শরৎ সাহিত্যে প্রেমের উপন্যাস '' পন্ডিতমশাই '' :-

by - July 21, 2021

শরৎ সাহিত্যে প্রেমের উপন্যাস '' পন্ডিতমশাই '' :- 





'পন্ডিতমশাই' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়ের লেখা উপন্যাস। উপন্যাসটির পটভূমি আর প্রকাশকালের মাঝে অবিচ্ছেদ্য এক ধরণের মিল আছে। মূলত ১৯১৪ সালের সময়টাতে, যখন বঙ্গদেশের সন্তানেরা মোটামুটি পড়ালেখা শিখে শহরমুখী হচ্ছে, সে সময়টার গ্রামাঞ্চলের পটভূমিতে লেখা একটি উপন্যাস 'পন্ডিতমশাই'।



'পন্ডিতমশাই' নামটি শুনে উপন্যাসটি সম্বন্ধে অযথা কিছু আন্দাজ করবার চেষ্টা করলে ভুল করা হবে । নামটি এসেছে মূলত উপন্যাসের একটি চরিত্র থেকে যার নাম বৃন্দাবন অধিকারী। বৈষ্ণ সম্প্রদায়ের বৃন্দাবন মূলত নীচু শ্রেণির মানুষের পড়ালেখার নিমিত্তে তার নিজের খরচে নিজ গৃহে একটি পাঠশালা খুলে বসেন , যেটির জন্যে বাচ্চাদের পড়ালেখার সরঞ্জামের টাকা অব্দি ধনী বৃন্দাবন দিত৷ দেশমাতৃকার  জন্যে গভীর দায়িত্ববোধসম্পন্ন এই স্ব-প্রণোদিত 'পন্ডিতমশাই' এর নামেই উপন্যাসটির নাম হলেও উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পঞ্চদশী কিশোরী কুসুম৷

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যাদের অন্যান্য উপন্যাসের নারী চরিত্রের সাথে কুসুমের কিঞ্চিৎ মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ কুসুমের বাল্য ইতিহাস তার অজানা, সেই অজানা ইতিহাস সে সময়কার গ্রামসমাজ এমন নোংরামিতে ভরপুর রেখেছে যে উপন্যাসের শেষদিকে কুসুমের মাঝে তীব্র অস্তিত্ব-সংকট চোখে পড়ে৷ কুসুম মূলত দৃঢ়চেতা এবং নিজ খেয়ালকে গুরুত্ব দেওয়া এক কিশোরী। নিজেকে নিয়ে সে সদা পরিষ্কার থাকলেও তার আত্মাভিমান তাকে উপন্যাসের শুরুতেই মিলনাত্মক পরিণতিতে পৌছাতে দেয়নি৷ অবশ্য, এই তীব্র রূপের অধিকারী কিশোরীর এমন আত্মাভিমান জন্ম না নিলে খুব সম্ভবত এই উপন্যাসটি এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেত না৷

কুসুমের ভাই কুঞ্জ। কুঞ্জের চরিত্রে উপন্যাসে তিন ধরণের পরিবর্তন চোখে পড়ে। প্রথমদিকে সে ছোটবোনের স্নেহানুগত হলেও মাঝামাঝি দিকে তার মাঝে চিরায়ত বাঙালিসমাজের একটা ছাপ আমরা দেখতে পাব৷ মানুষ অর্থযশ আর খ্যাতিতে বদলে যায়, কুঞ্জের ক্ষেত্রেও তার কোনরকম নড়চড় হয়নি৷ যদিও তার ছোটবোনের প্রতি তীব্র স্নেহ্ন তাকে শেষ দিকে উপস্থাপন করেছে অন্যভাবে৷ 

এই তিন প্রধান চরিত্র নিয়ে উপন্যাসটি গড়ে উঠলেও এতে আরো কিছু শক্তিশালী চরিত্রের আনাগোনা দেখা যায়৷ উপন্যাসটির আরো গভীরে গেলে আমরা দেখতে পাব পুরো কাহিনীতে কুঞ্জনাথ চরিত্রটি সর্বদা থেকে গেলেও মূল উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে কুসুম ও বৃন্দাবনকে ঘিরেই। এটুকুতে যদি কেউ এটিকে রোমান্টিক উপন্যাস বলে মনে করেন, অবশ্যই ভুল করবেন। এটি মোটেও রোমান্টিক উপন্যাস নয়, আবার পুরোদস্তুর সামাজিক উপন্যাসও নয়। মূলত পুরো উপন্যাস জুড়েই বৃন্দাবন ও কুসুমের জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলা করা হয়েছে। উপন্যাসের প্রথমেই কুসুম ও বৃন্দাবনের মধ্যে যে সম্পর্ক উল্লেখ করা হয়েছে সেটিও পুরো উপন্যাসে অনিশ্চয়তার দোলাচলে পাক খেয়েছে। পাঁচ বছর বয়সে কুসুমের সাথে বৃন্দাবনের বিয়ে হবার পর যে তা অনাকাঙখিত এক কারণে মাত্র কিছুদিন পরই ভেঙে যায়। 

এ উপন্যাসে কুসুমের অপরিসীম মাতৃহৃদয়ের এক গল্প জানা যায় । কুসুমের আত্মাভিমান কিংবা পর্বতপ্রমাণ অভিমানের সাথে বৃন্দাবনের মোড় খাওয়া চরিত্রটি উপন্যাসের সাথে বেশ ভালভাবেই পরিণতির দিকে এগোতে থাকে । শেষ অব্দি উপন্যাসটিকে বিরহের ছকে ফেলে দিলেও মিলনাত্মক বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে। খুব সম্ভবত এর দায়ভার শরৎচন্দ্র পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। সুতরাং উপন্যাসটিকে পুরোপুরি প্রেমের উপন্যাস না বলে বৃন্দাবন ও কুসুমের মধ্যে ঘটে চলা জটিল প্রেমের জটিল সমীকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। 

You May Also Like

0 comments