' বঙ্গভাষা ' কবিতায় বাংলা ভাষার প্রতি কবি মধুসূদন দত্তের যে ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে তার পরিচয় দাও।
' বঙ্গভাষা ' কবিতায় বাংলা ভাষার প্রতি কবি মধুসূদন দত্তের যে ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে তার পরিচয় দাও।
বঙ্গভাষা কবিতায় বাংলা ভাষার প্রতি মাইকেল মধুসূদন দত্তর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ :-
প্রেক্ষাপট :-
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন যুগান্তকারী কবি। তাঁর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য আধুনিকতা প্রবেশ করে। পাশ্চাত্যের বহু সাহিত্য রীতির প্রবেশ ঘটে তাঁর মাধ্যমেই।
মধুসূদন দত্তের জীবন বৈচিত্রময়। পাশ্চাত্য সাহিত্য , দর্শন - ইত্যাদির প্রতি প্রভাবিত হয়ে তিনি ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় প্রয়াস করেছিলেন। ইংরেজি ভাষাই হল সাহিত্যের ভাব প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা - এমনটা তার ধারণা হয়েছিল। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর রচিত একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল - '' The Visions of the Past . ''
কিন্তু এরপর কবি মধুসূদন অনুধাবন করেন প্রতিটি সাহিত্যিক , কবি নিজের ভাষাতে সাহিত্যকে যেভাবে সমৃদ্ধ করতে পারেন , যেভাবে নিজের বক্তব্যকে সৃজনশীলভাবে তুলে ধরতে পারেন - অপর কোনো ভাষাতে সেটা সম্ভব নয়।
' বঙ্গভাষা ' কবিতায় বাংলা ভাষার প্রতি কবির ভালোবাসা :-
বঙ্গভাষা কবিতাটি হল বাংলা ভাষার প্রথম সনেট। ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি প্রীতির মোহভঙ্গ হওয়ার পর কবি অনুধাবন করেন মাতৃভাষাতেই রয়েছে রত্নের খনি। বাংলা ভাষাকে তিনি রতনের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন -
'' হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন। ''
একটি খনি থেকে যেরকম মূল্যবান ও বিচিত্র রত্নরাজি লাভ করা যায় - কবির মতে , বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তেমনি অজস্র ঐশ্বর্যশালী রত্ন।
কবিতার এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে কবির অনুশোচনা। এই অনুশোচনার কারণ হল তিনি বাংলা ভাষা তুলনায় ইউরোপীয় ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাধ্যম বলে মনে করেছিলেন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে বহু চর্চা করার পর তিনি অনুশোচনার অগ্নিতে অগ্নিদগ্ধ হন। কবিতায় তিনি বলেছেন -
'' কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি !
অনিদ্রায় , অনাহারে , সঁপি কায় , মনঃ ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্য বরি ;-
কেলিনু শৈবালে , ভুলি কমল-কানন ! ''
বঙ্গভাষা কবিতার মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রতি কবির নিজের উপলব্ধিকে কবি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ' হে বঙ্গ ' বলতে তিনি বাংলা ভাষাকেই বুঝিয়েছেন এবং বাংলা ভাষাকেই সম্বোধন করেছেন।
কবিতার প্রতিটি চরণে মাতৃভাষার প্রতি কবির গভীর অনুরাগ ফুটে উঠেছে। কবি বিদেশি ভাষাকে ' পরধন ' বলে সম্বোধন করেছেন এবং সেই ধন লাভ করাকে তিনি ভিক্ষাবৃত্তির সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর ভাষায় -
'' পর - ধন - লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পরদেশে , ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি। ''
মাতৃভাষায় কবিতা রচনার দৈবী প্রেরণাকে কবি মাতৃভাষার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে কল্পনা করেছেন। তাঁর ভাষায় -
'' স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে ,-
ওরে বাছা , মাতৃকোষে রতনের রাজি , ''
সেই দৈববাণী অনুধাবন করে কবি উপলব্ধি করেন বাংলা ভাষাতেই রয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনার সকল উপাদান। রত্ন সদৃশ বাংলা ভাষার সাহায্যে সহজেই একজন কবি বা সাহিত্যিক তাঁর উপস্থাপনার সকল মাধুর্যের বর্ণনা করতে পারেন। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতেই কবি মনকে সাহিত্যের কলমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কবি নিজের উপলব্ধিকে দৈববাণীর রূপকে প্রকাশ করেছেন। এই উপলব্ধিতে কবি অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি বাংলা ভাষাতেই পেয়েছেন প্রকৃত সুখ ; বাংলা ভাষার মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত উপলব্ধি। কবির ভাষায় -
'' পালিলাম আজ্ঞা সুখে ; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা- রূপ খনি , পূর্ণ মণিজালে। ''
পরিশেষে বলা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত বঙ্গভাষা কবিতার মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আকুল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করে তিনি যেন ঘরে ফিরে এসেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
0 comments