এই প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলিতে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলির বিকাশ ও প্রকাশ ঘটে। 

৩. প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলি সমাজের অপরিহার্য বুনিয়াদ। পরিবার বা প্রাথমিক গোষ্ঠীর মধ্যে শিশু প্রথম জন্মগ্রহণ করে। পরিবারের মধ্যেই শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকশিত হতে শুরু করে। পরিবার খেলাধুলার সংস্থা বা ক্লাব , বন্ধুগোষ্ঠী ইত্যাদি প্রাথমিক গোষ্ঠীরূপে সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

৪. প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।  এই গোষ্ঠীগুলি সংস্কৃতির সঞ্চালনায় ও অন্যান্য ভূমিকা পালন করতে থাকে। ব্যক্তির জন্মের পর সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সমাজস্বীকৃত আচার-আচরণ , আদব-কায়দা , মূল্যবোধ , ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি সম্বন্ধে ধারণা প্রাথমিক গোষ্ঠী থেকেই আয়ত্ত করে থাকে। 

৫. ম্যাকাইভার ও পেজ - এর মতে প্রাথমিক গোষ্ঠী হিসেবে পরিবার শিশুকে সমাজের জটিল রহস্যের সন্ধান দেয় এবং সমবয়সীদের নিয়ে গঠিত গোষ্ঠীগুলি শিশুর সামাজিক আবেগকে সৃষ্টিশীল প্রকাশে সাহায্য করে। 

৬. শিশুর মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা , বাসনা , নিকট সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রবণতা ইত্যাদি চরিতার্থ করতে প্রাথমিক গোষ্ঠী বিশেষভাবে সহায়তা করে। 

৭. প্রাথমিক গোষ্ঠীর মাধ্যমেই শিশুর মধ্যেকার প্রেম - প্রীতি , ভালোবাসা , মমতা প্রভৃতি আবেগময় ও কোমল বৃত্তিগুলি বিকশিত হয়ে ওঠে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এই কোমল বৃত্তিগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ। 

৮. প্রাথমিক গোষ্ঠীর আন্তরিক মমত্ববোধ ও প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ শিশুদের স্বার্থপরতার মনোভাব পরিবর্তনে সহায়তা করে। শিশুরা ''আমি'' সর্বস্ব চিন্তা-চেতনা প্রাথমিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে ''আমরা'' মনোভাবে রূপান্তরিত হয়। 

৯. বর্তমান সমাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি এবং বিশ্বায়নের ফলে মানুষের চিন্তা-ভাবনা , জীবনধারা সমস্তই পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলির উপর মানুষের নির্ভরশীলতা অনেক কমেছে। তবু পরিবার , বন্ধু গোষ্ঠী ইত্যাদি প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলি আজও শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে ও সমাজ জীবনের প্রস্তুতিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। 

১০. অন্যান্য সামাজিক প্রক্রিয়াগুলি , যেমন সহযোগিতা , প্রতিযোগিতা , দ্বন্দ্ব প্রভৃতি প্রাথমিক গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ও ব্যক্তি পরিচিতি লাভ করে থাকে। 



শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌণ গোষ্ঠীর ভূমিকা :- 


মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে মানুষের স্বার্থে বহুরূপে প্রকাশিত হচ্ছে।  নানা ধরনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গৌণগোষ্ঠীসমূহ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানকালে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্ফোরণের ফলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তাই শিক্ষা ও সমাজ জীবনের প্রয়োজনেই গড়ে উঠেছে নানা ধরনের বড় বড় পরামর্শদাতা গৌণ গোষ্ঠী।  শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন পেশাগত গৌণ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে যার ফলে ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দরজা খুলে দিয়েছে। এই সকল সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। 

অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ ও সচদেব বলেছেন - '' The secondary groups have opened channels of opportunity . They provide a greater chance to develop individual talents .''  

বর্তমানে শিক্ষার লক্ষ্যরূপে শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ কে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিশুর অনন্ত সম্ভাবনার  আধার। তাকে পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশিত করে তোলার জন্য গৌণ গোষ্ঠীগুলি অপরিহার্য।  পঠন পাঠনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলা , সংগীত , নাটক , কারিগরিবিদ্যা - ইত্যাদি বিকাশের জন্য প্রয়োজন গৌণ গোষ্ঠীর। যেমন - সাহিত্যসভা , নাট্য সংগীত সংস্থা ,  শিল্পকলা মঞ্চ - ইত্যাদি। এরূপ বিভিন্ন ধরনের উন্নত মানের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের মধ্যে দিয়ে শিশুর সুপ্ত গুণাবলী পূর্ণরূপে প্রকাশিত ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। 

গৌণ গোষ্ঠীগুলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অধীন। এখানে সকলকেই সমান ভাবে গ্রহণীয় বলে মনে করা হয়। গৌণ গোষ্ঠীর এই প্রকার ভূমিকার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিকতার বোধ জাগ্রত হয়।  

গৌণ গোষ্ঠীগুলি বৃহৎ আকৃতির হওয়ায় বিভিন্ন সামাজিক স্বার্থগুলি একযোগে অধিক পরিমাণে সম্পন্ন হতে পারে। তাছাড়া এই সকল গৌণ গোষ্ঠীর দায়-দায়িত্ব গুলি ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদন করতে গেলে তা যেমন সময় সাপেক্ষ হয় আবার ব্যয়সাপেক্ষ হয়। তাই বাধ্যতামূলকভাবে সকলেই কোন না কোন গৌণ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। 

এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে , মৌলিক বিষয় পাঠের চাহিদা আজ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এর পরিবর্তে ব্যবহারিক জ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে। এই পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী শিক্ষা ও শিল্পকে সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য গৌণ গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়েই শিক্ষা ক্ষেত্রে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সমাজে একদিকে যেমন প্রাথমিক গোষ্ঠীর প্রয়োজন তেমনি বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত গৌণ গোষ্ঠীর প্রয়োজনও বর্তমান সমাজে গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে।


You May Also Like

0 comments