Pages

Powered by Blogger.
1ST SEMESTER SUGGESTION 2 ND YEAR SUGGESTION 2ND SEMESTER 3RD SEMESTER BENGALI NOTES CU suggestion. EDUCATION NOTES ENGLISH COMPULSORY GBU Suggestion. HISTORY EUROPE & WORLD HISTORY NOTES POL SC NOTES SOCIOLOGY NOTES WBCS 2020

NANDAN DUTTA

A new approach for exam notes .

B.A. 1 ST SEMESTER SUGGESTION  


গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে B.A. কোর্সে  CBCS SYSTEM চালু হওয়ার এটি প্রথম বছর। এখানে HISTORY , EDUCATION , ELECTIVE BENGALI , SOCIOLOGY , POLITICAL SCIENCE  বিষয়ের SUGGESTION দেওয়া হলো।নিশ্চিতভাবে এই প্রশ্নগুলি তোমাদের 1ST SEMESTER এর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে দেওয়া SUGGESTION গুলি প্রতিনিয়ত পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হবে। তাই UPDATED SUGGESTION পেতে তোমাদের নিয়িমিত ওয়েবসাইট লক্ষ্য রাখতে হবে।  
 
যে বিষয়ের SUGGESTION  জানতে চাও তার উপর CLICK করো। 

HISTORY DC

HISTORY GE

EDUCATION DC 

SOCIOLOGY GE1

SOCIOLOGY DC

ELECTIVE BENGALI PAPER 101
Share
Tweet
Pin
Share
3 comments
CBCS 3RD SEMESTER BENGALI ( CODE 301 )  

দেনাপাওনা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

 পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপ-মায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিলেন নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনও শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুর-দেবতার নামই প্রচলিত ছিল— গণেশ কার্তিক পার্বতী তাহার উদাহরণ।

 এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামসুন্দর মিত্র অনেক খোঁজ করেন কিন্তু পাত্র কিছুতেই মনের মতন হয় না। অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। উক্ত রায়বাহাদুরের পৈতৃক বিষয়-আশয় যদিও অনেক হ্রাস হইয়া আসিয়াছে কিন্তু বনেদী ঘর বটে।

 বরপক্ষ হইতে দশ হাজার টাকা পণ এবং বহুল দানসামগ্রী চাহিয়া বসিল। রামসুন্দর কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া তাহাতেই সম্মত হইলেন; এমন পাত্র কোনোমতে হাতছাড়া করা যায় না।

 কিছুতেই টাকার জোগাড় আর হয় না। বাঁধা দিয়া, বিক্রয় করিয়া, অনেক চেষ্টাতেও হাজার ছয়-সাত বাকি রহিল। এ দিকে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিয়াছে।

 অবশেষে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। নিতান্ত অতিরিক্ত সুদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল, কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না। বিবাহসভায় একটা তুমুল গোলযোগ বাধিয়া গেল। রামসুন্দর আমাদের রায়বাহাদুরের হাতে-পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া যাক, আমি নিশ্চয় টাকাটা শোধ করিয়া দিব।” রায়বাহাদুর বলিলেন, “টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না।”

 এই দুর্ঘটনায় অন্তঃপুরে একটা কান্না পড়িয়া গেল। এই গুরুতর বিপদের যে মূল কারণ সে, চেলি পরিয়া, গহনা পরিয়া, কপালে চন্দন লেপিয়া, চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাবী শ্বশুরকুলের প্রতি যে তাহার খুব-একটা ভক্তি কিম্বা অনুরাগ জন্মিতেছে, তাহা বলা যায় না।

 ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হইল। বর সহসা তাহার পিতৃদেবের অবাধ্য হইয়া উঠিল। সে বাপকে বলিয়া বসিল, “কেনাবেচা-দরদামের কথা আমি বুঝি না; বিবাহ করিতে আসিয়াছি, বিবাহ করিয়া যাইব।”

 বাপ যাহাকে দেখিল তাহাকেই বলিল, “দেখেছেন মহাশয়, আজকালকার ছেলেদের ব্যবহার?” দুই-একজন প্রবীণ লোক ছিল, তাহারা বলিল, “শাস্ত্রশিক্ষা নীতিশিক্ষা একেবারে নাই, কাজেই।”

 বর্তমান শিক্ষার বিষময় ফল নিজের সন্তানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়া রায়বাহাদুর হতোদ্যম হইয়া বসিয়া রহিলেন। বিবাহ একপ্রকার বিষণ্ণ নিরানন্দ ভাবে সম্পন্ন হইয়া গেল।

 শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নিরুপমাকে বুকে টানিয়া লইয়া বাপ আর চোখের জল রাখিতে পারিলেন না। নিরু জিজ্ঞাসা করিল, “তারা কি আর আমাকে আসতে দেবে না, বাবা।” রামসুন্দর বলিলেন, “কেন আসতে দেবে না, মা। আমি তোমাকে নিয়ে আসব।”

 রামসুন্দর প্রায়ই মেয়েকে দেখিতে যান কিন্তু বেহাইবাড়িতে তাঁর কোনো প্রতিপত্তি নাই। চাকরগুলো পর্যন্ত তাঁহাকে নিচু নজরে দেখে। অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাঁচ মিনিটের জন্য কোনোদিন-বা মেয়েকে দেখিতে পান, কোনোদিন-বা দেখিতে পান না।

 কুটুম্বগৃহে এমন করিয়া আর অপমান তো সহা যায় না। রামসুন্দর স্থির করিলেন, যেমন করিয়া হউক টাকাটা শোধ করিয়া দিতে হইবে।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো।

 কিন্তু যে ঋণভার কাঁধে চাপিয়াছে তাহারই ভার সামলানো দুঃসাধ্য। খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানি পড়িয়াছে এবং পাওনাদারদের দৃষ্টিপথ এড়াইবার জন্য সর্বদাই নানারূপ হীন কৌশল অবলম্বন করিতে হইতেছে।

 এ দিকে শ্বশুরবাড়ি উঠতে বসিতে মেয়েকে খোঁটা লাগাইতেছে। পিতৃগৃহের নিন্দা শুনিয়া ঘরে দ্বার দিয়া অশ্রুবিসর্জন তাহার নিত্যক্রিয়ার মধ্যে দাঁড়াইয়াছে।

 বিশেষত শাশুড়ির অক্রোশ আর কিছুতেই মেটে না। যদি কেহ বলে, “আহা, কী শ্রী। বউয়ের মুখখানি দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়।” শাশুড়ি ঝংকার দিয়া উঠিয়া বলে, “শ্রী তো ভারি। যেমন ঘরের মেয়ে তেমনি শ্রী।”

 এমনকি, বউয়ের খাওয়াপরারও যত্ন হয় না। যদি কোনাে দয়াপরতন্ত্র প্রতিবেশিনী কোনো ত্রুটির উল্লেখ করে, শাশুড়ি বলে, “ওই ঢের হয়েছে।” অর্থাৎ, বাপ যদি পুরা দাম দিত তো মেয়ে পুরা যত্ন পাইত। সকলেই এমন ভাব দেখায় যেন বধূর এখানে কোনো অধিকার নাই, ফাঁকি দিয়া প্রবেশ করিয়াছে।

 বোধ হয়, কন্যার এই-সকল অনাদর এবং অপমানের কথা বাপের কানে গিয়া থাকিবে। তাই রামসুন্দর অবশেষে বসতবাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 কিন্তু ছেলেদের যে গৃহহীন করিতে বসিয়াছেন সে কথা তাহদের নিকট হইতে গোপনে রাখিলেন। স্থির করিয়াছিলেন, বাড়ি বিক্রয় করিয়া সেই বাড়িই ভাড়া লইয়া বাস করিবেন; এমন কৌশলে চলিবেন যে, তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে এ কথা ছেলেরা জানিতে পরিবে না।

 কিন্তু ছেলেরা জানিতে পারিল। সকলে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল। বিশেষত বড়ো তিনটি ছেলে বিবাহিত এবং তাহাদের কাহারো-বা সন্তান আছে। তাহাদের আপত্তি অত্যন্ত গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল, বাড়িবিক্রয় স্থগিত হইল।

 তখন রামসুন্দর নানা স্থান হইতে বিস্তর সুদে অল্প অল্প করিয়া টাকা ধার করিতে লাগিলেন। এমন হইল যে, সংসারের খরচ আর চলে না।

 নিরু বাপের মুখ দেখিয়া সব বুঝিতে পারিল। বৃদ্ধের পক্ব কেশে, শুষ্ক মুখে এবং সদাসংকুচিত ভাবে দৈন্য এবং দুশ্চিন্তা প্রকাশ হইয়া পড়িল। মেয়ের কাছে যখন বাপ অপরাধী তখন সে অপরাধের অনুতাপ কি আর গোপন রাখা যায়। রামসুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের জন্য কন্যার সাক্ষাৎলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে তাহা তাঁহার হাসি দেখিলেই টের পাওয়া যাইত।

 সেই ব্যথিত পিতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দিবার উদ্দেশে দিনকতক বাপের বাড়ি যাইবার জন্য নিরু নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছে। বাপের ম্লান মুখ দেখিয়া সে আর দূরে থাকিতে পারে না। একদিন রামসুন্দরকে কহিল, “বাবা, আমাকে একবার বাড়ি লইয়া যাও।” রামসুন্দর বলিলেন, “আচ্ছা।”


 কিন্তু তাঁহার কোনো জোর নাই— নিজের কন্যার উপরে পিতার যে স্বাভাবিক অধিকার আছে তাহা যেন পণের টাকার পরিবর্তে বন্ধক রাখিতে হইয়াছে। এমন কি, কন্যার দর্শন সেও অতি সসংকোচে ভিক্ষা চাহিতে হয় এবং সময়বিশেষে নিরাশ হইলে দ্বিতীয় কথাটি কহিবার মুখ থাকে না।

কিন্তু মেয়ে আপনি বাড়ি আসিতে চাহিলে বাপ তাহাকে না আনিয়া কেমন করিয়া থাকে। তাই বেহাইয়ের নিকট সে সম্বন্ধে দরখাস্ত পেশ করিবার পূর্বে রামসুন্দর কত হীনতা, কত অপমান, কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনটি হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো।

 নোট-কখানি রুমালে জড়াইয়া চাদরে বাঁধিয়া রামসুন্দর বেহাইয়ের নিকট গিয়া বসিলেন। প্রথমে হাস্যমুখে পাড়ার খবর পাড়িলেন। হরেকৃষ্ণের বাড়িতে একটা মস্ত চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহার আদ্যোপান্ত বিবরণ বলিলেন; নবীনমাধব ও রাধামাধব দুই ভাইয়ের তুলনা করিয়া বিদ্যাবুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে রাধামাধবের সুখ্যাতি এবং নবীনমাধবের নিন্দা করিলেন; শহরে একটা নূতন ব্যামো আসিয়াছে, সে সম্বন্ধে অনেক আজগবি আলোচনা করিলেন; অবশেষে হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কথায় কথায় বলিলেন, “হাঁ হাঁ, বেহাই, সেই টাকাটা বাকি আছে বটে। রোজই মনে করি, যাচ্ছি অমনি হাতে করে কিছু নিয়ে যাই, কিন্তু সময়কালে মনে থাকে না। আর ভাই, বুড়ো হয়ে পড়েছি।” এমনি এক দীর্ঘ ভূমিকা করিয়া পঞ্জরের তিনখানি অস্থির মতো সেই তিনখানি নোট যেন অতি সহজে অতি অবহেলে বাহির করিলেন। সবেমাত্র তিন হাজার টাকার নোট দেখিয়া রায়বাহাদুর অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 

 বলিলেন, “থাক্ বেহাই, ওতে আমার কাজ নেই।” একটা প্রচলিত বাংলা প্রবাদের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, সামান্য কারণে হাতে দুর্গন্ধ করিতে তিনি চান না।

 এই ঘটনার পরে মেয়েকে বাড়ি আনিবার প্রস্তাব কাহারও মুখে আসে না— কেবল রামসুন্দর ভাবিলেন, ‘সে-সকল কুটুম্বিতার সংকোচ আমাকে আর শোভা পায় না।’ মর্মাহতভাবে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে মৃদুস্বরে কথাটা পাড়িলেন। রায়বাহাদুর কোনো কারণমাত্র উল্লেখ না করিয়া বলিলেন, “সে এখন হচ্ছে না।” এই বলিয়া কর্মোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন।

 রামসুন্দর মেয়ের কাছে মুখ না দেখাইয়া কম্পিত হস্তে কয়েকখানি নোট চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না।

 বহুদিন গেল। নিরুপমা লোকের উপর লোক পাঠায় কিন্তু বাপের দেখা পায় না। অবশেষে অভিমান করিয়া লোক পাঠানো বন্ধ করিল— তখন রামসুন্দরের মনে বড়ো আঘাত লাগিল, কিন্তু তবু গেলেন না।

 আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বললেন, ‘এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি—’। খুব একটা শক্তরকম শপথ করিলেন।

 পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল “দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস?” বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনি আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই।

 রামসুন্দর তাহা জানিতেন, এবং সে সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসামান্য অলংকারে অনুগ্রহপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, এ কথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক་ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর-কোনো ফল হয় নাই।

 দৈন্যপীড়িত গৃহের ক্রন্দনধ্বনি কানে লইয়া বৃদ্ধ তাঁহার বেহাইবাড়িতে প্রবেশ করিলেন। আজ তাঁহার সে সংকোচভাব নাই; দ্বাররক্ষী এবং ভৃত্যদের মুখের প্রতি সে চকিত সলজ্জ দৃষ্টিপাত দূর হইয়া গিয়াছে, যেন আপনার গৃহে প্রবেশ করিলেন। শুনিলেন, রায়বাহাদুর ঘরে নাই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে। মনের উচ্ছ্বাস সম্বরণ করিতে না পারিয়া রামসুন্দর কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। আনন্দে দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বাপও কাঁদে, মেয়েও কাঁদে; দুইজনে কেহ আর কথা কহিতে পারে না। এমন করিয়া কিছুক্ষণ গেল। তার পরে রামসুন্দর কহিলেন, “এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি, মা। আর কোনো গোল নাই।”

 এমন সময়ে রামসুন্দরের জ্যেষ্ঠপুত্র হরমোহন তাঁঁহার দুটি ছোটো ছেলে সঙ্গে লইয়া সহসা ঘরে প্রবেশ করিলেন। পিতাকে বলিলেন, “বাবা, আমাদের তবে এবার পথে ভাসালে?”

 রামসুন্দর সহসা অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন, “তোদের জন্য কি আমি নরকগামী হব। আমাকে তোরা আমার সত্য পালন করতে দিবি নে?” রামসুন্দর বাড়ি বিক্রয় করিয়া বসিয়া আছেন; ছেলেরা কিছুতে না জানিতে পায় তাহার অনেক ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, কিন্তু তবু তাহারা জানিয়াছে দেখিয়া তাহদের প্রতি হঠাৎ অত্যন্ত রুষ্ট ও বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।

 তাঁহার নাতি তাঁহার দুই হাঁটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, “দাদা, আমাকে গাড়ি কিনে দিলে না?”

 নতশির রামসুন্দরের কাছে বালক কোনো উত্তর না পাইয়া নিরুর কাছে গিয়া বলিল, “পিসিমা, আমাকে একখানা গাড়ি কিনে দেবে?”

 নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল, “বাবা, তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না, এই তোমার গা ছুঁয়ে বললুম।”

 রামসুন্দর বলিলেন, “ছি মা, অমন কথা বলতে নেই। আর, এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তা হলে তোর বাপের অপমান, আর তোরও অপমান।”

 নিরু কহিল, “টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না। তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না।”

 রামসুন্দর কহিলেন, “তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না, মা।”

 নিরুপমা কহিল, “না দেয় তো কী করবে বলো। তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ো না।”

 রামসুন্দর কম্পিত হস্তে নোটবাঁধা চাদরটি কাঁধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন।


 কিন্তু রামসুন্দর এই-যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন, সে কথা গোপন রহিল না। কোনো স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণ দাসী নিরুর শাশুড়িকে এই খবর দিল। শুনিয়া তাঁহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না।

নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল। এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে, এবং পাছে সংসর্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয় এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে।

 এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল। কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত। কার্তিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা, শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই। আহারের নিয়ম নাই। দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া, তাহাও সে করিত না। সে-যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে, এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল। কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না। যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন তবে শাশুড়ি বলিতেন, “নবাবের বাড়ির মেয়ে কিনা! গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না।” কখনো-বা বলিতেন, “দেখো-না একবার, ছিরি হচ্ছে দেখো-না, দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে।”

 রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন, “ওঁর সমস্ত ন্যাকামি।” অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল, “বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব, মা।” শাশুড়ি বলিলেন, “কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল৷”

 কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না— যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল, এবং সেই দিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল।


 বাড়ির বড়ো বউ মরিয়াছে, খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল। প্রতিমাবিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরীদের যেমন লোকবিখ্যাত প্রতিপত্তি আছে, বড়োবউয়ের সৎকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটা খ্যাতি রটিয়া গেল— এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনও দেখে নাই। এমন ঘটা করিয়া শ্রাদ্ধও কেবল রায়বাহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব, এবং শুনা যায়, ইহাতে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল।

 রামসুন্দরকে সান্ত্বনা দিবার সময়, তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে, সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল।

এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল, “আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি, অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে।” রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন, “বাবা, তোমার জন্যে আর-একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে।”

 এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 


Share
Tweet
Pin
Share
No comments

WBCS  Previous years question papers.



  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2020 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2020 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2019 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2019 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2018 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2018 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2017 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2017 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2016 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2016 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2015 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2015 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2014 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Question Paper 2014 (Beng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2013 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam-2013 (Beng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2012 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2012 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2011 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2011 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2010 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2010 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2009 (English Version)
  • WBCS Preliminary Exam Solved Question Paper 2009 (Bengali Version)
  • WBCS Preliminary Exam-2008 (Beng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2008 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2007 (Beng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2007 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2006 (Beng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2006 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2000 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2001 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2002 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2003 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2004 (Eng Ver)
  • WBCS Preliminary Exam-2005 (Eng Ver)
Share
Tweet
Pin
Share
No comments

নিমগাছ - লেখক বনফুল  [ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ]


কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে।
পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ।
কেউ বা ভাজছে গরম তেলে।
খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে।
চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ।
কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে।
এমনি কাঁচাই…..

কিংবা ভেজে বেগুন- সহযোগে।
যকৃতের পক্ষে ভারী উপকার।
কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক…। দাঁত ভালো থাকে।
কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুসী হন।
বলেন-“নিমের হওয়া ভাল, থাক, কেটো না।”
কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না।
আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।
শান দিয়ে বাধিয়েও দেয় কেউ- সে আর এক আবর্জনা।
হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরণের লোক এল।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে বেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু।
বলে উঠলো, “বাঃ কি সুন্দর পাতাগুলো…..কি রূপ। থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার….এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ–”
খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল।`
কবিরাজ নয়, কবি।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না।মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ীর গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্ণী বউটার ঠিক এই দশা।

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 
Share
Tweet
Pin
Share
No comments

GBU 2ND YEAR SUGGESTION

Gour Banga University

Here you can check-out the suggestion of different subjects like  Education , Political Science ,History , Sociology , Elective Bengali , Elective Sanskrit . 

Education Suggestion CLICK HERE

Political Science suggestion  CLICK HERE

History Suggestion CLICK HERE

Sociology Suggestion CLICK HERE

Test your MCQ Online CLICK HERE


Share
Tweet
Pin
Share
1 comments

CBCS 3RD SEMESTER POLITICAL SCIENCE SUGGESTION


১. ব্রিটেনে লর্ড সভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।

২. ব্রিটেনে কমন্স সভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।

৩. মার্কিন শাসনব্যবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করো।

৪. মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।

To be continued.................

অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK কর।



Share
Tweet
Pin
Share
No comments
CBCS 3RD SEMESTER BENGALI 
চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ - সুবোধ ঘোষ।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 

আমাদের ক্লাসটা ছিল একটি নৃতত্বের ল্যাবরেটরির মতো। এমন বিচিত্র মানবতার নমুনা আর কোন্ স্কুলে কোন্‌  ক্লাসে আছে জানি না। তিনটি রাজার ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে। একজন জংলি রাজার ছেলে, কুচকুচে কালো চেহারা। আর দুজন ছিল সত্যিকারের ক্ষত্রিয়াত্মজ – সুগৌর গায়ের রং, পাগড়িতে সাঁচ্চা মোতির ঝালর ঝুলতো। তা ছাড়া ছিল – সিরিল টিগ্‌গা, ইমানুয়েল খাল্‌খো, জন বেস্‌রা, রিচার্ড টুডু আর স্টিফান হোরো এবং আরো অনেক। এত ওরাওঁ আর মুন্ডা সন্তানের সমাবেশের মাঝখানে তবু আমরা কজন ইন্টার ক্লাস পরিবারের বাঙালি ও বিহারি ছেলে শুধু বুদ্ধির জোরে সর্বকর্মের মোড়লির গৌরব অধিকার করে বসেছিলাম। রাজার ছেলেগুলাকে আমরা বলতাম সোনা ব্যাঙ, আর মুন্ডা ও ওরাওঁদের বলতাম কোলা ব্যাঙ। ওদের কাউকে আমরা কোনো দিন গ্রাহ্যের মধ্যে আনতাম না। রাজার ছেলেগুলি অবশ্য আমাদের সঙ্গে কথা বলত না। অপরপক্ষে টিগ্‌গা, খালখো, বেসরা, টুডু – ওরা আমাদের সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারলে ধন্য হয়ে যেত। টিফিনের সময় একটা আনি নিয়ে টুডুকে দিতাম। বলতাম – টুডু, চট করে এক দৌড়ে এই এক আনার ঝালবাদাম নিয়ে এসো তো। গঙ্গা সাহুর দোকান থেকে আনবে।

স্কুল থেকে গঙ্গা সাহুর দোকান দেড় মাইল হবে। কৃতার্থভাবে আনিটা হাতে তুলে নিয়ে টুডু সেই প্রচন্ড রোদে ঝলসানো মাঠের ওপর দিয়ে পোড়া হরিণের মতো উদ্দাম বেগে দৌড়ে চলে যেত গঙ্গা সাহুর দোকানে। ফিরে এসে ঝালবাদামের ঠোঙাটা আমাদের হাতে সঁপে দিয়ে নিজে দূরে সরে যেত। আমরা বলতাম – কী আশ্চর্য টুডু, এতটা পথ দৌড়ে এলে তবু তুমি একটুও হাঁপাচ্ছো না।

এই ফাঁকা কথার কারসাজিটাকে আন্তরিক অভিনন্দন মনে করেই টুডু দূরে দাঁড়িয়ে গর্বভরে হাসত ! আমরা চোখ টিপে লক্ষ করতাম – টুডু কেমন জোর করে তার পরিশ্রান্ত শ্বাসবায়ুটাকে ঢোঁক গিলে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তাকে ঝালবাদামের একটু শেয়ার দিতে আমরা বোধ হয় ইচ্ছে করেই ভুলে যেতাম। দিতে গেলেও টুডু নিত না।

আমরা দেখতাম, একটু দূরে দাঁড়িয়ে সুতীব্র একটা দৃষ্টি দিয়ে স্টিফান হোরো আমাদের হাবভাব লক্ষ করছে। আমরা ঘাবড়ে যেতাম। স্টিফান যেন তির মেরে আমাদের বুকের ভেতরে ধূর্ত রসিকতায় তৈরি ফুসফুসটাকে খোঁচা মেরে দেখছে। সব বুঝে ফেলতে পারছে। কিন্তু সবার মধ্যে একমাত্র স্টিফানই পারে, আর কেউ নয়?

টুডু, খাল্‌খো, টিগ্‌গা, বেসরা সকলেই কতকটা এই রকমেরই বাধ্য বেকুব বিশ্বাসী আর নিরীহ ছিল। আমরা মনে মনে হাসতাম। – হায়রে, রাঁচির জঙ্গলের যত কোল, যত সব কোলা ব্যাঙ !

ওদের মধ্যে ওই একটিমাত্র কাল কেউটে ছিল, স্টিফান হোরো। বড়ো উদ্ধত ছিল স্টিফানের স্বভাবটা। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, হোরোর কাছে আমাদের আভিজাত্য চুপে চুপে হার মেনে নিত। ওর সঙ্গে সদ্ভাব রাখার জন্য মাঝে মাঝে যেচে ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। আরও লজ্জার বিষয় হোরো এক সময় আমাদের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত। ওই মাথা ঠাসা মোটা মোটা চুলের ঘুঙর, চ্যাপটা নাক, আবলুস কালো চেহারা – তবু এত অহঙ্কার !

স্টিফানের ওপর প্রথম একটু ভয় ও শ্রদ্ধা হল একটা ঘটনায়। সেদিন খেলার মাঠে দেখলাম – হোরো হকি স্টিক আনেনি। হোরো তবু খেলতে চায়। কিন্তু নিজের হকি স্টিক নিয়ে খেলতে হবে – এই ছিল আমাদের নিয়ম। হোরো বার বার আমাদের অনুরোধ করল – কিছুক্ষনের জন্য কেউ আমাকে একটা স্টিক ধার দাও, এক হাত খেলেই আবার দিয়ে দেব।

কেউ কারও স্টিক পরের হাতে দিতে রাজি ছিল না। হোরো বললো – আমি বিনা স্টিকেই খেলবো।

গোঁয়ার হোরো একটি ঘণ্টা আমাদের উদ্দাম হকি স্টিকের বাড়ি আর আছাড়ের সঙ্গে সমান স্বাচ্ছন্দ্যে পা দিয়ে খেলে গেল। হোরোর দুটি নিরেট শিশু কাঠের মতো পায়ের ওপর বেপরোয়া হকি স্টিক চালাবার সময় এক একবার সন্দেহে আমাদের হাত কেঁপে উঠেছে – স্টিকটাই ভেঙে না যায়।

স্টিফান হোরো ক্রমেই আমাদের ভাবিয়ে তুলছিল। শুধু ভয় আর শ্রদ্ধা নয় – আর একটা কারণে আমরা হোরোকে একবার ঈর্ষা করতে আরম্ভ করলাম। লেখা পড়ার ব্যাপারে হোরো আমাদের মনের শান্তি নষ্ট করতে চলেছে। ইংরাজি কবিতার আবৃত্তি ও ব্যাখ্যায় সে আমাদের ইন্দুকেও পরাজিত করে ছাব্বিশ নম্বর বেশি পেল। ঘটনাটা জাতীয় অপমানের মতো আমাদের গায়ে বিঁধল। বেহারি ছাত্রদের জাতীয়তা কতটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল জানি না, কিন্তু হোরোর সম্পর্কে একটা নিন্দার ষড়যন্ত্রে তারাও আমাদের সঙ্গে ইউনাইটেড ফ্রন্ট করল। আমরা বেশ জোর গলায় রটিয়ে দিলাম – এ স্কুলে অখ্রিস্টানদের ওপর বড়ো অবিচার চলছে। মাস্টারেরা সবাই খ্রিস্টান। সুতরাং খ্রিস্টান হোরো বেশি নম্বর পাবে তাতে আর আশ্চর্য কি ? কিন্তু কী ভয়ানক অন্যায় !

আমাদের অভিযোগকে মনে প্রাণে সত্য বলে বুঝলেন শুধু একমাত্র অখ্রিস্টান শিক্ষক। সংস্কৃতের মাস্টার বৈজনাথ শর্মা- পন্ডিতজি।

পন্ডিতজি আমাদের সান্ত্বনা দিলেন। কী আর করবে বাবা! পাদরিদের দের স্কুলে এইরকমই অন্যায় কান্ড হয়ে থাকে। যাক, ইউনিভার্সিটি তো আছে। সেইখানে ধরা পড়ে যাবে কার কতখানি যোগ্যতা।

প্রমোশনের পর নতুন বছরে স্টিফান হোরো আরও ভয়ানক এক গোঁয়ার্তুমি করে বসলো- পা দিয়ে হকি খেলার চেয়েও ভয়ানক। স্টিফান হোরো তার অ্যাডিশানাল ইংরাজি ছেড়ে দিয়ে সংস্কৃত নিল। খ্রিষ্টান টিচারেরা সবাই হোরোকে ধমকালেন, হেডমাস্টার ফাদার লিন্ডন ক্ষুন্ন হলেন, পন্ডিতজি অদ্ভুতভাবে হাসতে লাগলেন। তবু অনার্য হোরোর সংস্কৃত পড়ার প্রতিজ্ঞা তিলমাত্র বিচলিত হল না।

পন্ডিতজি আমাদের আড়ালে ডেকে নিয়ে একটা অস্বস্তির হাসি হেসে বললেন – স্টিফান হোরো সংস্কৃত নিয়েছে। আর কি ? এইবার দেবভাষার কপালে কী আছে কে জানে।

পন্ডিতজি হাসতে লাগলেন। আমাদের কেমন সন্দেহ হল। – পন্ডিতজিকে যেন খুশি খুশি দেখাচ্ছে ! যাক।

শীঘ্রই আমাদের যত ধারণা সংশয় আক্রোশ ও আশঙ্কা পর পর কতগুলি ঘটনায় আরও জটিল হয়ে উঠতে লাগল।

নিউ টেস্টামেন্ট থেকে ডেভিডের গাথাগুলি আগাগোড়া নির্ভুল আবৃত্তি করে ফার্স্ট প্রাইজ পেল স্টিফান হোরো। সেকেন্ড, থার্ড, ও ফোর্থ প্রাইজের অগৌরবে মুখ শুকনো করে আমরা বসে রইলাম। ফাদার লিন্ডন উচ্ছ্বসিত আনন্দে হোরোর প্রশংসা করে ঘোষণা করলেন – ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তোমায় নিশ্চয় দারোগা করে দেবো হোরো, আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম।

তা করতে পারেন ফাদার লিন্ডন। এতটুকু সুপারিশ করার ক্ষমতা তাঁর আছে, কিন্তু ওইটুকু যদি স্টিফেন হোরোর জীবনের পরমার্থ হয়, হোক, তার জন্য আমরা মোটেই হিংসা করি না। তার জন্য এত কষ্ট করে নিউ টেস্টামেন্ট মুখস্থ করার দরকার নেই আমাদের।

তার পরের দিনই বাইবেল ক্লাসে হোরোকে একেবারে ভিন্ন রূপে দেখতে পেলাম আমরা। দুর্বোধ্য বিস্ময়ে আমরা শুধু খাবি খেতে লাগলাম।

বাইবেল ক্লাসের একেবারে পেছনের বেঞ্চিতে বসেছিল হোরো। পড়াতে পড়াতে ফাদার লিন্ডন বার বার পুলকিত নেত্রে হোরোকে প্রশ্ন করছিলেন – স্টিফান তুমিই উত্তর দাও। তুমিই সবচেয়ে ভালো উত্তর দিতে পারবে।

– জানি না স্যর। স্টিফানের রুক্ষ গলার স্বরে চমকে উঠে আমরা সবাই তার দিকে তাকালাম। দেখলাম, স্টিফান হোরোর আরও রুক্ষ ও বিরক্ত মুখটা ডেস্কের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। ফাদার লিন্ডনের দিকে যেন তাকাতে চায় না হোরো।

ফাদার লিন্ডনের সোনালি দাড়ির ওপর লালচে মুখে ক্ষণে ক্ষণে গাঢ় রক্তচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ছিল। চোখের দৃষ্টিটা তীব্র হয়ে উঠছিল। স্টিফানের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট স্বরে বললেন – স্টিফান, আজ কি তোমার ব্রেনটাকে দরজার বাইরে রেখে ক্লাসে এসেছে তুমি ? উত্তর দিতে পারছ না কেন ?

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 

জানি না স্যর। আবার স্টিফান হোরোর সেই স্পষ্ট অবিচল ও অকুতোভয় উত্তর শুনে আমাদের বুকে দূর দূর শুরু হয়ে গেল। আকস্মিকভাবে অসময়ে ক্লাস বন্ধ করে ফাদার লিন্ডন চলে গেলেন।

কিন্তু স্টিফান হোরোর এত রাগ কেন ? এত অভিমান কেন ? নিউ টেস্টামেন্ট মুখস্থ করে কার মাথা কিনেছে ? কি হতে চায় ? হাউস অব লর্ডস্‌ – এর সদস্য ?

এর পর বিপদে পড়লেন পন্ডিতজি। পন্ডিতজির মতি-গতিও কদিন থেকে কেমন একটু বিসদৃশ দেখাচ্ছে। আমাদের এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন পন্ডিতজি একটু সুস্থ বোধ করেন। দেখা হলেই ব্যস্ত হয়ে সরে পড়েন।  অথচ পন্ডিতজিকে কত কথাই না জিজ্ঞাসা করার আছে। ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। এই তো যত নম্বর প্রমোশন আর পজিশন নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা গবেষণা ও কৌতূহলের সময়। পন্ডিতজির উদার হাতের নম্বর অনেক সময় আমাদের টোটালকে পরিস্ফীত করে কৃপণ খ্রিস্টান শিক্ষকদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। আজও আমরা তাই জানতে চাই – পন্ডিতজি কার জন্যে কতদূর করলেন। ইন্দুকে যদি একবার বুক ঠুকে পঁচাশি দিয়ে দেন তবে টোটালে তার ফার্স্ট হওয়া সম্বন্ধে আর কোনো সংশয় থাকে না। সব খ্রিস্টানি ষড়যন্ত্র জব্দ হয়ে যায়।

পন্ডিতজির বাড়িতে গিয়েছি, লাইব্রেরি ঘরে একা একা পেয়েছি, পথে পথরোধ করেছি – কিন্তু পন্ডিতজি কিরকম গোলমেলে কথা বলে সব কৌতূহল যেন চাপা দিতে চান। আমাদের সন্দেহ আরও প্রখর হয়ে ওঠে।

আম্‌তা আম্‌তা করে দুবার মাথা চুলকিয়ে পন্ডিতজি সত্য সংবাদটা ব্যক্ত করে দিলেন। সংস্কৃতে স্টিফান হোরো সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, একশোর মধ্যে পঁচাত্তর।

আর ইন্দু ? আমাদের প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পন্ডিতজি অপরাধীর মতো বললেন – বত্রিশ।

মাত্র বত্রিশ ! পন্ডিতজির মতো বিশ্বাসহন্তা পৃথিবীতে আর নেই। আমাদের ক্ষোভ অসংযত হয়ে উঠেছিল। পন্ডিতজি মিনতি করে বললেন – স্টিফান হোরো এত ভালো সংস্কৃত লিখেছে, এ – তো তোমাদেরই গৌরব, আর্যভাষার গৌরব। এতে তো তোমাদের খুশি হবার কথা। এটা হোরোর জয় নয়, এটা হল সংস্কৃত ভাষার জয়।

চুলোয় যাক সংস্কৃত ভাষার জয়। ইন্দু ফার্স্ট হতে পারবে না, এটা যে আর্যত্বের কত বড়ো পরাভব, বাঙালির কত বড়ো অপমান – তা পন্ডিতজি বুঝলেন না। কিন্তু আমরা ঠিক রহস্যটি বুঝে ফেললাম – পন্ডিতজি হলেন বেহারি, তাই।

কিন্তু বাতাসের নিশ্চয় সেই পরম গুণ আছে, যার জন্য শত অন্যায়ের অবরোধের মধ্যেও ধর্মের কল নড়ে ওঠে। লাইব্রেরি ঘরে যেদিন বোর্ড নিবদ্ধ মার্কশিটের কাছে আমরা গিয়ে চোখ তুলে দাঁড়ালাম, সেদিন আমরা বিশ্বাস করলাম সত্যের জয় আছে, মিথ্যার পরাজয় আছে।

ইন্দুই ফার্স্ট হয়েছে। স্টিফান হোরো অনেক নীচে। ইংলিশে, ইতিহাসে, ভূগোলে, অঙ্কে- সব বিষয়ে অতি নগণ্য নম্বর পেয়েছে স্টিফান হোরো, একমাত্র সংস্কৃত ছাড়া। ভেবে অবাক হলাম আমরা, খ্রিস্টান টিচারেরা হোরোর ওপর হঠাৎ এত নির্দয় হয়ে উঠলেন কেন?

আরও কিছুদিন পর স্টিফান হোরো আমদের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য হয়ে গলে। শুধু আমাদের কাছে নয়, খালখো, বেস্‌রা, টিগ্‌গা সবাই বলাবলি করে- কী জানি হয়েছে হোরোর!

বড়দিনের উৎসবে আমরাও পিকনিক করতে গিয়েছিলাম শিলোয়ারার জঙ্গলে। রান্নার কাঠের জন্য মহা উৎসাহে একটা মরা কেঁদ গাছ ভাংছিলাম আমরা। হঠাৎ দেখলাম, স্রোতের ধার দিয়ে একা একা হোরো চলেছে। হাতে একটা গুলতি। আমরা চেঁচিয়ে ডাকলাম হোরোকে। এ রকম অভাবিত ভাবে হোরো যখন এসেই পড়েছে, তখন সেও আমাদের সঙ্গে এই বনভজনের আনন্দের একটু শেয়ার নিক না কেন। পোলাও হবে, মাংস হবে, দই আছে, বৈকুন্ঠ ময়রার সন্দেশ আছে। খেয়ে খুশি হবে হোরো। একেবারে আনকোরা মুন্ডা, জীবনে বোধ হয় এসব খায়নি কখনও।

হোরো এগিয়ে এল। আমাদের কাছে এসেই একটা শাল গাছের শাখার দিকে নিবিস্ট ভাবে তাকিয়ে রইল। তার পরেই শিকার লক্ষ করে গুলতি তুলে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে একটা হৃষ্টপুষ্ট কাঠবিড়ালি আহত হয়ে ধপ করে মাটির উপরে পড়ল। একটা লাফ দিয়ে আহত কাঠবিড়ালিটিকে লুফে নিয়ে পকেটের ভিতর রাখলো স্টিফান।

আমরা আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলাম- ওটা কী হবে স্টিফান।

-খাব। নিঃসংকোচে কথাটা বলে ফেলল হোরো। মনের ঘেন্না চেপে রেখে তবু আমরা হোরোকে নিমন্ত্রণ করলাম। ওসব ছুড়ে ফেলে দাও স্টিফান। পাগল কোথাকার। এসো আমাদের পিকনিকে তুমিও খাবে আমাদের সঙ্গে।

না। হোরোর কালো মুখের ভিতর থেকে ঝক্‌ঝকে্‌ দুপাটি সাদা দাঁতের হাসি আপত্তি জানাল।

এ রকম জংলি হয়ে যাচ্ছে কেন স্টিফান? রিচার্ড টুডু একদিন কানে কানে আমাদের বলল, – সত্যি কি জানি হয়েছে হোরোর। বোধহয় শীগগির পাগল হয়ে যাবে। ফাদার লিন্ডন আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, হোরোর সঙ্গে যেন কেউ না মেশে।

আমরা জিজ্ঞাসা করলাম।– কেন টুডু।

টুডু- একজন বুড়ো সোখার সঙ্গে আজকাল বড়ো ভাব হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিন মঙ্গলবারের হাটে গিয়ে সোখার সঙ্গে দেখা করে হোরো।

তাতে কী এমন অপরাধ করেছে হোরো?

টুডু ভুরু কুচকে বলল- অপরাধ নয়? এতে বাইবেলের অপমান করেছে হোরো। চার্চে যায় না। কারও কথা শোনেনা। তিন দিন বোর্ডিংয়ে ছিল না। ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে

বোর্ডিংয়ে ছিল না? কোথায় ছিল?

টুডু গলার স্বর আরও নামিয়ে চুপে চুপে বলল- বুরুতে গিয়েছিল। সেখানে নেচে গেয়ে এসেছে। পেট ভরে ইলি খেয়ে নেশা করেছে। তা ছাড়া…।

টুডু হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল। একটা কথা বলছি, কাউকে বলো না যেন। জানতে পারলে হোরো আমায় মেরে ফেলবে।

টুডুকে অভয় দিলাম।– না, কেউ জানতে পাবে না, তুমি বলো।

টুডু- একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়েছে। মেয়েটার নাম চির্‌কি, মোরাঙ্গি পাহাড়ের মুরমুদের মেয়ে।

টুডুর কথা গুলো মুগ্ধ হয়ে যেন গিলছিলাম আমরা। আমাদেরই সহপাঠী- দীন দরিদ্র মুন্ডা হোরো, কতই বা বয়স,তবু সেই হোরো আজ আমাদের এক মুহুর্তে বাইবেল ক্লাস, সংস্কৃতের নম্বর আর হকি খেলার সব আনন্দ উত্তেজনাকে মুল্যহীন করে দিয়ে, এক রোমাঞ্চময় অনুরাগের স্কুলে গিয়ে সবার অগোচরে নাম লিখিয়ে এসেছে। সেই মেয়েটি, চির্‌কি মুরমু তার নাম, তাকে যেন আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি। শাল ফুলের মালা গলায় দিয়ে, খোঁপায় একটা বনজবা গুঁজে, স্রোতের ভাষার মতো খলখল হাসির বন্ধনে হোরোর কালো হৃদয়ের সব দুরন্তপনাকে বন্দি করে কোন উপত্যকার একটি নিভৃতে নিয়ে চলে গেছে। সেখান থেকে ফিরে আসার সাধ্য নেই হোরোর। কোন্‌ সাধেই বা আসবে?

টুডু তখনও সেই রকম পাকা পাকা কথা বলে চলেছিল।– মুরমুরা বোঙা পুজো করে, ওদের সঙ্গে মেলামেশা কি উচিত হল? বড়ো ভুল করেছে হোরো।

স্টিফান হোরোকে বর্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, এটা শুধু একটা গুজব হয়ে রইল। কার্যত দেখলাম, হোরোকে তাড়ানো হলো না। নিজের ইচ্ছা মতো ক্লাসে আসে হোরো। নিজের ইচ্ছা মতোই অনুপস্থিত হয়। অনুগত খ্রিস্টান ছাত্রেরা হোরোকে এড়িয়ে যায়। হোরো যেন এক ঘরের মধ্যেই একঘরে হয়ে আছে।

রিচার্ড টুডু যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, কাজের বেলায় দেখলাম তার উল্টোটাই হয়েছে। হোরোকে বোর্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। সে বোর্ডিংয়েই আছে, অথচ তার সম্পর্কে যেন সব শাসন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

আমরা দেখে অবাক হয়ে যেতাম, এক একদিন বিকেলে ফাদার লিন্ডন টেনিস খেলছেন হোরোর সঙ্গে। আশ্চর্য! টুডু বেস্‌রা টিগ্‌গা- এরা হোরোর চেয়ে কম কালো আর বেশি বিশ্বাসী খ্রিস্টান। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওরা শুধু ফাদার লিন্ডনের টেনিস খেলার সময় বল কুড়িয়ে দেবার মর্যাদা পেয়েছে। তার বেশী নয়। আর স্টিফান একেবারে… সত্যি আশ্চর্য।

বোর্ডিংয়ের বাগানে বিকালবেলা জল দেবার ভার ছিল হোরোর উপর। এই কর্তব্যটুকুর বিনিময়ে হোরো বোর্ডিংয়ে ফ্রি খেতে পেত আর থাকত। আমরা দেখলাম হোরো বাগানে যায় না, জল তোলে না। উদ্যানসেবার ভার টিগ্‌গার ওপর চাপানো হয়েছে। বেচারি টিগ্‌গা! সকালবেলার রান্নার জন্য কাঠ কাটে, তার ওপর আবার বিকেলবেলা জল তোলা!

টুডু এসেই আর একদিন একটা খবর দিল- আজকাল আর হাটে যাবার সুযোগ পায় না স্টিফান, প্রতি মঙ্গলবার ফাদার লিন্ডনের ঘরে বসে পিলগ্রিম্‌স প্রগ্রেস পড়ে। পড়া শেষ হলে নাকি চা-বিস্কুট খায় হোরো। ফাদার লিন্ডন খাওয়ান।

আমাদের উৎসাহ ঔৎসুক্য আলোচনা আর গবেষণার সীমা ছিল না। অলক্ষ্যে কত বড়ো একটা ঘটনার দ্বন্দ্ব জমে উঠেছে, তার কিছু কিছু আভাস আমরা আমাদের অনুভব দিয়ে ধরতে পারছিলাম। এক দিকে কেম্ব্রিজের এম.এ. বিখ্যাত শিক্ষিত সুসভ্য ও শ্রদ্ধেয় ফাদার লিন্ডন।… অপর দিকে কোন এক জংলি মুন্ডা ডিহির বুড়ো সোখা দীনতম নগণ্য অর্ধোলঙ্গ বর্বরবেশী এক যাদুমন্ত্রী। যেন দুই যুগে লড়াই- বিংশ শতক বনাম প্রাক্‌ ইতিহাস। বুড়ো সোখা বোধ হয় সে লাঞ্ছনা ভুলতে পারে না- ছেলেধরা পাদরিরা তাদের ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, খ্রিস্টান করে দিয়েছে হোরোকে। তারই প্রতিশোধ নেবে বুড়ো সোখা। এই সুসভ্য ডাইনদের দূর্গ থেকে আবার জঙ্গলের ছেলেকে আবার জঙ্গলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

ফাদার লিন্ডন তাই বোধহয় সতর্ক হয়েছেন। স্টিফান হোরো যদি আবার জংলি হয়ে যায়, সে পরাজয় আর অপমান বড়ো বেশী করে বুকে বাজবে। সহ্য করা কঠিন হবে। লিন্ডন জানেন প্রতি মঙ্গলবারের হাটে বুড়ো সোখা আসে। একটা আরন্য-আত্মা প্রতিশোধ নেবার জন্য আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুযোগ খুঁজছে। চা-বিস্কুট-টেনিস সুসভ্যতার এক একটি প্রসাদ খাইয়ে হোরোকে যেন পোষ মানিয়ে রাখতে চাইছিলেন ফাদার লিন্ডন।

আমরা বলতাম- চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ। দেখা যাক, কে জেতে, কে হারে।

গুড ফ্রাইডে ছুটিতে সবাই দেশে যাবার ছুটি পেল। টুডু টিগ্‌গা বেস্‌রা খালকো সবাই চলে গেল। ওদের পক্ষে যাওয়ার কোনো বাধা ছিল না। কাঁধের লাঠিতে এক একটা পোঁটলা ঝুলিয়ে জঙ্গলের পথে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল একটানা হেঁটে ওরা চলে যাবে নিজের নিজের ডিহিতে। কোনো পাথেয় দরকার হয়না। ততখানি পয়সা খরচ করার সামর্থ্যও নেই ওদের।

কিন্তু হোরোকে ছুটি দিতে রীতিমতো বিচলিত হয়ে পড়লেন ফাদার লিন্ডন। হোরো যেদিন গেল, সার্ভিস বাসটা এসে দাঁড়াল বোর্ডিংয়ের কাছে। আমরা দেখলাম, ফাদার লিন্ডন ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা বের করছেন, বাসের টিকিট কিনে দিচ্ছেন হোরোকে।

আমাদের মধ্যে বাজি ধরা হল- হোরো আর ফিরে আসবে কিনা। ইন্দু বলল- নিশ্চয়ই আসবে। ফাদার লিন্ডন ওর জংলিপানা ঘুচিয়ে দিয়েছেন। দুবেলা চা-বিস্কুট মারছে আজকাল। তার আস্বাদ কী ভুলতে পারবে হোরো!

আমি বললাম- আর ফিরে আসবে না হোরো। এখানে না হয় চা-বিস্কুট আছে, কিন্তু ওদিকে যে…।

ইন্দু- ওদিকে কি?

বললাম- চির্‌কি মুরমুকে ভুলে গেলে?

ইন্দু একটু নিরাশ হয়ে পড়ল।– তাই তো!

ছুটি ফুরিয়ে গেলে আবার বোর্ডিংয়ের জীবন চঞ্চল হয়ে উঠল। সবাই এসেছে। স্টিফান হোরো ফিরে এসেছে। ইন্দুর জিত হল। আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। রাগ হলো হোরোর ওপর। হোরোটা সত্যিই একটা গবেট ও বেরসিক।

কিন্তু টুডুর কাছে গল্প শুনে আমাদের এই আক্ষেপ মুহূর্তে মুছে গেল। আমরা শুনলাম বুড়ো সোখার কথা, হোরোর কথা, চির্‌কি মুরমুর কথা।হোরোদের জঙ্গলের ছবিটা মুহূর্তের মধ্যে যেন দূরের ফোটা পলাশের আলেয়ার মতো আমাদের কল্পনার সীমার পায়ে দুলতে শুরু করে দিল। ইন্দু বলল- চতুর্থ পানিপথের  যুদ্ধে  বুড়ো সোখার জয় অবধারিত।

হোরোর পাশের ডিহির ছেলে টুডু। খ্রিস্টান টুডুরা অখ্রিস্টানদের সঙ্গে মেশে না। টুডু তবু যেন গোয়েন্দাদের মতো হোরোর সব কীর্তি দেখে এসেছে। তবু টডু প্রান থাকতে ফাদার লিন্ডনের কানে এসব কথা কখনও তুলবে না। হোরোর ওপর প্রচন্ড একটা শ্রদ্ধা ও মমতা আছে টুডুর। হোরোর কাছে গিয়ে কিছু বলতে পারে না বলেই আমাদের কাছে বলে। বলে বলে যেন শ্রদ্ধার বেদনা খানিকটা হালকা করে নেয়।

টুডু দেখেছে- একদিন তির দিয়ে একটা হরিণ মেরেছিল হোরো। স্রোতের ধারে হোরো দাঁড়িয়ে ছিল ধনুক হাতে। চির্‌কি মুর্‌মু তার পা ধুইয়ে দিচ্ছিল।

টুডু দেখছে- চির্‌কি তাদের গাঁয়ের ঘুমঘর থেকে জ্যোৎস্নারাতে চুপে চুপে পালিয়ে এসেছে। হোরো আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চির্‌কিকে হাতে ধরে নিয়ে গেছে।

টুডু দেখছে- হোরো খ্রিস্টান হয়েও আখারাতে গিয়ে মাদল বাজিয়েছে। চির্‌কিও নাচে কিনা সেখানে। বুড়ো সোখা ভালোবেসে হোরোকে। কেউ তাই হোরোকে ঘৃণা করে না।

টুডু বলল- জংলিদের সঙ্গে মিশে দুদিন সেন্ডেরা করেছে হোরো। টাঙি উৎসবে পাগলের মতো নেচেছে। শিমূল গাছে আগুন ধরিয়েছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে। সবার আগে এক লাফ দিয়ে এক কোপে জ্বলন্ত গাছ কেটেছে হেরো।

টুডু গলার স্বর খুব অস্পষ্ট করে ভয়ে ভয়ে বলল- আমি দেখেছি, তার পর গায়ের ফোস্কাতে  ঠান্ডা বাতাস লাগবার জন্য আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে হোরো! চির্‌কি মুরমু আস্তে আস্তে এসে হোরোকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 

বোর্ডিংয়ের পাশে ছোটো  মাঠের ঘাসের উপর সন্ধ্যার অন্ধকারে বসে আমরা টুডুর গল্প শুনছিলাম। হঠাৎ বোর্ডিংয়ের বারান্দা থেকে একটা বাঁশির স্বর ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে তারই সঙ্গে মিলিয়ে, তালে তালে মাথা দুলিয়ে, টুডু গুনগুন করে গাইতে লাগল।–

রাতা মাতা বির্‌কো তালা

রে নালো হোম নির জা

রাগা ইংগা

উৎফুল্ল টুডুর হাবভাব আর উৎসাহ দেখে মনে হল, এখনি সে নাচতে শুরু করে দেবে।

-কে বাজাচ্ছে বাঁশি। কে?

আমাদের ব্যস্ত জিজ্ঞাসার উত্তরে টুডু গান থামিয়ে বলল- ওই, সেই গান। হোরো সেই সুরটা বাজাচ্ছে।

-কোন গান?

-চির্‌কি মুরমুর গান।

-গানটার মানে কী টুডু?

টুডু উত্তর দিল- গানটার অর্থ, শোনো আমার জোয়ান বন্ধু, পালিয়ে যেওনা, এই ঘন জঙ্গলে  আমায় একা ফেলে চলে যেও না।

একটা পুলকের সঞ্চার আমাদের মনের অগোচরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। বললাম- এ যে আমাদেরই মতো গান টুডু!

ইন্দু চাপা সুরে আবৃত্তি করল।– শুন শুন হে পরাণ পিয়া…।

কিছুক্ষন আবিষ্টের মতো নিঝুম হয়ে বসেছিলাম আমরা। বোধ হয় আমরা মনে মনে চির্‌কি মুরমু নামে বনের লতার মতো না দেখা একটি মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম- না, তোমার বন্ধু পালিয়ে যাবে না,। আমরা প্রার্থনা করছি, হোরো তোমার কাছে ফিরে যাবে।

ফাদার লিন্ডনের গর্জন শুনতে পেয়ে চমকে উঠলাম। বোর্ডিংয়ের বারান্দায় অন্ধকারে যেন একটা ধস্তাধস্তি চলছে। টুডু দৌড়ে গিয়ে ঘটনা স্বচক্ষে দেখে ফিরে এল।সন্ত্রস্তের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।ফাদার লিন্ডন হেরোর বাঁশি ভেঙে দিয়েছে।

আমাদের সবার মনে একসঙ্গে ধক করে কতগুলি প্রতিহিংসার শিখা জ্বলে উঠল। রাগের মাথায় বললাম- ঘা কতক জমিয়ে দিতে পারল না হোরো?

টুডু বিমর্ষ ভাবে বললে- আমারও কেমন ভয় হচ্ছে। হোরো বড়ো  গোঁয়ার। ফাদারকে এর ফল টের পাইরে দেবে স্টিফান।

কিন্তু এর পর স্টিফান হোরোর গুয়ার্তুমির কোনো প্রমাণ পেলাম না। বরং দেখলাম, গোঁ ধরেছেন  ফাদার লিন্ডন। ফাদার লিন্ডনের অভিযান আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে একবার সফরে বের হন। কখনও ভোজপুরি লেঠেলে সঙ্গে যায়, কখনও বা আট দশটা কনস্টেবেল। থানাতে একটা চিঠি দিলেই কনস্টেবল চলে আসে। যেন একটা যোদ্ধার দল নিয়ে দুদিনের জন্য জঙ্গল এলাকায় অদৃশ্য হয়ে যান ফাদার লিন্ডন। সত্যি তিনি একজন ধর্মযোদ্ধা। আমারা শুধু মনমরা হয়ে ভাবতাম ফাদার লিন্ডনের এই রহস্যময় আনাগোনা কবে বন্ধ হবে? কবে শান্ত হবে তার লালচে  মুখের উত্তেজনা?

টুডুর কাছে শুনে স্পষ্ট করে বুঝলাম- মোরাঙ্গি পাহাড়ের মুরমুদের ডিহিতেই ফাদার লিন্ডনের অভিযান শুরু হয়েছে। পাহাড়ের গায় এরই মধ্যে একটি মাটির গির্জা তৈরি করে ফেলেছেন ফাদার লিন্ডন। অরণ্যের বুকের ভেতর ঢুকে তিনি যেন লক্ষ বছরের বৃদ্ধ যত বোঙাদের শিলাময় বেদি কাঁপিয়ে দিয়ে এসেছেন।

খুব বেশি দিন পার হয়নি, শুনলাম, মোরাঙ্গি পাহাড়ে একটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। মাটির গির্জা ভেঙ্গে ধুলো করে দিয়েছে। কে করেছে?

যে করেছে, তাকে আমরা স্বচক্ষে দেখলাম। বুড়ো সোখা। সেসন জজের আদালতে ভিড়ের মধ্যে মাথা গুঁজে আমরাও রায় শুনলাম- বুড়ো সোখার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।

স্টিফান হোরোকে দেখতাম, বোর্ডিংয়ের বাগানে একটা বুড়ো বটের ঝুরিতে দোলনা বেধেঁ সময় অসময় শুধু দোল খায়। দুলে দুলে যেন এক দুঃসহ গায়ের জ্বালা জুড়িয়ে নিচ্ছে স্টিফান হোরো।

নন-কো অপারেশনের ঝড় রইল সারা দেশে, আমরা স্কুল ছাড়ব। জালিয়ানওয়ালাবগের  অপমান আমাদের অশান্ত করে তুলল।

আমরা বাঙালি আর বিহারি ছেলেরা স্কুল ছাড়লাম। রাজার ছেলেরা কেউ ছাড়ল না। খ্রিস্টান ছেলেরাও নয়- টুডু টিগ্‌গা বেস্‌রা খাল্‌খো কেউ নয়। আমরা পিকেটিং করে ওদের বাধা দিতে লাগলাম!

আমাদের খুব ভরসা ছিল, হোরো আমাদের দলে আসবে। ফাদার লিন্ডন যেভাবে ওকে অপমান করেছে, জীবনে সে আর কোনো পাদরি বা সাদা চামড়াকে সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ।

আমরা স্কুলের ফটকে পিকেটিং করেছিলাম। দেখলাম হোরো আসছে।– স্বতন্ত্র ভারত কি জয়! জয়ধ্বনি করে আমরা হোরোকে অভ্যর্থনা জানালাম।

হোরো এগিয়ে এসে ইন্দুকে একটা ধাক্কা দিল, পরেশের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। বন শুয়োরের মতো গোঁ গোঁ করে পথ করে নিয়ে ক্লাসে ঢুকল।

সেইদিন হোরোকে আমরা ভালো করে চিনলাম। পাদরিদের ক্রীতদাস, মনুষ্যত্বহীন, মর্যাদাশূন্য, মূর্খ জংলি হোরো। স্বতন্ত্র ভারতবর্ষকে চিনল না, একটু শ্রদ্ধা করল না। চিনল শুধু ওর জঙ্গলটাকে। কিন্তু তোর জঙ্গলটা যে ভারতবর্ষের মধ্যেই রে বনবৃষ! ভারতবর্ষের বাইরে তো নয়।

আট বছর পরের কথা। আমি লোপো খানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা। সকালবেলায় কজন বিরসাইট মুন্ডা এসেছে হাজিরা দিতে। জেল থেকে আজ ই ওরা খালাস পেয়েছে। এখানে হাজিরা দিয়ে তারপর নিজের নিজের ডিহিতে চলে যাবে। বিরসাইটরা অত্যন্ত সন্দেহভাজন জীব। প্রতি বছর হাঙ্গামা বাধায়। পুলিশকে ব্যতিব্যস্ত করে। জঙ্গল আইন মানে না, মহাজনদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়, চৌকিদারি ট্যাক্স দিতে চায় না। বাজারে বসলে তোলা দেবে না। জমি ক্রোক করতে গেলে আদালতের পেয়াদাকে টাঙি নিয়ে কাটতে আসে। দুবছর আগে একবার স্বরাজ ঘোষণা করেছিল বিরসাইট মুন্ডারা, পাদরিকে মেরেছে, পুলিশকে মেরেছে, অনেকগুলি পুল ভেঙেছে। ওরমান্‌ঝির জঙ্গলে একটা খন্ড যুদ্ধ হয়েছিল ওদের সঙ্গে।

সবচেয়ে শেষে হাজিরা লেখাতে যে লোকটা উঠে এল তার নাম রুন্‌নু হোরো।

ডায়েরির ওপর থেকে চোখ তুলে লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। তার মাথার চুলে জংলি খোঁপাটাও জটার চূড়ার মতো হয়ে গেছে। গলায় একটা ভেলাফলের মালা,আদুর গা,কোমরে ছোটো একটা কাপড় জড়ান।হাতে একটা কাসাঁর বালা। এই প্রাগৈতিহাসিক সজ্জার মধ্যে শুধু একজোড়া সুশানিত আধুনিক চোখ…।

বিস্ময় চাপতে গিয়ে তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম- স্টিফান হোরো।

লোকটা মিষ্টি হেসে বলল- না না। ঘোষ, আমি রুন্‌নু হোরো।

-তুমিও একজন বিরসাইট?

-আমি বিরসা ভগবানের শিষ্য !

-বিরসা ভগবান? কে সে?

– সে আমাদের গান্ধি ছিল ঘোষ। আমি তাঁকে চোখে দেখিনি, আমরা বাবার মুখে তাঁর কথা শুনেছি। ইংরেজের জেলখানার অন্ধকারে একজন কয়েদির মতো মরে গেছে আমাদের বিরসা ভগবান। তাঁর চেহারা দেখতে কেমন ছিল জানো ঘোষ।

– কেমন?

– যীশু খ্রিস্টের মতো।

একটু চুপ করে থেকে হোরো বলল – আমাদের জঙ্গলে বাইরে থেকে অনেক পাপ এসে ঢুকেছে, ঘোষ। তাই বিরসা ভগবান আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন। তাঁর অনুরোধ কি ভুলতে পারি ?

আমি ডাকলাম। – স্টিফান হোরো।

হোরো প্রতিবাদ করল। – বলো, রুন্‌নু হোরো।

চুপ করে গেলাম। হোরো নিজে থেকেই খুশি হয়ে নানা খবর জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করল। – ইন্দু কোথায় ? পরেশ কী করছে ?

চার দিক একবার সাবধানে তাকিয়ে নিয়ে হোরোকে প্রশ্ন করলাম – এত রোগা হয়ে গেলে কেন হোরো ?

হোরো – আমার টি–বি হয়েছে। আচ্ছা, এবার যাই আমি।

একটা  কথা জানবার জন্য মনটা ছটফট করছিল। তবু সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। শেষে সাহস করে বলেই ফেললাম।-একটা খবর জানতে বড়ো ইচ্ছে করছে হোরো।

হোরো – বলো।

জিজ্ঞাসা করলাম – চির্‌কি মুরমু কোথায় ?

হোরো শান্তভাবে উত্তর দিলো। – ও, জানো না বুঝি ? ফাদার লিন্ডনের মিশনে চলে গেছে চিরকি। খ্রিস্টান হয়েছে। এখন হাজারিবাগের কনভেন্টে থাকে।

স্টিফানের চোখের দৃষ্টিটা চিকচিক করে উঠল, তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতোই, কিন্তু জলে ভেজা। আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা হল না, স্টিফানও নিঃশব্দে চলে গেল।

কাউকে মুখ ফুটে বলতে লজ্জা করবে, একটা ভুলের স্মৃতি কিছুক্ষণের জন্য কাঁটার মতো মনের মধ্যে বিঁধছিল, হয়তো আমরাই নিরপেক্ষ থেকে চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধে স্টিফানকে হারিয়ে দিলাম। স্টিফানও বনবাসে চলে গেল।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 


Share
Tweet
Pin
Share
No comments
Newer Posts

Followers

Pages

  • Home
  • Privacy Policy
  • Disclaimer
  • CONTACT ME
  • About Me

Contact Form

Name

Email *

Message *

About me

Hallow viewers , myself Nandan Dutta [Subhankar Dutta], reside at Maheshpur,Malda.
I made this website for the students of B.A. courses under Gour Banga University. Here you can get suggestions of different subjects like HISTORY , SOCIOLOGY , POLITICAL SCIENCE & EDUCATION.
In future I will add MCQ sections of those subjects.


Categories

  • 1ST SEMESTER SUGGESTION (1)
  • 2 ND YEAR SUGGESTION (1)
  • 2ND SEMESTER (1)
  • 3RD SEMESTER (8)
  • BENGALI NOTES (21)
  • CU suggestion. (1)
  • EDUCATION NOTES (141)
  • ENGLISH COMPULSORY (16)
  • GBU Suggestion. (7)
  • HISTORY EUROPE & WORLD (46)
  • HISTORY NOTES (68)
  • POL SC NOTES (68)
  • SOCIOLOGY NOTES (72)
  • WBCS 2020 (1)

recent posts

Blog Archive

  • August 2025 (4)
  • May 2025 (3)
  • April 2025 (20)
  • March 2025 (12)
  • February 2025 (8)
  • November 2024 (5)
  • October 2024 (2)
  • September 2024 (2)
  • June 2024 (2)
  • March 2024 (6)
  • February 2024 (4)
  • October 2023 (5)
  • May 2023 (5)
  • April 2023 (1)
  • December 2022 (1)
  • November 2022 (13)
  • September 2022 (2)
  • August 2022 (7)
  • July 2022 (29)
  • June 2022 (10)
  • May 2022 (25)
  • April 2022 (24)
  • March 2022 (16)
  • February 2022 (19)
  • January 2022 (21)
  • December 2021 (46)
  • November 2021 (5)
  • October 2021 (6)
  • September 2021 (5)
  • August 2021 (41)
  • July 2021 (43)
  • June 2021 (31)
  • May 2021 (7)
  • April 2021 (1)
  • July 2020 (1)
  • June 2020 (3)
  • April 2020 (1)
  • November 2019 (1)
  • July 2019 (1)
  • June 2019 (1)
  • May 2019 (1)
  • April 2019 (2)
  • January 2019 (1)

Pages

  • Home
  • 2nd SEM ভাষাতত্ত্ব :
  • বাংলা উপভাষা
  • দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব
  • ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত সাম্যের অধিকারগুলি আলোচনা করো।
  • হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব আলোচনা করো। তাকে কি উত্তর পথনাথ বলা যায় ?
  • ভারতীয় সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য :-
  • উদারনীতিবাদ : সংক্ষিপ্ত ধারণা :-
  • চোল শাসনব্যবস্থা :-
  • গুপ্তযুগ সুবর্ণযুগ সম্পর্কিত আলোচনা।
  • ৬. উদাহরণসহ মধ্যযুগের বাংলাভাষার কয়েকটি বৈশিষ্ট আল...
  • 1. Marxism
  • আধুনিক বাংলা ভাষা ও তার বৈশিষ্ট।
  • Discuss the career and achievements of Samudragupta .
  • ভাষাতত্ত্ব

Created with by ThemeXpose | Distributed by Blogger Templates