সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণীভাগ :-

by - May 29, 2021


সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণীভাগ ( Classification of Social Groups )

 
সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণীভাগ কয়েকটি মানদন্ডের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। অধ্যাপক বটোমর তাঁর Sociology গ্রন্থে বলেছেন , সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণীবিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় মানদন্ড বেশ কয়েকটি ; যেমন - গোষ্ঠীর লক্ষ্য , গোষ্ঠীর সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের আবেগপ্রবণতা ও বৌদ্ধিক চরিত্র , সম্পর্কের ব্যক্তিগত প্রকৃতি , গোষ্ঠীর আয়তন ও স্থায়িত্ব। 
মরিস জিনসবার্গ সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে গোষ্ঠীর আয়তন , স্থায়িত্ব , আঞ্চলিক বন্টন , গঠন প্রক্রিয়া , সাংগঠনিক প্রকৃতি - প্রভৃতি বিষয়গুলিকে উল্লেখ করেছেন। 

সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণীবিভাগগুলি নিম্নরূপ :- 

১. অন্তর্গোষ্ঠী ও বহির্গোষ্ঠী ( In - group and Out - group ) :- 
অধ্যাপক সামনার ( W.G. Sumner ) তাঁর Folkways গ্রন্থে এই শ্রেণীবিভাজনটি করেছেন। গোষ্ঠীর প্রতি তার সদস্যদের মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই ভাগ করা হয়েছে। 
নিজের গোষ্ঠীর সাথে তার সদস্যদের নিবিড় সম্পর্ক থাকে। নিজের গোষ্ঠীর সদস্যরা একটি আন্তরিকতার গভীর বন্ধনে সংযুক্ত। তাদের মধ্যে গভীর '' আমরা বোধ '' বর্তমান। নিজেদের ক্লাব , নিজেদের পাড়া - এগুলি অন্তর্গোষ্ঠীর উদাহরণ। 
অন্যদিকে , ব্যক্তি যে গোষ্ঠীর সদস্য নয় , তার প্রতি তার মনোভাব ঔদাসীন্যের , কখনো বা শত্রুতার - ওই ব্যক্তির কাছে উক্ত গোষ্ঠীটি হল বহির্গোষ্ঠী। যেমন - অন্যের ক্লাব। 

২. (ক ) ঐচ্ছিক গোষ্ঠী ও অনৈচ্ছিক গোষ্ঠী  , (খ ) প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠী , ( গ ) স্বল্পস্থায়ী গোষ্ঠী ও স্থায়ী গোষ্ঠী। 
Charles A. Ellwood তাঁর Psychology of Human Society গ্রন্থে এই তিন ধরণের শ্রেণীবিভাগের উল্লেখ করেছেন। 

(ক ) ঐচ্ছিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এর সদস্যপদ ব্যক্তির ইচ্ছা - অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। যেমন ক্লাব , রাজনৈতিক দল - ইত্যাদি। আবার অনৈচ্ছিক গোষ্ঠী হল এমন ধরণের গোষ্ঠী যার সদস্যপদ ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। সাধারণত , জন্মসূত্রে ব্যক্তির সদস্যপদ এক্ষেত্রে নির্ধারিত হয়। যেমন - পরিবার।  

(খ ) প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠী হল এমন ধরণের গোষ্ঠী যার বেশকিছু নিয়মনীতি , রীতিনীতি বা প্রতিষ্ঠান আছে। যেমন - বিদ্যালয় , জাতিব্যবস্থা - ইত্যাদি। 
অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীগুলিতে এজাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট অনুপস্থিত। যেমন - ক্ষিপ্ত জনগণ , বিদ্যালয়ের কমন রুমের গোষ্ঠী। 

(গ ) স্থায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে তৃতীয় শ্রেণীবিভাগটি করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে , স্থায়ী গোষ্ঠী দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় কিন্তু অস্থায়ী গোষ্ঠী বেশিদিন স্থায়ী হয়না। 

৩. প্রাথমিক গোষ্ঠী ও গৌণ গোষ্ঠী :- ( Primary and Secondary Group ) :- 
গোষ্ঠীর সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও গুনাগুনের ওপর ভিত্তি করে এই বিভাজনটি করা হয়েছে। মার্কিন সমাজতত্ববিদ অধ্যাপক কুলি তাঁর Social Organisation গ্রন্থে উক্ত শ্রেণীভাগটি করেছেন। 
প্রাথমিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে প্রত্যক্ষ , মুখোমুখি ও আন্তরিক সম্পর্ক থাকে। প্রাথমিক সবচেয়ে প্রধান উদাহরণ হল পরিবার।     আবার , অন্যদিকে , গৌণ গোষ্ঠীর সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক পরোক্ষ ও গৌণ প্রকৃতির। যেমন - রাষ্ট্র। 

৪. বিধিবদ্ধ ও অবিধিবদ্ধ গোষ্ঠী ( Formal and Informal Group ) :-   
এটি মূলতঃ এলউড কৃত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীরই সমরূপ। বিধিবদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যদের আচার - আচরণ ও কাজকর্ম সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম বিধি দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন - সেনাবাহিনী , শ্রেণীকক্ষের ছাত্র - ছাত্রী - ইত্যাদি। 
অন্যদিকে , অবিধিবদ্ধ গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সদস্যদের আচার আচরণের ওপর গোষ্ঠীর নিয়মবিধির ততটা কড়াকড়ি থাকে না। অবিধিবদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যরা এক্ষত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা উপভোগ করে থাকেন। যেমন , পর্যটক দল , পিকনিকের দল - ইত্যাদি। 


৫. সমাজতত্ববিদ Lowry  ও Rankin  মানব সমাজের পাঁচ প্রকার মৌলিক গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল - 
(ক ) জনসমষ্টি।  যেমন - জনসংখ্যা , ভিড় , জমায়েত , দর্শক , শ্রোতা ইত্যাদি। 
(খ ) সম্প্রদায়। যেমন - গ্রাম , শহর , শহরতলি , মহানগর - ইত্যাদি। 
(গ ) সংঘ। যেমন - ক্লাব , চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী , পরিষেবা সংস্থা - ইত্যাদি। 
(ঘ ) প্রতিষ্ঠান। যেমন - বিদ্যালয় , চার্চ , রাষ্ট্র - ইত্যাদি। 
(ঙ ) মর্যাদা গোষ্ঠী। যেমন - জাতি , শ্রেণী - ইত্যাদি। 

৬. জনসম্প্রদায় ও সংঘ :-  ( Community and Association ) 
জার্মান অধ্যাপক ফার্ডিনান্ড টোনিজ সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এই শ্রেণীবিভাজনটি করেছেন। তিনি তাঁর Community and Association গ্রন্থে জনসম্প্রদায় বা Community কে Gemeinschaft এবং সংঘ বা Association কে Gesellschaft রূপে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতানুসারে , জনসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ আন্তরিক ও ব্যক্তিগত বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একত্রে বসবাস করে। অন্যদিকে সংঘ হল মূলতঃ অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণকে লক্ষ্য করে সচেতন ও সুচিন্তিতভাবে গড়ে ওঠা সামাজিক সংগঠন। গ্রাম হল জনসম্প্রদায়ের উদাহরণ ও বিভিন্ন সংস্থা হল সংঘের উদাহরণ। 

৭. নির্দেশক গোষ্ঠী : 
মুজাফের শেরিফ ১৯৪৮ সালে সমাজতত্ত্বের আলোচনায় তাঁর An outline of social Psychology গ্রন্থে নির্দেশক গোষ্ঠী বা নজিরস্থাপক গোষ্ঠী বা Reference Group কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মার্টন , টার্নার - প্রমুখ এই গোষ্ঠীর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে আলোকপাত করেন। মানুষ সর্বদা উচ্চ গোষ্ঠীর আচার - আচরণ , জীবনযাত্রা , আদর্শমূলক রীতিনীতি , প্রভৃতির অনুসরণ ও অনুকরণ করে। এ জাতীয় আচরণকে বলা হয় Reference Behavior বা নির্দেশক আচরণ। 
গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও কোনো গোষ্ঠীর সদস্যগণ তাদের গোষ্ঠীর চেয়ে উন্নত যে সকল গোষ্ঠীর রীতিনীতি , নিয়মকানুন এবং সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের আচার আচরণ অনুসরণ ও অনুকরণ করে এবং সেই গোষ্ঠীর সমকক্ষ বা মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার চেষ্টা করে ,সেই আদর্শ গোষ্ঠীকে বলা হয় নজির স্থাপক গোষ্ঠী। 

৮. বংশগতিক গোষ্ঠী ও সমাবিষ্ট গোষ্ঠী ( Genetic and Congregate Group ) :- 
অধ্যাপক গিডিংস তাঁর Principles of Sociology গ্রন্থে মূলতঃ সদস্যদের গোষ্ঠীতে প্রবেশাধিকারের প্রকৃতির ভিত্তিতে এই বিভাজনটি করেছেন। বংশগতিক গোষ্ঠী একটি অনৈচ্ছিক গোষ্ঠী। এর সদস্যপদ জন্মসূত্রেই নির্ধারিত হয়। উদাহরণ হিসেবে জাতি , পরিবার - ইত্যাদির কথা বলা যায়। অন্যদিকে সমাবিষ্ট গোষ্ঠী হল একটি ঐচ্ছিক গোষ্ঠী। ব্যক্তি তার নিজস্ব ইচ্ছা ও প্রয়োজন অনুসারে এর সদস্য হয়ে থাকে। যেমন - ক্লাব , রাজনৈতিক দল। 

৯. অনুভূমিক গোষ্ঠী ও উল্লম্ব গোষ্ঠী :-  ( Horizontal and Vertical Group ) :- 
সরোকিন এই শ্রেণীবিভাজনটি করেছেন। এক্ষেত্রে গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে উচ্চ - নীচ পার্থক্যের বিষয়টি বিভাজনের ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। 
অনুভূমিক গোষ্ঠী হল বৃহত্তর , এখানে সকল সদস্য সমপর্যায়ভুক্ত। এদের মধ্যে মর্যাদাগত কোনো উচ্চ নীচ ভেদাভেদ থাকে না। যেমন রাষ্ট্রের নাগরিক। 
কিন্তু উল্লম্ব গোষ্ঠীতে সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মর্যাদার ভিত্তিতে উচ্চ নীচ ভেদাভেদ দেখা যায়। যেমন - জাতিভেদ , মন্ত্রিসভা। 


১০. আঞ্চলিক গোষ্ঠী ও অঞ্চলবর্জিত গোষ্ঠী :- 
পার্ক ও বার্জেস এই শ্রেণীবিভাজনটি করেছেন। আঞ্চলিক গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট অঞ্চল আছে। জনসম্প্রদায় , রাষ্ট্র - প্রভৃতি আঞ্চলিক গোষ্ঠীর উদাহরণ।  
অন্যদিকে অঞ্চলবর্জিত গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল নেই। যেমন - জাতিভেদ , শ্রেণিব্যবস্থা। 

এছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রকার গোষ্ঠীগত শ্রেণীবিভাজন বর্তমান। যেমন :- 
১১. ভিড় ও বিমূর্ত গোষ্ঠী। 
১২. ছোট ও বড় গোষ্ঠী। 
১৩. সামাজিক বর্গ ও সামাজিক সমাবেশ। 
১৪. ক্ষণস্থায়ী গোষ্ঠী। 
১৫. অন্তর্বর্তী গোষ্ঠী। 
১৬. সংগঠিত ও অসংগঠিত গোষ্ঠী। 
১৭. মুক্ত ও বদ্ধ গোষ্ঠী। 
১৮. স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় - এরকম গোষ্ঠী। ইত্যাদি। 

               
          















       

You May Also Like

0 comments