জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা ও উপাদান।

by - September 21, 2021

জাতীয় স্বার্থ কাকে বলে ? জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলি আলোচনা কর। 




জাতীয় স্বার্থ :- 


হার্টম্যান বলেছেন , জাতীয় স্বার্থ হল তা-ই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনো রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হয় , তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। 

অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেল মনে করেন , জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক যেভাবে ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে , আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কও সেভাবে জাতি ও রাষ্ট্রের লাভক্ষতির অঙ্ককে সামনে রেখে পরিচালিত হয়। 

হ্যানস মরগেনথাউ এর মতে , ক্ষমতালাভ ও জাতীয় স্বার্থ অভিন্ন। 

ফার্নিস ও স্নাইডার বলেছেন , জাতির প্রয়োজনীয়তা ও আশা আকাঙ্খা জাতীয় নীতি নির্ধারণকারীদের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়েই প্রতিফলিত হয়। এই অর্থে জাতির সিদ্ধান্ত গ্রহনকারীরা যেগুলিকে সংরক্ষণ ও পরিবর্ধন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন - সেগুলিই হল জাতীয় স্বার্থ।    

সুতরাং , জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় নিরাপত্তা , জাতীয় উন্নয়ন , শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যুনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য , যেগুলি পূরণের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ নেয়।

    

জাতীয় স্বার্থের উপাদান :- 


১. ভৌগোলিক অখন্ডতা :- 
দেশের প্রতিরক্ষা ও ভৌগোলিক অখন্ডতাকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রধান উপাদান গঠিত হয়। অনেকে একে জাতীয় নিরাপত্তা বলে অভিহিত করেছেন। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও ভৌগোলিক অখন্ডতা বজায় রাখার বিষয়টিকেই আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। 

২. আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান :- 
জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে , তার সঙ্গে মেলবন্ধন করাই হল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে রেখে বিদেশনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করতে চায়। 

৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন :- 
অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। প্রতিযোগিতা - নির্ভর বিশ্ববাণিজ্যে নিজের স্থান অক্ষুন্ন রাখা , বহিঃবাণিজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জন করা , অবাধ বাণিজ্য ও বিদেশি পুঁজি লগ্নির সুযোগ গ্রহণ করা - ইত্যাদি বিষয়ে সকল রাষ্ট্র বিপুল আগ্রহের সাথে তার জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করে থাকে। 


৪. সাংস্কৃতিক বিনিময় :- 
জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বায়নের নয়া ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এক দেশের সাথে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের বিষয়টি আরো সহজতর হয়েছে। সাংস্কৃতিক আদান - প্রদানের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করে জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য পূরণ করতে চায় প্রতিটি রাষ্ট্র। 

৫. আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ :- 
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি দেশ বিভিন্ন ধরণের আন্তর্জাতিক সংগঠনে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে তার উপর সেই দেশের জাতীয় স্বার্থ পূরণের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই কারণে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। যেমন , সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ পূরণের বিষয়টি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। 

৬. বিশ্ব জনমত :- 
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশ্ব জনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক সংকটের মোকাবিলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্ব জনমত গঠনের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এছাড়া ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই বিস্ফোরণের পর পাক সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ভূমিকা উল্লেখ করা যায়। 

পরিশেষে বলা যায় , জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলোকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় ; এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে , জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলি একমুখী নয় , সেগুলি বহুমুখী। তাই এক্ষেত্রে কোনো একটিমাত্র উপাদানের ভূমিকা যথেষ্ট নয়।     


   

You May Also Like

0 comments