ভাববাদী শিক্ষাদর্শন বা আদর্শবাদী শিক্ষাদর্শন :-

ভাববাদী শিক্ষাদর্শন বা আদর্শবাদী শিক্ষাদর্শন :-

বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদগুলির মধ্যে ভাববাদ বা আদর্শবাদী দর্শন - ই হলো প্রাচীনতম। এই মতবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকগণ আধ্যাত্মিক শক্তিতে বা মানুষের উচ্চ আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁরা বলেছেন , মানুষ  এবং এই সম্পূর্ণ বিশ্ব ব্রম্মান্ড একই আধ্যাত্মিক সত্তার অংশ। ঈশ্বর বা ব্রহ্ম যেমন পরম সত্য , তেমনি মানুষের জীবনের মূল্যবোধগুলিও চিরন্তন সত্য। ঈশ্বরের উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই জীবনের এই মূল্যবোধগুলোকে উপলব্ধি করা সম্ভব আর এই ঈশ্বর উপলব্ধি মানুষের কাছে শিক্ষার মাধ্যমেই কেবলমাত্র সম্ভব।

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


ভাববাদ / আদর্শবাদী শিক্ষাদর্শনের প্রবক্তাগণ 
দার্শনিক মতবাদ হিসেবে ভাববাদের প্রবক্তারূপে প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিস বা প্লেটোর নাম উল্লেখ করা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে এই মতবাদের প্রথম প্রয়োগ করেন কমিনিয়াস ( Comenius )। কমিনিয়াসের এই প্রায়োগিক ধারণাকে পরবর্তীকালে পেস্তালৎসি , ফ্রয়েবেল , রাস্ক -প্রমুখ শিক্ষা দার্শনিকগণ আরো সম্প্রসারিত করেন। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ , বিবেকানন্দ , গান্ধীজিও এই শিক্ষা দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন।

আদর্শবাদ অনুসারে শিক্ষা 
ভাববাদী শিক্ষাদর্শনিকেরা মনে করেন , শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার আধ্যাত্মিক চেতনার চরমস্তরে উন্নীত হতে পারে। তাই তাঁদের কাছে শিক্ষা হলো আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রক্রিয়া।[ Education is the process of attaining spirituality]
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাস্ক ( Rusk ) বলেছেন - শিক্ষা মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের সীমাকে সম্প্রসারিত করে।
ফ্রয়েবেল ( Froebel) এর মতে , শিক্ষা হলো পরমাত্মাকে উপলব্ধির প্রক্রিয়া।
শিক্ষাবিদ হর্নি ( Horne) র মতে , Education is the awakening of the life to the sublime realities and meaning of existence . 
অর্থাৎ ,জীবনের চরম সত্য ও অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতাই হলো শিক্ষা।

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


ভাববাদী শিক্ষা দর্শন অনুসারে শিক্ষার লক্ষ্য 
( i ) শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে ভাববাদী দার্শনিকেরা মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা মনে করেন , ভোগের সামগ্রী মানুষকে তাৎক্ষণিক আনন্দ দিলেও , তাকে চিরন্তন আনন্দের অধিকারী করে তুলতে পারেনা।
( ii ) তাঁরা বলেন , ঈশ্বর হলেন চির আনন্দময়। তাই ঈশ্বর উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই ব্যাক্তিজীবনে চরম আনন্দ আসতে পারে। বিশ্ব আত্মার বা ঈশ্বরের অংশ হলো ব্যাক্তি আত্মা। ব্যাক্তির আত্মোপলব্ধির মধ্যে দিয়ে বিশ্ব আত্মা বা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়।
(iii )ভাববাদী শিক্ষাদর্শন অনুযায়ী আত্মোপলব্ধি হলো শিক্ষার চরম লক্ষ্য। মানুষের অন্তর্নিহিত সকল রকম সম্ভাবনা বা সদগুণ সম্পর্কে সে সচেতন হবে , তখনই তার আত্মোপলব্ধি আসবে এবং বিশ্ব আত্মার সাথে তার মিলন ঘটবে।
( iv )স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন , '' Education is the manifestation of perfection already in man . ''
অর্থাৎ , জীবনের উন্নত মুল্যবোধগুলি জাগ্রত করাই হলো শিক্ষার লক্ষ্য।

পাঠক্রম প্রসঙ্গে ভাববাদী শিক্ষাদর্শন 
ভাববাদী দার্শনিকগণ তাঁদের প্রস্তাবিত শিক্ষার লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে পাঠক্রমের ধারণা গঠন করেছেন। এই শিক্ষাদর্শনে পাঠক্রমের ব্যবহারিক উপযোগিতার কথা বিবেচনা না করে , তাঁর আত্মিক যৌক্তিকতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে , ভাববাদী দার্শনিকগণ তাঁদের প্রস্তাবিত পাঠক্রমে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার তুলনায় মানবীয় জ্ঞানসমূহের ( Humanities ) উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
তাঁরা মনে করেন , আধ্যাত্মিক সত্তার তিনটি দিক আছে - (i )নৈতিক , (ii ) বৌদ্ধিক ও (iii) নান্দনিক। অন্যদিকে তাঁরা বলেছেন , আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রয়াসে মানুষের মধ্যে তিন ধরণের চাহিদা দেখা যায় - জ্ঞান , ভক্তি ও কর্ম। সুতরাং পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত অভিজ্ঞতাগুলি এই তিন ধরণের চাহিদার পরিপূরক হওয়া বাঞ্চনীয়।
ভাববাদী দার্শনিকগণ মনে করেন , পাঠক্রমের অন্তর্গত কবিতা , শিল্পকলা , ধর্ম ইত্যাদি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশে সহায়তা করবে। ভাষা , সাহিত্য , ইতিহাস , ভূগোল , গণিত , বিজ্ঞান - ইত্যাদির প্রথাগত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশে সহায়তা করবে। তাছাড়া , শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্ম সচেতনতা জাগ্রত করার জন্য ভাববাদী দার্শনিকগণ পাঠক্রমে স্বাস্থবিজ্ঞান , হস্তশিল্প - ইত্যাদি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন।

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


শিক্ষন পদ্ধতি ও শিক্ষক প্রসঙ্গে ভাববাদ 
ভাববাদী শিক্ষাদর্শনে শিক্ষককে মর্যাদার আসনে স্থাপন করা হয়েছে। ভাববাদী শিক্ষাদর্শনিকেরা মনে করেন - যে ব্যাক্তি পরিপূর্ণভাবে আত্মোপলব্ধির স্তরে উন্নীত হয়েছেন , তিনিই শিক্ষক হওয়ার যোগ্য। প্রত্যেক শিক্ষক জীবনের উচ্চতম মূল্যবোধগুলোর অধিকারী হবেন। তিনি তাঁর ব্যাক্তিত্বের দ্বারা শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করবেন।
এই দার্শনিক ধারণা অনুসারে শিক্ষকের কাজ জ্ঞান বিতরণ করা নয় ; শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দেওয়াই তাঁর প্রধান কাজ। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার নিজস্ব জীবনধর্ম অনুযায়ী সত্যের অনুসন্ধানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়োজিত থাকে। শিক্ষকের কাজ হবে তাদের সেই অনুসন্ধানের প্রচেষ্টায় সহায়তা করা।
সুতরাং , ভাববাদী দর্শন অনুযায়ী শিক্ষকের কাজ প্রথাগতভাবে জ্ঞান বিতরণ করা নয় ; তাঁর মূল কাজ হলো - শিক্ষার্থীর নিজের মধ্যে যে জ্ঞানের ভান্ডার আছে - সে সম্পর্কে তাকে সচেতন করে তোলা। তাই শিক্ষক প্রত্যক্ষভাবে তথ্য পরিবেশন করার পরিবর্তে শিক্ষার্থীকে  নিজের জ্ঞানের উত্সগুলিকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবেন।

মন্তব্য / সমালোচনা 
(i )শিক্ষা ক্ষেত্রে ভাববাদী শিক্ষাদর্শনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে চিন্তাবিদগণ এই মতামত ব্যক্ত করেছেন যে , এই মতবাদের সাথে বাস্তব অবস্থার সম্পর্ক খুবই কম।
( ii ) অনেকে মনে করেন , সম্পূর্ণ শিক্ষা প্রচেষ্টা সমাজব্যবস্থায় যত বেশি ব্যবহারিক মূল্য অর্জন করেছে , ভাববাদী শিক্ষাদর্শনের তাৎপর্য ততই হ্রাস পাচ্ছে।
( iii ) এখানে শিক্ষার পাঠক্রমে ব্যবহারিক বিষয়সমূহের অনুশীলনকে অবহেলা করা হয়েছে।
( iv ) শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষন পদ্ধতির গুরুত্বকেও ভাববাদী দর্শনে অস্বীকার করা হয়েছে।
( v ) এখানে সর্বাঙ্গীন শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায় শিক্ষকের ব্যাক্তিত্বকে অতিরিক্ত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
( vi ) এই ধরণের সম্পূর্ণ শিক্ষক নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।       

Share
Tweet
Pin
Share