নীলদর্পণ নাটকটি প্রথম কত সালে কোথায় প্রকাশিত হয় ? সংক্ষেপে নীলদর্পণ নাটকটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আলোচনা কর।

by - August 18, 2021

নীলদর্পণ নাটকটি প্রথম কত সালে কোথায় প্রকাশিত হয় ? সংক্ষেপে নীলদর্পণ নাটকটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আলোচনা কর।  




নীলদর্পণ নাটকটি প্রথম কত সালে , কোথায় প্রকাশিত হয় ?
১৮৬০ সালে , ঢাকা থেকে। 

নীলদর্পণ নাটকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব।  

উনিশ শতকে বাংলার নীলচাষীদের ওপর নীলকর সাহেবদের শোষণ , অত্যাচার ও নীলবিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট নাট্যকার ও সমাজসেবক দীনবন্ধু মিত্র '' নীলদর্পণ '' নাটকটি রচনা করেন। ঐতিহাসিক , সামাজিক ও সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে নাটকটির গুরুত্ব অপরিসীম। ঊনিশ শতকে বাংলার সমাজজীবনের চিত্র যেসব সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নাটক 'নীলদর্পণ' । 


নীলচাষীদের দুরাবস্থার বর্ণনা :- 
ঊনিশ শতকে ইউরোপে বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে ইংরেজিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় এসে এখানকার চাষিদের ধানচাষের পরিবর্তে নীলচাষে বাধ্য করে । ফলে চাষীদের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয় ও বাংলার চাষিদের জীবনে চরম দুর্দশা নেমে আসে । ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের জীবনে নেমে আসা দুর্দশার অশ্রুসজল কাহিনি 'নীলদর্পণ' নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয় । চাষিদের জমি থেকে উৎখাত করা, ঘর-বাড়িতে আগুন লাগানো, নীলকুঠিতে চাষিদের ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন প্রভৃতি এই নাটকে তুলে ধরা হয় ।

নীলচাষীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী জনসমক্ষে প্রকাশ ও শিক্ষিত সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়া :-    
'নীলদর্পণ' নাটকে নীলচাষিদের ওপর যে নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয় তা থেকে শিক্ষিত সমাজ নীলচাষিদের ওপর এই অন্যায় অত্যাচার সম্পর্কে জানতে পারে । ফলে বাংলার শিক্ষিত সমাজের তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয় । তীব্র শোষণ ও অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার দরিদ্র নীলচাষিরা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে যা 'নীলবিদ্রোহ' নামে পরিচিত । নীলদর্পণ নাটকে এই বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় ও প্রসারের চিত্র প্রতিফলিত হয় ।


জাতীয়তাবোধের বিকাশ :- 
'নীলদর্পণ' নাটক হল বাংলার প্রথম বাংলা ভাষায় নাটক যা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় । এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং পাদ্রী রেভারেন্ড জেমস লং এর নামে প্রকাশিত হয় ।  ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় এই নাটক অনূদিত হয় । 'নীলদর্পণ' নাটক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলে । এই নাটক বাঙালির মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় । 'নীলদর্পণ' নাটক মানুষের আবেগে কতটা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল তা একটি ঘটনা থেকে জানা যায় । নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সময় দর্শক আসনে বসে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অত্যাচারী নীলকর সাহেব মিস্টার উডের চরিত্রে অভিনয়কারী অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির দিকে জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন ।    

তৎকালীন সামাজিক অবস্থার পরিচয় :-  
নীলদর্পণ নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নীলবিদ্রোহের কাহিনি বর্ণনার দ্বারা সমকালীন সমাজকে তুলে ধরেছেন । তিনি এই নাটকটিতে সমাজের অসহায় ও অত্যাচারিত নীলচাষীদের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনার মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের অসহায় প্রজাদের দুঃসহ লাঞ্ছনা তুলে ধরেছেন । এই নাটকের গোলক বসু, নবীন মাধব, বিন্দু মাধব, সৈরিন্ধ্রী, সাবিত্রী, সরলতা প্রভৃতি চরিত্র বর্ণনার মধ্য দিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ধরা পড়ে । গোলক বসুর সহজ-সরল বিশ্বাস, নবীন মাধবের কর্তব্যবোধ ও পিতৃভক্তি, সৈরিন্ধ্রীর পতিব্রতা, সাবিত্রীর অপত্য স্নেহ বাঙালি সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি মেলে ধরে । দীনবন্ধু মিত্র তার এই নাটকে বাস্তব সমাজ-সমস্যা, সমাজের পরিচিত প্রতিদিনের ঘটনা, চেনামুখ ও তাদের চোখের জল ও মুখের হাসি তুলে ধরেছেন । নীলকরদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সমাজের রায়ত, সম্পন্ন কৃষক ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সকলে একজোট হয়েছিল । তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের ভাষা এই নাটকে ধরা পড়ে ।

নীলবিদ্রোহের পটভূমিকা রচনা :- 
দীনবন্ধু মিত্র রচিত নীলদর্পণ নাটকটি পরোক্ষভাবে নীলবিদ্রোহের পটভূমিকা তৈরী করতে সহায়তা করেছিল। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিবরণ , নীলচাষীদের অসহায় অবস্থার বিবরণ - ইত্যাদি প্রকাশের ফলে জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসকদের এ বিষয়ে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। নীলদর্পণ নাটকটি ভাবজগতে নীলবিদ্রোহের পটভূমিকা রচনা করে। 

ইংরেজ শাসকদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ :- 
নিজেদেরকে সভ্য বলে পরিচয় দেওয়া ইংরেজ শাসকদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশিত প্রকাশিত হয় নাটকটির মাধ্যমে। যে সকল মধ্যবিত্ত বাঙালি মানুষ ব্রিটিশদের শিক্ষা - সংস্কৃতির প্রতি গভীর আস্থাশীল ছিলেন - তাঁদের মোহভঙ্গ ঘটে। 


You May Also Like

0 comments