concept and features of indian jajmani system ( যজমানি প্রথার ধারণা ও বৈশিষ্ট :- )

by - December 03, 2021

যজমানি প্রথার ধারণা ও বৈশিষ্ট :- 


ভূমিকা : - 

ভারতবর্ষে জাতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে উঁচুনীচু বৈষম্য সত্ত্বেও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক। যে সুপ্রাচীন প্রথা অনুসারে বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে এই সম্পর্ক সুনিয়ন্ত্রিত ছিল, তাকে বলা হয় যজমানী প্রথা।।

'' ইণ্ডিয়ান যজমানী সিস্টেম’-এর প্রণেতা উইলিয়াম এইচ. ওয়াইজার (William H. Wiser) মনে করেন যে, এই প্রথা ভারতীয় গ্রাম-সমাজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর মতে, সহযােগিতামূলক আদান-প্রদানের ভিত্তিতে এই প্রথা কিছু দায়দায়িত্ব এবং কর্তব্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। অধ্যাপক ডেভিস জি. ম্যাণ্ডেলবাম যজমানী প্রথাকে ধারাবাহিক সম্পন্ন প্রথা বলে দাবী করেছেন। বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে এই চুক্তিভিত্তিক বিশেষ ধরণের সম্পর্কগুলিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হেনরি যজমানী’- এই শব্দটিকে প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি প্রথমে মাইসােরের গ্রাম সম্পর্কে গবেষণায় দেখান যে, গ্রামের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ধরণ নিয়ন্ত্রিত হয় বিভিন্ন জাতিগুলির অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে। যজমানী ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল যজমান ও কামিন । এই ব্যবস্থা যে মূল তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা হল –
ক. যজমানী প্রথার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জাতিগুলির বৃত্তি ও দায়-দায়িত্ব পালন। 
খ. এই দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে অপর একটি গােষ্ঠীর চাহিদা পূরণ হয়।
গ. পারস্পরিক চাহিদা ও দায়িত্ব পূরণের মাধ্যমে প্রতিটি গােষ্ঠীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সাধন।


যজমানী প্রথাভিত্তিক এই আদান-প্রদানের সম্পর্ক কেবল অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব পালনের ও সেবার মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জাতিগুলি পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হত। জাতিভিত্তিক এই দায়িত্ব পালন বিশেষ বিশেষ পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। পৃষ্ঠপােষণ পরিবারগুলিকে বলা হয় যজমান পরিবার এবং সেবাদানকারী পরিবারগুলিকে বলা হত কামিন পরিবার। যজমান পরিবারগুলি যেমন ইচ্ছা করলে অন্য কোন পরিবারের সেবা গ্রহণ করতে পারত না, তেমন অন্যদিকে কোনো কামিন পরিবারগুলিতে বংশ পরম্পরায় নির্ধারিত যজমান পরিবারগুলিকে সেবা দান করতে বাধ্য থাকতাে। যেমন— একজন ছুতােরের কৃষিকার্যে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি মেরামত করার দায়িত্ব ছিল, নাপিতের ছিল চুল কাটার দায়িত্ব, রজকের জামা-কাপড় পরিষ্কার করার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু কামিন পরিবারগুলির এই সেবাদান গ্রামের সব পরিবারের প্রতি উন্মুক্ত ছিল না। কেমলমাত্র তাদের যজমান পরিবারগুলিকে তারা শ্রমদানে বাধ্য ছিল। 


যজমানি প্রথার বৈশিষ্ট্য :- 


যজমানী প্রথার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তা নিম্নরূপ : - 

i) পারিবারিক সম্পত্তি :-  যজমানী অধিকারগুলিকে পারিবারিক সম্পত্তি বলে মনে করা হত। কিন্তু  অধিকার উত্তরাধিকার সূত্রে ও পিতা থেকে পুত্রে বর্তায় এবং জমিদারী মালিকানার মতাে যজমানি  অধিকারও একাধিক পুত্রের মধ্যে বন্টিত হয়। 

 ii) নগদ অর্থের প্রচলন ছিল না :-  যজমানী প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যজমানী সম্পর্কের পারস্পরিক আদান-প্রদানে কখনাে নগদ অর্থের প্রচলন ছিল না। পৃষ্টপােষক পরিবারের সাথে কামিন পরিবারের সম্পর্ক কখনােই শ্রমিক মালিক সম্পর্কের মতাে চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক ছিল না। 

iii) আঞ্চলিক বৈচিত্র্য :-  যজমানী প্রথার আরাে একটি বৈশিষ্ট্য হল পৃষ্ঠপােষক পরিবার এবং কামিন পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক আদান প্রদানের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন জাতিগুলির বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ কার্যের পরিবর্তে বিশেষ ধরণের মূল্যদান করা হত।

iv) ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা :- যজমানী প্রথায় আরাে একটি বৈশিষ্ট্য হল Ritual Inter dependents অর্থাৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে বৈষম্য থাকলেও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য উচ্চবর্ণের জাতি, অনুষ্ঠানে যেমন অংশগ্রহণ করতে পারতো তেমনি অত্যন্ত নিম্নবর্ণের এমনকি অস্পৃশ্য জাতিও অংশ গ্রহণ করতে পারত তেমন নিম্নবর্ণের জাতি অনুষ্ঠানেও উচ্চবর্ণের জাতি উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত।

v) শ্রমদানের বিশেষত্ব : - বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা লক্ষ্য করা গেলেও Mandal Brown তাঁর ‘Society in India ’ গ্রন্থে কিছু কিছু জাতির ক্ষেত্রে এইরূপ ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে শ্রমদানের ক্ষেত্রে বিশেষত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন—দক্ষিণ কেরলের রজক জাতি স্তর বিন্যাসের নিম্নস্তরে অবস্থিত জাতিগুলি পরিবারের শ্রমদান করতে বাধ্য থাকে না। এখানে দেখা গেছে যে রজক জাতির মধ্যে বিভিন্ন উপগােষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। যারা স্থানীয় স্তর বিন্যাস অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবারে শ্রমদান করে। 

vi) যজমান পরিবারগুলির প্রতি আনুগত্য :-  যজমান পরিবারগুলির প্রতি কামিন পরিবারগুলির আনুগত্যের নানা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে উত্তর প্রদেশে জৌনপুর জেলার সেনাপুর গ্রামে লােহারদের কথা উল্লেখ করতে হয়। এই লােহারদের কাজ হল বিভিন্ন লােহার জিনিসপত্র তৈরী করা। এর পাশাপাশি কখনাে কখনাে তারা কাঠের জিনিস তৈরী করতাে। এই গ্রামে কোন ছুতাের না থাকায় কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের ঠাকুর সম্প্রদায়ের জন্য লােহার তাদের ঐতিহ্যগত বৃত্তি ছাড়াও ছুতােরের বৃত্তি গ্রহণ করেন। 

vii) অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বােধ :-  উইসলার এর মতে যজমানী প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বােধ। কামিন পরিবারগুলিব ভরণ-পােষণের ব্যবস্থা পূর্ব নির্ধারিত থাকায় একদিকে যেমন যজমানী পিরবারগুলির চাহিদা মেটাবার ব্যবস্থা থাকে  অন্যদিকে কামিন পরিবারগুলিরও জীবিকার নিরাপত্তা ও ভারসাম্য বজায় থাকে।

viii) স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজের অস্তিত্ব :- যজমানি প্রথা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজ ছিল একই মুদ্রার দুই পিঠ। যজমানি প্রথার সফলতার ফলেই ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের অস্তিত্বরক্ষা সম্ভব হয়েছিল।   



You May Also Like

0 comments