নয়া উদারনীতিবাদ কাকে বলে ? নয়া উদারনীতিবাদের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।

by - November 01, 2025

নয়া উদারনীতিবাদ কাকে বলে ? নয়া উদারনীতিবাদের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।  



নয়া উদারনীতিবাদ :- 

সাধারণভাবে উদারনীতিবাদের পরবর্তী পর্যায় হিসাবে নয়া উদারনীতিবাদের জন্ম হয় ১৯৭০ এর দশকে। উদারনীতিবাদের তুলনায় নয়া উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে আরও সংকুচিত করে। নয়া উদারনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্র কেবলমাত্র একটি জনকল্যাণমূলক ও নাগরিক অধিকার রক্ষামূলক সংস্থা। সাধারণ জনজীবনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব হবে ন্যূনতম। 

নয়া উদারনীতিবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণরূপে বাইরে রাখতে চায়। নয়া উদারনৈতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। 

নয়া উদারনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র , সামাজিক ন্যায়বিচার , মানবাধিকার , সাম্য ও স্বাধীনতা - ইত্যাদি উচ্চতর আদর্শগুলি রক্ষার সর্বোচ্চ পরিস্থিতি বজায় থাকে এবং রাষ্ট্রের কেবলমাত্র কাজ হল সেই পরিস্থিতি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা। 

নয়া উদারনৈতিক মতবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন - ফ্রেডরিখ হায়েক , রবার্ট নজিক , ফ্রিডম্যান , জন রলস - প্রমুখ।  


নয়া উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট :- 

নয়া উদারনীতিবাদের বৈশিষ্টগুলি নিম্নরূপ - 

১. রাষ্ট্রের ন্যূনতম ভূমিকা :- 
নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাগণ রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সংকুচিত করার পক্ষপাতী। সাবেকি উদারনৈতিক তত্ত্বে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের কথা বলা হলেও জনকল্যাণের অজুহাতে রাষ্ট্র ক্রমশঃ আমলাতান্ত্রিক ও শোষণমূলক হয়ে ওঠে। ফলে নয়া উদারনীতিবাদ Minimal State বা ন্যূনতম কর্মসূচিসমন্ন রাষ্ট্রের কথা বলেন। 

২. মুক্ত বাজার অর্থনীতি :- 
নয়া উদারনীতিবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বিরোধী। নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাগণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। কেননা উদারনৈতিক মতবাদের প্রবক্তাগণ মনে করেন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের যথাযথ বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। অর্থনীতি যদি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে অর্থনৈতিক বিকাশ সহজাত না হয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। 

৩. মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা :- 
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস উদারনৈতিক মতবাদের সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তি প্রদান করেন। তাঁর মতে , নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা , গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি উদারনৈতিক মতাদর্শগুলি সংরক্ষিত পেতে পারে কেবলমাত্র নয়া উদারনৈতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমেই। রাষ্ট্রশক্তি ও শাসক নিজ সংকীর্ণ স্বার্থে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার , বিভিন্ন প্রকার স্বাধীনতা - ইত্যাদির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। তাই নয়া উদারনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ নয়া উদারনীতি মতবাদের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। 

৪. ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিরোধিতা :- 
নয়া উদারনীতিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সম্পূর্ণ বিরোধী। নয়া উদারনীতিবাদ রাষ্ট্র ও শাসকের কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ করে ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে। ব্যাক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাই নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাগণ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে চান। 

৫. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ :- 
নয়া উদারনৈতিক মতবাদ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতিতে বিশ্বাস করে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে তা সামাজিক সাম্য , গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারগুলির পক্ষে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরী করে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতি সমাজের সকল স্তরের মধ্যে ক্ষমতার সামঞ্জস্যবিধান করে এবং রাষ্ট্রের চরম কর্তৃত্ব থেকে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার উপাদান হিসাবে কাজ করে। 


৬. পুঁজির অবাধ বিশ্বায়ন :- 
নয়া উদারনৈতিক মতবাদ সারা বিশ্ব জুড়ে পুঁজির অবাধ চলাচলে বিশ্বাস করে। পুঁজির অবাধ চলাচল সারা বিশ্ব জুড়ে চাহিদা ও যোগান , পণ্যের আদান - প্রদান - ইত্যাদির মধ্যে সমতা বিধান করে। পুঁজির অবাধ চলাচলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে এক প্রতিযোগিতা তৈরী হয় এবং তা থেকে লাভবান হয় ব্যক্তি ও সমাজ। 

৭. বেসরকারিকরণ :- 
নয়া উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের পরিবর্তে বেসরকারিকরণকে অধিক উৎসাহ প্রদান করে। কেননা , নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাগণ মনে করেন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব মানুষের উৎপাদনশীলতা ও স্বাভাবিক বিকাশকে সীমাবদ্ধ করে তোলে এবং কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সর্বস্তরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ মানুষের কর্মক্ষেত্র ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে।    

৮. প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্ব :-
নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাগণ প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের সাপেক্ষে এই মতবাদের পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়েছেন। রবার্ট নজিক মানুষের প্রাকৃতিক তত্ত্বের সমর্থনে বলেছেন , নাগরিকদের সম্পত্তির অধিকার , চুক্তির অধিকার , সম্পত্তি ভোগের অধিকার - ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হলে মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের সম্ভাবনাগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হবেন। 

৯. রাষ্ট্রের ভূমিকা ও কর্তব্য :- 
নয়া উদারনৈতিক মতবাদ অনুসারের রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে মূলতঃ নিরাপত্তামূলক। নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষা , মানুষের সর্বোত্তম বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করা , নাগরিক অধিকারগুলির নিরাপত্তাবিধান , ব্যক্তি স্বাধীনতার সংরক্ষণ - ইত্যাদির মধ্যেই রাষ্ট্রের ভূমিকাকে বেঁধে রাখতে চান নয়া উদারনৈতিক মতবাদের সমর্থকগণ। 

১০. প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতি সমর্থন :- 
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েক নয়া উদারনৈতিক মতবাদের সফলতার অন্যতম উপাদান হিসাবে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলেছেন। তাঁর মতে , কেবলমাত্র উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার , ব্যক্তি স্বাধীনতা - ইত্যাদি উদারনৈতিক আদর্শগুলি সংরক্ষিত হতে পারে। 

You May Also Like

0 comments