Unity in diversity ( বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। )

by - December 03, 2021

বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য।  


ভারতের '' বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য '' - ধারণাটি বিশ্লেষণ করো। 


ভারত একটি সুবিশাল দেশ। তার সভ্যতা প্রায় 6000 বছর বয়সী। এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় চেতনার পীঠস্থান। এ দেশ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করেছে। অনেক ভিনদেশি মানুষ ভারতে এসেছেন এবং এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। এই দেশ বিভিন্ন ধর্ম, কৃষ্টি, বিশ্বাস, সম্প্রদায়, ধর্মীয়, ভাষা, আচরণ, জীবনধারা ইত্যাদিকে গ্রহণ করেছে। একতা ও সংশ্লেষণ ভারতীয় সংস্কৃতির মূর্তি। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিশাল এই ভূখন্ডের তাপমাত্রা, জলবায়ু, বৃষ্টিপাত, জৈব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, মানবীয় বৈচিত্র্য, ভাষাগত বৈচিত্র্য, ধর্মীয় বৈচিত্র্য প্রভৃতি অসাধারণ ভৌগােলিক বৈচিত্র্য এবং ভাষা, ধর্ম তথা মানুষের জীবনযাত্রা ও রীতিনীতিতে নানান বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভারতবাসীদের মধ্যে এক অতুলনীয় ঐক্যবােধ লক্ষ্য করেই ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতীয় সভ্যতাকে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য (Unity in the midst of diversity) বলে অভিহিত করেছেন। তার কথায় এটি,Ethnological Museum বা জাতিত্বের সংগ্রহশালা। গানের দেশ, ফুলের দেশ, পাখির দেশ ভারত। বহু মানুষ, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির এক বিচিত্র দেশ এই ভারত। বহুত্ববাদ আর সহিষ্ণুতাই ভারতের ধর্ম। দেশের সংবিধান ভারতকে এভাবেই পরিচিত করেছে। ভারতের পরিচয় নির্ধারণ করা যায় এর ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং সংস্কৃতির বৈচিত্রতার মাঝে। এই বৈচিত্রতা আমাদের গর্ব এবং শক্তি। অসংখ্য ধর্ম, ২০০ এর বেশী ভাষা এবং ১৫০০ উপভাষা থাকা সত্ত্বেও ভারত প্রমাণ করেছে কিভাবে একসাথে বাস করা যায়। 


(ক) ভৌগােলিক ঐক্য (Geographical Unity) : -
প্রাকৃতিকভাবে ভারত একটি বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। সাধারণভাবে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত  অংশকে আর্যাবর্ত বা উত্তরাপথ ও বিন্ধ্যপর্বত থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত্য অংশকে দাক্ষিণাত্য বা দক্ষিণাপথ বলা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই অখন্ড ভারতের ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিয়ুপুরাণে সমস্ত ভারতবাসীকে ভারতীয় সন্ততি বলে অভিহিত করা হয়েছে। 

(খ) রাজনৈতিক ঐক্য (Political Unity) : -
প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু রাজারা একরাট, সম্রাট, বিরাট, রাজচক্রবর্তী উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ঐক্য স্থাপনের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। মােগল এবং ব্রিটিশ আমলেও ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা অনেকাংশে সাফল্যলাভ করেছিল। বিশ্বে সবচেয়ে বহুমুখী গােষ্ঠী সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও, ভারত বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠান বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ভারতের স্বাধীনতা অনুমােদনের সময় কিছু সন্দেহ প্রবণ “ব্রিটিশ রাজ” ভেবেছিল যে সংবিধানে বৈচিত্র্যের মঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন এর জাতীয় নেতাগণ দেখেছে তা কখনই পূরণ হবে না। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অভ্যাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, সম্প্রদায় এবং আঞ্চলিক ধ্যান-ধারণা-এর ভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতবাসী তাদের গণতান্ত্রিক সংগঠনকে টিকিয়ে রাখতে যে পারদর্শিতা দেখিয়েছে তা ভারতের বৈচিত্র্যতার মাঝে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ভারতীয় নেতৃবর্গ এবং কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের দূরদৃষ্টিকেই প্রমাণ করে।

(গ) ধর্মীয় ঐক্য :-  যুগে যুগে ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মমতের উদ্ভব হয়েছে। আর এই বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যেই আদর্শগত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই উদারতা, সত্যবাদিতা, সহনশীলতা প্রভৃতি সদগুণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ধর্মেরই মুখ্য উদ্গাতাগণ শুনিয়ে গেছেন, পরধর্ম-পরমত সহিষ্ণুতার কথা, শুনিয়েছেন - ‘যত মত, তত পথ’-এর বাণী। প্রত্যেক ধর্মমতের উপাসনাগৃহ, আচার, আরাধনা-র বহিরাঙ্গিক পার্থক্য থাকলেও সকল ধর্মই শুনিয়ে গেছেন - ‘ঈশ্বরলাভ-ই মনুষ্য জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ,অর্থাৎ মােক্ষলাভ। ।

(ঘ) ভাষাগত ঐক্য :-  ভারতবর্ষের জনগণ ১৮টি প্রধান ও বহু আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এইসব ভাষাগুলির মধ্যে এক অন্তর্নিহিত ঐক্যের সুর পরিলক্ষিত হয়। উত্তর ভারতের মূল ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে হিন্দি, বাংলা, অসমিয়া, মারাঠি, গুজরাটি প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আর দক্ষিণ ভারতের মূল ভাষা ‘দ্রাবিড় ভাষা থেকে তামিল, তেলেগু, প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার উদ্ভব ঘটেছে।

(ঙ) সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ঐতিহ্যের বন্ধন (Cultural Unity) : - প্রাচীন যুগ থেকে বিভিন্ন সময়ে গ্রিক, পারসিক, শক, কুষাণ, পল্লব, হুন , পাঠান, মােগল প্রভৃতি জাতি বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। কালক্রমে তাদের সংস্কৃতি ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যায় এবং পরস্পরের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে। এই সম্বন্ধে গান্ধীজি বলেছেন “ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে হিন্দু, ইসলাম, বা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি নয়—এটি সমস্ত সংস্কৃতির মিশ্রণ।”

(চ) সর্বভারতীয় ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ :-  ব্রিটিশ শাসনকালে সমগ্র ভারতবর্ষে একটি অখন্ড ও এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। রেলপথ ও বিভিন্ন আধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা সর্বভারতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারতবর্ষের ‘জাতীয় পতাকা’, ‘জাতীয় সংগীত’, এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে।

বর্তমানকালে বিদেশি আক্রমণ, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ প্রভৃতি কারণে কখনাে কখনাে সাময়িক অশান্তির পরিবেশ তৈরি হলেও ভারতের সনাতন ঐক্যের ধারাকে বিনষ্ট করতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা”।


You May Also Like

0 comments