১. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।

১. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদানগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে দেশীয় ও বৈদেশিক উভয়  প্রকার সাহিত্যের কথাই বলতে হয়। তবে সাহিত্যিক উপাদানগুলির মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন - কোনো রাজা বা রাজবংশের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাত। তা স্বত্তেও ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদানগুলিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যবহার করেছেন। নিম্নলিখিত আলোচনা অংশে ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদানগুলির সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।



বৈদিক সাহিত্য :- ভারতীয় সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই বেদ ও বৈদিক সাহিত্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগের ইতিহাস জানতে আমাদের বহুলাংশে বৈদিক সাহিত্যের উপর নির্ভর করতে হয়। বৈদিক সাহিত্য ঋক , সাম , যজু , অথর্ব - এই চারটি বেদ ছাড়াও ব্রাহ্মণ , আরণ্যক সূত্র ও উপনিষদকে বোঝায়। প্রাচীন ভারতের সামাজিক , সাংস্কৃতিক , রাষ্ট্রনৈতিক - এমন বহু বিষয় সম্পর্কে তথ্য বেদ থেকে পাওয়া যায়। প্রাথমিক চারটি বেদ রচিত হয়েছিল প্রাচীন বৈদিক যুগে। অন্যান্য বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে।
এস এন প্রধান এর মতে , প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বৈদিক সাহিত্য যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবিদার।
আবার , পার্টিজারের মতে , বৈদিক সাহিত্যগুলির মধ্যে ইতিহাসবোধের অভাব রয়েছে।

আর্থ -সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি বৈদিক সাহিত্যগুলি থেকে প্রাচীন ভারতের সমৃদ্ধ দার্শনিক উপলব্ধি গুলি সম্পর্কেও জানা যায়।  বেদের সীমাবদ্ধতা স্বত্তেও একথা অনস্বীকার্য যে , ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে বৈদিক সাহিত্য অপরিহার্য।



পুরান বা পৌরাণিক সাহিত্য :- পুরান বলতে প্রাচীন কাহিনী ও ধর্মীয় অনুশাসনের সংক্ষিপ্তসারকে বোঝায়। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পুরানের গুরুত্ব কম হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে পুরান ইতিহাস রচনা করতেও সাহায্য করে।
যেমন - (ক ) মৌর্য বংশের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বিষ্ণু পুরান একটি বিশ্বাসযোগ্য উপাদান।
(খ ) সাতবাহনদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে মৎস পুরান গুরুত্বপূর্ণ।
(গ ) গুপ্তদের আদি বাসস্থান এবং আদি পর্বের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বায়ু পুরান উল্লেখযোগ্য।
তবে পৌরাণিক সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো - এতে বেশিরভাগ ঘটনাই কল্পনার পর্যায়ে পড়ে তাই এগুলি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক বা অন্যান্য সাহিত্যিক উপাদান ছাড়া এগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্তরায় রয়েছে।

মহাকাব্য - রামায়ণ ও মহাভারত :- বৈদিক সাহিত্যের পর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় সাহিত্য উপাদান হলো রামায়ণ ও মহাভারত। ম্যাকডোনালের মতে , রামায়ণ রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বে এবং রাম রাবনের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে আর্য ও অনার্যের সংঘর্ষের কাহিনী।
রামায়ণ থেকে বোঝা যায় আর্য সভ্যতা দক্ষিণে সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মহাভারত থেকে আর্যদের সভ্যতা ও রাজনৈতিক বিস্তারের কথা জানা যায়। তবে ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে রামায়ণের থেকে মহাভারতকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে রামায়ণ শিল্পসৌন্দের্যের দিক দিয়ে অধিক কৃতিত্বের দাবিদার।
উইন্টারনিজ এর মতে , মহাকাব্যদুটি শুধুমাত্র কাব্যই নয় , তা একটি সমগ্র সাহিত্য।

বৌদ্ধ সাহিত্য :- বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহ যথা - ত্রিপিটক , জাতক , দ্বীপবংশ ও মহাবংশ, দীর্ঘনিকায় , অঙ্গুরতরনিকায়   - ইত্যাদি থেকে সমকালীন ভারতের আর্থ -সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায়। দ্বীপবংশ ও মহাবংশ থেকে সম্রাট অশোকের ও সিংহলের ইতিহাস জানা যায়। জাতক নামক বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। প্রায় ৫৪৯ টি জাতক কাহিনী র সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও ললিতাবিস্তার ও বৈপুল্য - সূত্র গ্রন্থগুলি থেকে বুদ্ধের জীবনী ও বৌদ্ধ ধর্মের নীতিগুলি সম্পর্কে জানা যায়।

জৈন সাহিত্য :-  জৈন সাহিত্য ভগবতীসূত্র খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ইতিহাস জানতে সহায়তা করে। ভদ্রবাহু রচিত জৈন -কল্পসূত্র থেকে মহাবীরের জীবন কাহিনী জানা যায়। এছাড়াও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি ও মেরুত্তুঙ্গ গ্রন্থটি ইতিহাস রচনার কাজে লাগে।



স্মৃতিশাস্ত্র :- স্মৃতিশাস্ত্রগুলির মধ্যে প্রধান হলো - মনুর স্মৃতি , নারদ স্মৃতি , বৃহস্পতি স্মৃতি - ইত্যাদি। খ্রিস্টীয় প্রথম অব্দের ছয় শতকের মধ্যে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থগুলিতে রাজা , অমাত্য ও বিভিন্ন বর্ণের মানুষের কাব্যের কথা বলা আছে এবং সমাজের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।

মৌর্য যুগের সাহিত্য :- মৌর্য ও পরবর্তী মৌর্য যুগের বিভিন্ন সাহিত্যিক উপাদানগুলি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র - যা সমকালীন ভারতের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ভরযোগ্য দলিল। এছাড়াও পাণিনির অস্টাধ্যায়ী , পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থদুটি থেকে বৈদিক যুগের পরবর্তী ইতিহাস , শুঙ্গ রাজবংশ , গ্রীক ও ব্যাকটিরিওদের মধ্য ভারত আক্রমণ সম্পর্কে জানা যায়। 

গুপ্তযুগের সাহিত্য :- সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেন রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের উত্তর ও দক্ষিণ ভারত অভিযান , তাঁর কবি প্রতিভা ও সঙ্গীত অনুরাগ সম্পর্কে জানা যায়। ভাস ও কালিদাসের রচনা থেকে সমকালীন ভারতের সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। কালিদাসের রঘুবংশম থেকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের কথা জানা যায়। এছাড়া  বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা ও বাৎসায়নের কামসূত্র গ্রন্থদুটিও সমকালীন ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যান্য সাহিত্য উপাদান :- উপরোক্ত সাহিত্যকীর্তিগুলি ছাড়াও আরো বহু সাহিত্য নিদর্শন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানতে সহায়তা করে। যেমন - বাণভট্টের হর্ষচরিত থেকে হর্ষবর্ধনের জীবন ও রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত থেকে পালদের বরেন্দ্রভূমি উদ্ধারের ইতিহাস জানা যায়। কলহনের রাজতরঙ্গিনী থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায়। চার্চনামা গ্রন্থটি থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়।  ইত্যাদি।
বৈদেশিক সাহিত্য উপাদান :-
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় বৈদেশিক বিবরণী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে বিদেশি ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রধানত গ্রিক , রোমান , চৈনিক ও মুসলিমদের রচিত বিবরণী প্রাচীন ভারত সম্পর্কে জানতে যথেষ্ট সহায়তা করে। যেমন -
(i) প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় একটি অপরিহার্য গ্রন্থ হলো '' পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সি ''। এই গ্রন্থের লেখকের নাম জানা যায় না ; তবে গ্রন্থটি ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যের একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে সমাদৃত।
(ii) মেগাস্থিনিস রচিত ইন্ডিকা গ্রন্থটি থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তথা মৌর্য সাম্রাজ্যের সমাজ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা জানার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান।
(iii) হিউয়েন সাঙ রচিত সি -ইউ -কি গ্রন্থটি হর্ষবর্ধন ও তৎকালীন ভারতের আর্থ -সামাজিক ব্যবস্থা জানার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উপাদান।
(iv) উত্তর ভারতের মুসলিম জয়ের কাহিনী জানার জন্য আরব পর্যটক আল মাসুদি এবং সুলেমানের রচনার ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়।
(v) আলবিরুনির '' তহকক-ই -হিন্দ '' নামক গ্রন্থটি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অমূল্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
(vi) টলেমির ভূগোল ও প্লিনির খনিজ ও অরণ্য সম্পদ সম্পর্কে বর্ণনা থেকেও বহু মূল্যবান উপাদান পাওয়া যায়।
(vii) চৈনিক ঐতিহাসিক সু -মা -কিয়েন রচিত '' ইতিহাস '' নামক গ্রন্থ থেকে ইতিহাস রচনার বহু উপাদান পাওয়া যায়।
এছাড়াও  বৈদেশিক সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - আরিয়ান , কার্টিয়াস , প্লুটার্ক , হাসান নিজামি , অল মাসুদি , ডিওনিওসাস , ডিওডোরাস - প্রমুখ।
তবে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহিত্যিক উপাদানগুলির কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন - 
*গ্রন্থের বিবরণ যাইই থাক না কেন , তা সতত পরিবর্তিত হয়। অনেক সময় মূল গ্রন্থটি পাওয়া যায় না ; ভাষান্তর করার সময় তার অনুবাদ মূল বিবরণীর পরিবর্তন ঘটায়।
*প্রথম পর্যায়ের লেখক যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গ্রন্থটি লিখেছেন পরবর্তীকালে সেই দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক প্রয়োগ নাও হতে পারে।
*গ্রন্থগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবস্থাপন্ন বা ক্ষমতাশালী মানুষের কথা লেখা হয়। এ থেকে পূর্ণাঙ্গ সমাজের চিত্র অঙ্কন করা যায় না।
*ভারতীয় সাহিত্যিকদের অতিরিক্ত আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃত ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে।
*বৈদেশিক ঐতিহাসিকদের বিবরণীগুলিতেও কিছু সমস্যা আছে। ভারত ভ্রমণ করতে এসে অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ভারত সম্পর্কে জানা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তাদের জনশ্রুতি ও লোককথার উপর নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে বিবরণীগুলির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকে।
*সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকদের রচনা অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে থাকে। পৃষ্ঠপোষক শাসকের গুণগান ও বিরোধী শক্তির সমালোচনা - প্রধান বিষয় হয়ে উঠলে তা থেকে প্রকৃত ইতিহাস জানা সম্ভব নয়।   

Share
Tweet
Pin
Share