৩. উনিশ শতকে বাংলা কাব্যচর্চা / উনিশ শতকে বাঙালির কাব্যসাহিত্য :-

৩. উনিশ শতকে বাংলা কাব্যচর্চা / উনিশ শতকে বাঙালির কাব্যসাহিত্য :-

উনিশ শতক : বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক যুগসন্ধিক্ষন :-
কোম্পানির শাসনব্যবস্থা কায়েম হওয়ার পর এদেশীয় কিছু মানুষ অভুতপূর্ব ধনসম্পদের অধিকারী হয় এবং ''বাবু কালচার'' এর আবির্ভাব ঘটে। এই বাবু  কালচার ছিল নৈতিকতা বিরোধী , সংস্কৃতি বিরোধী উদ্ভট আমোদ প্রমোদের এক বিচিত্র আয়োজন। ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়ের '' নববাবু বিলাস '' , প্যারীচাঁদ মিত্রের '' আলালের ঘরের দুলাল '' , কালীপ্রসন্ন সিংহের '' হুতোম প্যাঁচার নকশা '' - এই সকল গ্রন্থে বাবুসমাজের সেই পচনশীল জীবনের কাহিনী চিত্রিত আছে। তাদের সেই সংস্কৃতিতে কবিগান ও আদিরস চর্চা ছিল প্রধান।


কিন্তু তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকজন কবি সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে যাঁরা অষ্টাদশ শতকের ঘুণধরা সংস্কৃতি থেকে বাংলা কাব্য সাহিত্যকে মুক্তি দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তিনি তাঁর তীব্র লেখনীর সাহায্যে প্রচলিত ঘৃণ্য সংস্কৃতির তীব্র বিরোধিতা করেন ও বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক কর্মসূচিগুলিকে সমর্থন করতে থাকেন। তিনি তৎকালীন রক্ষণশীল মানসিকতার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাই কবি ঈশ্বর গুপ্তকে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলা হয়।
বাংলা কাব্যসাহিত্যে নবযুগের অভ্যুত্থান :-
উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। প্রাচীন ও আধুনিক যুগের মধ্যস্থতাকারী কবি ঈশ্বর গুপ্তের জীবনাবসান ঘটে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। তবে তাতে নবযুগের রথচক্র থেমে থাকেনি। এরপর নবযুগের আরেকজন পথিকৃৎ মধুসূদন দত্তের '' তিলোত্তমাসম্ভব '' কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। এরপর একে একে আবির্ভুত হন - রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় , হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় , নবীনচন্দ্র - প্রমুখ। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং মার্জিত রুচির অধিকারী এসকল কবিরা প্রগতিশীল কাব্য রচনার মধ্যে দিয়ে নবযুগের গতিধারাকে অব্যাহত রেখেছিলেন।
উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে নবযুগের প্রধান ফসল :-
উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে নবযুগের প্রধান ফসল হলো - আখ্যানকাব্য ও মহাকাব্য। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নবভাবধারায় উজ্জীবিত এই সময়কার কবিগণ কাব্যের মধ্যে হাস্যচপল চটুলতা বিসর্জন দিয়ে ইতিহাসের বীররস , প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে কাব্যের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করলেন। এই ধারার মধ্যে প্রকাশিত হলো আধুনিক জীবন , প্রগতিবাদী মনোভাবের স্ফুরণ ও প্রাচীন বহুচর্চিত বিষয়গুলির নব আঙ্গিকে প্রকাশ করার মনোভাব। বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাই উনিশ শতককে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলা যেতে পারে।
আখ্যানকাব্য :-
প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক চরিত্র , রাজা - মহারাজার কাহিনী ইতিহাসসম্মতভাবে রচিত না হয়ে কল্পকাহিনীর আকারে রচিত হলে তা হলো আখ্যানকাব্য। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়ের ''পদ্মিনী উপাখ্যান '' একটি সার্থক আখ্যানকাব্যের উদাহরণ। এই কাব্যের মধ্যে আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ এবং জহরব্রতের আগুনে রানী পদ্মিনীর আত্মবিসর্জনের ইতিহাস জানা যায়। এই কাব্য শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে তীব্র দেশপ্রেমের বাণী সঞ্চারিত করে।
'' স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে , কে বাঁচিতে চায়।
  দাসত্বশৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে , কে পরিবে পায় ? ''
রঙ্গলাল কর্তৃক রচিত পদ্মিনী উপাখ্যানে ক্ষত্রিয়দের প্রতি রানা ভীমসিংহের এই বাণী স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ফিরত। 

  এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।

মহাকাব্য 
কাহিনী যখন দেশ কালের সীমা  অতিক্রম করে বিশাল জাতীয় জীবনের প্রতিভুরূপে আত্মপ্রকাশ করে , তখন তাকে মহাকাব্য বলে। এর প্রকাশভঙ্গিতে থাকে নিখিল মানবাত্মার সহজাত স্ফুরণ। এর মধ্যে বিন্যস্ত থাকে মূল কাহিনীর পাশাপাশি এক বা একাধিক উপকাহিনীর জাল। মধুসূদনের ''মেঘনাদবধ কাব্য '' হলো একখানি সার্থক মহাকাব্য। মেঘনাদ বধ কাব্য কে বাংলা সাহিত্যে যুগান্তকারী রচনা বলে মনে করা হয়। বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসের রামায়ণের অনুসরণে এর কাহিনী গৃহীত হয়েছে। নব্য ছন্দ প্রয়োগ , নব্য আঙ্গিকের প্রয়োগ , নব ভাবধারার প্রবর্তন - হলো মেঘনাদবধ কাব্যের মূল অবদান।
বীরাঙ্গনা কাব্য ও নব আঙ্গিকের আত্মপ্রকাশ
পত্রকাব্য বাংলা সাহিত্যে একটি অসাধারণ অভিনব সংযোজন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই রীতির প্রবর্তক। তিনি '' বীরাঙ্গনা '' কাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিক নির্দেশ করেন। এই পত্রকাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ দেখা যায়। পত্রকাব্য গুলি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সৃষ্টি। রামায়ণ , মহাভারত - ইত্যাদি মহাকাব্যের মহিয়সী নায়িকারা এই পত্রকাব্যগুলির প্রধান চরিত্র।
চতুর্দশপদী কবিতার আত্মপ্রকাশ 
মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরেই বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সর্বপ্রথম ইতালীয় কবি পেত্রার্ক ''সনেট '' নামে এক নতুন আঙ্গিকের কবিতা রচনা করেন। এই জাতীয় কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট হলো কবিতা ১৪ টি পঙক্তিতে রচিত হবে এবং এই ১৪ পদের কবিতাতে থাকবে ২ টি অংশ। প্রথমটি ৮ পদের অষ্টক এবং দ্বিতীয়টি ৬ পদের ষষ্ঠক। শেক্সপিয়র ছিলেন এই ধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি। এই সনেটেরই বাংলা প্রকাশ হলো চতুর্দশপদী কবিতা।
গীতিকাব্য ; উনিশ শতকে গীতিকাব্যের উন্মেষপর্ব 
উপরোক্ত কাব্যধারাগুলির পাশাপাশি উনিশ শতকে বাংলা গীতিকাব্যেরও উত্থান ঘটে। এঁদের মধ্যে বিহারীলাল চক্রবর্তী , সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার , অক্ষয় কুমার বড়াল , দেবেন্দ্রনাথ সেন - প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে সৌন্দর্যচেতনা , নারীচেতনা , প্রকৃতিচেতনা , স্বদেশপ্রেম - ইত্যাদির তীব্র অনুভূতি প্রকাশলাভ করেছে। এছাড়াও এই ধারার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো মহিলা কবিদের আত্মপ্রকাশ। মহিলা কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা ছিলেন - গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী , কামিনী রায় , মানকুমারী বসু , স্বর্ণকুমারী দেবী - প্রমুখ।
বিহারীলাল চক্রবর্তীকে আধুনিক গীতিকবিতার জনক বলা হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হলো - সারদামঙ্গল , সংগীতশতক , বঙ্গসুন্দরী , নিসর্গ - নিদর্শন , বন্ধুবিয়োগ , প্রেমবাহিনী , সাধের আসন - ইত্যাদি। বিহারীলালের উত্তরসূরিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার , অক্ষয়কুমার বড়াল , দেবেন্দ্রনাথ সেন -  প্রমুখ।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে উনিশ শতক ছিল যথার্থ অর্থেই বাংলা সাহিত্য তথা কাব্য সাহিত্যের নবজাগরণের যুগ। এই শতকেই যেমন প্রচলিত ঘুণধরা কাব্যরীতির পরিবর্তন ঘটে তেমনই তার সাথে সাথে আধুনিক নানান আঙ্গিকের আত্মপ্রকাশ ঘটে ও বাংলা কাব্য সাহিত্য শ্রেষ্ঠত্বের আসনে উপনীত হয়।   

Share
Tweet
Pin
Share