পরিবারের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট।

by - May 15, 2022

পরিবারের সংজ্ঞা দাও। পরিবারের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 

পরিবারের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট। 

Definition and features of family . ( In Bengali ) . 




পরিবারের সংজ্ঞা :- 


সমাজে অবস্থিত বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গোষ্ঠী হল পরিবার। পরিবার হল প্রাথমিক গোষ্ঠী এবং সমাজ গঠনের মূল একক। সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরে পরিবারের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তির জন্ম , বেড়ে ওঠা , ব্যক্তিত্ব গঠন ও সামাজিকীকরণ - ইত্যাদি সবকিছুরই বিকাশ ঘটে পরিবারের মধ্যে। অর্থাৎ , সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে পরিবার হল একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। 

পরিবারের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে জিসবার্ট বলেছেন - পরিবার হল এমন একটি জৈব সামাজিক একক যেখানে তার সদস্যরা একত্রে বসবাস করে এবং স্বামী - স্ত্রী -র জৈবিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয় এবং নির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। 

অগবার্ন ও নিমকফ বলেছেন - পরিবার হল মোটামুটিভাবে স্থায়ী এবং স্বামী - স্ত্রী - র জৈবিক ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি প্রাথমিক গোষ্ঠী। 

কিংসলে ডেভিস বলেছেন - পরিবার হল পরস্পরের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি নির্দিষ্ট ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। 
 
লক ও বার্জেস বলেছেন - পরিবার হল রক্তের সম্পর্ক , বৈবাহিক সম্পর্ক বা দত্তক সূত্রে আবদ্ধ একটি সুসংবদ্ধ প্রাথমিক গোষ্ঠী। 

এলিয়ট ও মেরিল বলেছেন - পরিবার হল স্বামী - স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গঠিত একটি জৈব সামাজিক একক। 

সুতরাং পরিবার হল একত্রে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র সামাজিক গোষ্ঠী যা বিবাহসূত্রে , রক্তের সম্পর্ক ও জন্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং এই গোষ্ঠীর মধ্যেই ব্যক্তি তার অধিকাংশ জৈবিক চাহিদা পূরণ করে এবং পরিবার ব্যক্তির সামাজিকীকরণের একটি অন্যতম মাধ্যম। 


পরিবারের বৈশিষ্ট :- 


১. বিশ্বজনীন অস্তিত্ব :- সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরে পরিবার ব্যবস্থার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ব্যবস্থাতেও বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে ; কিন্তু পরিবারের অস্তিত্ব সদা বর্তমান। সর্বকালে , বিশ্বের প্রতিটি সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবারবিহীন সমাজের অস্তিত্বের কথা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং পরিবার হল একটি বিশ্বজনীন সংস্থা। 

২. ধারাবাহিকতা :- সমাজতত্ববিদেরা মনে করেন - সমাজ সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবার ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। সমাজ পরিবর্তনশীল এবং সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি স্তরে পরিবার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। তাই সমাজের ধারাবাহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারেরও ধারাবাহিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পরিবার অবিরাম গতিতে পরিবর্তিত হয়ে তার ধারাবাহিক চরিত্র বজায় রেখেছে। 

৩. ক্ষুদ্রাকৃতি :- ক্ষুদ্র ও সীমিত আকার হল পরিবারের অপর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট। পরিবার শুধুমাত্র তার সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। রক্তের সম্পর্ক , বৈবাহিক সম্পর্ক বা জন্মসূত্রে সদস্যরা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এছাড়াও দত্তক সদস্যরাও পরিবারের সদস্যরূপে বিবেচিত হয়। শুধুমাত্র নিজ সদস্যদেরকে নিয়ে গড়ে ওঠার কারণে পরিবারের আকার ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ।  

৪. সম্পর্কের গভীরতা ও আবেগপূর্ণ ভিত্তি :- পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের নিবিড়তা পরিবারের অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। পরিবারের মধ্যে প্রতিটি সদস্য একে অপরের নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। স্নেহ ,ভালোবাসা , দায়িত্ব ,কর্তব্য - ইত্যাদি প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে অপরিহার্যরূপে যুক্ত থাকে। 

৫. স্বার্থহীন গোষ্ঠী :- পরিবার হল একটি স্বার্থবিহীন গোষ্ঠী। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সাধারণত স্বার্থের সম্পর্ক থাকে না। সকলে নিজ স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে পরিবারের স্বার্থের কথা চিন্তা করেন। যেমন মা - বাবা সম্পূর্ণরূপে স্বার্থহীন হয়ে সন্তানদের লালন - পালন করেন। একজন ব্যক্তি জন্ম থেকে মৃত্যু পরিবারের মধ্যেই তার জীবন অতিবাহিত করে। সদস্যদের স্বার্থত্যাগ , স্নেহ , ভালোবাসা ও দায়িত্ব - কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে একটি পরিবার গঠিত হয়। 

৬. প্রাথমিক ও কেন্দ্রীয় গোষ্ঠী :- সমাজ গঠনের মূল একক হল পরিবার। বিভিন্ন পরিবারের সমন্বয়েই একটি সমাজ গঠিত হয়। তাই পরিবারকে প্রাথমিক গোষ্ঠী বলা হয়। এছাড়া পরিবার হল সকল সামাজিক সংগঠনের একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে পরিবার কেন্দ্রিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। 


৭. সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ :- পরিবারকে সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যেতে পারে। পরিবারের মধ্যেই প্রতিটি শিশু সামাজিকীকরণের প্রথম জ্ঞান পায়। পরিবার থেকে প্রাপ্ত আচার - আচরণ , রীতি- নীতি , সামাজিক প্রথার শিক্ষা গ্রহণ করে শিশু বৃহত্তর সমাজে তা প্রয়োগ করতে পারে এবং সামাজিকরণে অংশগ্রহণ করে। সামাজিক সকল শিক্ষা শিশু তার পরিবারের মধ্যেই লাভ করে। 

৮. সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য :- প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে। পরিবারের সদস্যগণ তাদের সেই দায়িত্ব - কর্তব্য যথাযথভাবে পালন না করলে তা পরিবারের স্বার্থ বিঘ্নিত করে। তাই পারিবারিক শৃঙ্খলা ও পরিবারের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে স্ত্রী - পুরুষ , শিশু - বয়স্ক - সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

৯. সদস্যপদ :- পরিবারের সদস্যদের সদস্যপদ ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক উভয় প্রকার হয়ে থাকে। যেমন - পরিবারের মধ্যে শিশুর জন্ম হলে তার সদস্যপদ অনৈচ্ছিক ; কেননা পরিবারের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তার ইচ্ছার কোনো ভূমিকা নেই। আবার বিবাহের ক্ষেত্রে সদস্যপদ ঐচ্ছিক। কেননা পাত্র - পাত্রী কোনো পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। 

১০. পরিবারের কার্যাবলী :- পরিবারের বিভিন্ন সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কার্যাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি পরিবার সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গঠন , সামাজিকীকরণ , সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ , অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা , সামাজিক অনুশাসন সৃষ্টি - ইত্যাদি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী।    

পরিশেষে বলা যায় , পরিবারের গঠন , কার্যাবলী ও বৈশিষ্ট দেশ ও কাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন এবং তা পরবর্তনশীল। তবে সকল সমাজে , সকল সময়ে পরিবারের মৌলিক বৈশিষ্টের কোনো পরিবর্তন হয়না। পরিবারের মধ্যেই সামাজিক সম্পর্কগুলি বৈধতা লাভ করে ও নির্দিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে।      

            

You May Also Like

0 comments