মধ্যযুগীয় বা ইসলামি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :-

by - July 16, 2021

মধ্যযুগীয় বা ইসলামি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :- 




দীর্ঘ সময়ব্যাপী মধ্যযুগ বা ইসলামি যুগে শিক্ষার ইতিহাস একইসঙ্গে ভাঙা ও গড়ার ইতিহাস। এসময় একদিকে যেমন ধর্মীয় গোঁড়ামি , রাজরোষ ইত্যাদির কারণে ভারতের প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে , অন্যদিকে তেমনি ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর জন্য রাজানুকূল্যে ভারতবর্ষে ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই পরিবর্তনকে বুঝতে হলে ইসলামি শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে জানতে হবে। 


১. শিক্ষার লক্ষ্য :- 
ভারতের মধ্যযুগীয় শিক্ষা তথা ইসলামি যুগে শিক্ষার বিকাশ মূলত মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়  গড়ে উঠেছিল। ভারতের মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামিক শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল , পবিত্র ইসলাম ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার জন্য মানুষকে শিক্ষার ধারা উপযুক্ত করে তোলা। তাই ইসলাম ধর্মে শিক্ষা প্রচারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর অন্যতম মাধ্যম হল শিক্ষা। শিক্ষা তথা জ্ঞান মানুষকে মুক্তির সন্ধান দেয় , ন্যায়-অন্যায় ভালো - মন্দ বিচার করার শক্তি যোগায়। 

২. পাঠক্রম :- 
মধ্যযুগে ইসলামিয় শিক্ষার পাঠক্রম প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার মতোই ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান মক্তবের পাঠক্রম ছিল অনেকটাই গতানুগতিক।  কোরানের নির্বাচিত অংশ থেকে পাঠ মুখস্থ করানো হত। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত নামাজ পড়তে হত।এছাড়া ফতিয়ার মন্ত্রগুলি শিক্ষার্থীরা যাতে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে তা'ও শেখানোর ব্যবস্থা ছিল।  প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম ছিল আরবি। 

মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায় এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামীয় শিক্ষাব্যবস্থায় দুই ধরনের পাঠক্রম অনুসৃত হয়। এদের মধ্যে একটি ধর্মীয় শিক্ষার পাঠক্রম এবং অন্যটি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পাঠক্রম। এই পাঠক্রমগুলির মেয়াদ ছিল বারো বছর। 
(ক ) ধর্মীয় শিক্ষার পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল ধর্মতত্ত্ব ও কোরান পাঠ , কোরানের ব্যাখ্যা , হযরত মহম্মদের বাণী আলোচনা , ইসলামীয় আইন ইত্যাদি। 
(খ ) ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল - সাহিত্য , জ্যোতির্বিদ্যা , প্রশাসন বিজ্ঞান , পাটিগণিত , বীজগণিত , জ্যামিতি , নীতিবিদ্যা , দর্শন , প্রাকৃতিক বিজ্ঞান , কৃষিবিজ্ঞান , চিকিৎসাশাস্ত্র ,  ইতিহাস , ভূগোল , অর্থনীতি - প্রভৃতি। 


৩. ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান :- 
হিন্দুদের যেমন হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যারম্ভ বা শিক্ষার সূচনা হত , তেমনি ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থাতেও একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুরু হত। অনুষ্ঠানটিকে বলা হত - ' বিসমিল্লাহ অনুষ্ঠান। '  শিশুর চার বছর চার মাস চার দিন হলে তাকে রঙিন পোশাক পরিয়ে শিক্ষক তথা মৌলবীর সামনে বসানো হত এবং একটি রুপোর ফলকের ওপরে কোরানের একটি পংক্তি বারবার শিশুকে মুখস্থ করাতেন মৌলবি। এইভাবে মক্তবের শিশুর বিদ্যারম্ভের অনুষ্ঠান হত। 

৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :- 
মধ্যযুগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামিয় শিক্ষা দেওয়া হত। গৃহে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মক্তব এবং মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা গড়ে উঠেছিল। ধনী ব্যক্তিরা তাদের শিশুর পড়াশোনার জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করতেন। শাসক সুলতানদের সন্তানের পঠন-পাঠন হারেম -এ শুরু হত। তাদের শিক্ষার জন্য একজন খোঁজা নিয়োগ করা হত। 

মধ্যযুগে নিয়মতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিশুকে মক্তবে পাঠানো হত। ইসলামীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে মাদ্রাসা বলা হত। মক্তব ও মাদ্রাসার পাশাপাশি মধ্যযুগে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে অনেকগুলি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ওই প্রতিষ্ঠানগুলি কোন ধর্মগুরুকে কেন্দ্র করে দরগার মাধ্যমে পরিচালিত হত। ভারতের জৌনপুর , অযোধ্যা প্রভৃতি স্থানে ওই ধরনের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। 

৫. শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক :- 
প্রাচীন যুগের মত মধ্যযুগেও শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর ও মধুর। ইসলামি অনুশাসনে উলেমাদের অবশ্যই সৎ চরিত্রের হতে হত। চরিত্রবান শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পিতা - পুত্রের মতো সম্পর্ক ছিল। শিক্ষকের স্নেহের ছায়ায় শিক্ষার্থীর নৈতিক জীবন গড়ে উঠত এবং শিক্ষার্থীও তাকে পিতৃতুল্য বলে মনে করত। অনেক মাদ্রাসায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একত্রে বসবাস করত। 

৬. শিক্ষাদান পদ্ধতি :- 
মক্তবের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল মৌখিক। পড়া মুখস্থ করানোই শিক্ষকের প্রধান কাজ ছিল। মক্তবে  সাধারণত কোনো লিখিত বই অনুসরণ করা হত না। পাঠকালে শুনেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করত।শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল যান্ত্রিক। 

মাদ্রাসার শিক্ষাদান পদ্ধতিও মূলত ছিল মৌখিক। শিক্ষার মাধ্যম ছিল ফারসি ভাষা। শিক্ষকগণ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বক্তৃতা পদ্ধতির প্রয়োগ করতেন। মুখস্ত ছিল শিখনের প্রধান পদ্ধতি। তর্কবিদ্যা , দর্শন , ধর্ম প্রভৃতি বিষয়গুলি শিক্ষাদানের জন্য আলোচনাচক্রের ব্যবস্থা করা হত। 


৭. শৃঙ্খলা :- 
শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশ ইসলামীয় শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। মক্তবে কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলা হত। অপরাধপ্রবণতা , স্কুল পালানো - এই সকল ছাত্রদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। দৈহিক শাস্তি কখনো কখনো নির্দয়তার স্তরে পৌঁছে যেত। মক্তবের মতো মাদ্রাসাতেও কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রক্ষা করা হত। 

৮. শিক্ষার সুযোগ :- 
ইসলামি যুগে মক্তবের শিক্ষা সকলের জন্য হলেও মাদ্রাসার শিক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাকেন্দ্র খুব কম সংখ্যক থাকায় উচ্চশিক্ষার নিদারূণ অভাব দেখা যায়। সার্বিকভাবে মধ্যযুগে হিন্দুদের শিক্ষার সুযোগ হ্রাস পায়। পাঠশালা , টোল , চতুষ্পাঠী - ইত্যাদি থাকলেও সেগুলির অবস্থা ভাল ছিল না। 

৯. নারী শিক্ষা :- 
ইসলামি অনুশাসনে নারীশিক্ষা অবৈধ ছিল না। তাই প্রথমদিকে ফাতিমা , হামিদা , সোফিয়ার মত বিদুষী নারীর কথা শোনা যায়। পরে পর্দা প্রথা চালু হওয়ায় সাধারণ নারী শিক্ষা সংকুচিত হলেও উচ্চবংশের মেয়েদের অন্দরমহলে শিক্ষার জন্য উলেমা এবং চারুকলা শিক্ষার জন্য ওস্তাদ নিয়োগ করা হত।রাজপরিবারের মহিলাদের মধ্যে সুলতানা রাজিয়া , বাবরকন্যা গুলবদন বেগম , শাহজাহান কন্যা জাহানারা বেগম প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে মুসলিম শাসনকালে হিন্দুসমাজ যথেষ্ট রক্ষণশীল হয়ে ওঠে আর এই রক্ষনশীলতার প্রধান বলি হয় নারীশিক্ষা। 

১০. মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ডিগ্রী প্রদান :- 
ইসলামিয় শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক যুগের মতো পরীক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না। শিক্ষকরা ছাত্রদের যে দৈনন্দিন পাঠ প্রদান করতেন ছাত্ররা তা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারছে কিনা তা তারা বিচার করে দেখতেন। শিক্ষার্থীদের ত্রুটিগুলি পর্যালোচনা করে সংশোধনে সাহায্য করতেন। মূল্যায়নের জন্য নির্দিষ্ট সময় ধার্য থাকত না। যেকোনো বিশেষ ক্ষেত্রে যোগ্যতার নিরিখেই শংসাপত্র দেওয়া হত। 

শিক্ষাশেষে ডিগ্রী প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। যারা ধর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতেন তাদের 'আলিম'  উপাধি , যারা যুক্তিশিক্ষায় বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতেন তাদের ' ফাজিল ' উপাধি এবং যারা সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শিতা দেখাতেন তাদের ' কাবিল ' উপাধি প্রদান করা হত। 

You May Also Like

0 comments