২. বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সম্পর্কে লেখো।

২. বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সম্পর্কে লেখো। 

ঊনিবিংশ শতাব্দীর বাংলার মাটিতে আবির্ভুত কয়েকজন জ্যোতির্ময় পুরুষ , ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল , কীর্তিমান বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম হলেন মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অসাধারণ মেধা , তীব্র বিচারবুদ্ধি , সুবিশাল পান্ডিত্য এবং দুর্জয় হৃদয়বৃত্তির ঐশ্বর্য ছটায় তাঁর জীবন ছিল প্রদীপ্ত। সাহিত্য , সমাজসেবা , সমাজ সংস্কার , মানবিকতাবোধ - সর্বক্ষেত্রেই তিনি তাঁর বিজয়পতাকা উড্ডীন করেছেন। বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিশেষতঃ শিশুসাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান অপরিসীম। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যের সূচনা না করলেও বাংলা গদ্যের বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত।



বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক হিসেবে বিদ্যাসাগর :-
বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক কে - সে সম্পর্কে বিতর্ক কম নেই। কেউ রামমোহনকে , কেউ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকদের বাংলা গদ্যের প্রবর্তক বলে মনে করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের প্রথম সূত্রপাত না ঘটলেও সর্বপ্রথম শিল্পসম্মত গদ্যরীতির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। সংস্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত হওয়ার দরুন তিনি তাঁর সেই জ্ঞান বাংলা গদ্যরূপের মধ্যে আরোপ করে বাংলা গদ্যকে তিনি সুসমত্ব প্রদান করেন। সর্বোপরি বাংলা গদ্যসাহিত্যে তিনি সাহিত্য রসের সঞ্চার করেন। তাঁর প্রবর্তিত গদ্য রীতির পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে বাংলা গদ্যের ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। সুতরাং এদিক দিয়ে বিচার করলে বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক বলতে দ্বিধা নেই।
বিদ্যাসাগরের সাহিত্যিক উৎকর্ষ সম্পর্কে বিতর্ক :-
কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন , বিদ্যাসাগরের মৌলিক সাহিত্য নেই বললেই চলে ; সবই অনুবাদ। কিন্তু মনে রাখতে হবে বিদ্যাসাগরের অনুবাদকর্মগুলি নিছক আক্ষরিক অনুবাদ নয় ; সেগুলির মধ্যে আছে স্বাধীন কল্পনা বিন্যাসের দৃষ্টান্ত ও উপস্থাপনায় মৌলিকতা। তার সাথে সাথে এও মনে রাখতে হবে তিনি নিছক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য সাহিত্য রচনা করেন নি ; তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল জনহিতা ও জনসেবা। তাই তাঁর মৌলিক রচনা ও অনুবাদ কর্ম উভয়ই ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষার ও জ্ঞানের বিকাশের লক্ষ্যে নিয়োজিত।
বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনা :-
বিদ্যাসাগরের মৌলিক গ্রন্থাবলী গুলি হলো - '' সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫১) '' , ''বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি'না - এবিষয়ক প্রস্তাব ( ১৮৫৫)'' , ''বহুবিবাহ রোহিত হওয়া উচিত কি'না - এ বিষয়ক প্রস্তাব '' , বিতর্কমূলক রচনা ''প্রভাবতী সম্ভাষণ ( ১৮৬৩)'' , আত্মজীবনী - '' বিদ্যাসাগর চরিত ( ১৮৯১) '' , ছোটদের জন্য শিশুপাঠ্য - বর্ণপরিচয় , কথামালা , বোধোদয় - ইত্যাদি।
বিদ্যাসাগরের অনুবাদ রচনা :-
তাঁর অনুবাদ গ্রন্থগুলি হলো - হিন্দি ''বৈতালী পচ্চিসী '' গ্রন্থের অনুবাদ '' বেতাল পঞ্চবিংশতি '' ; মহাকবি কালিদাসের '' অভিজ্ঞানশকুন্তলম '' নাটকের অনুবাদ গ্রন্থ '' শকুন্তলা '' , বাল্মীকির রামায়ণের উত্তরাকাণ্ডের অনুসরণে '' সীতার বনবাস '' ; শেক্সপিয়রের এর অনুবাদ '' ভ্রান্তিবিলাস ''।
তাঁর অনুবাদ গ্রন্থগুলির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট হলো -
(ক ) গ্রন্থগুলি মৌলিক সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত।
(খ ) গদ্যের ভাষা উপস্থাপনা সম্পূর্ণ নিজস্ব।
(গ ) কোনো কোনো অনুবাদ ক্লাসিক সাহিত্য পর্যায়ে উন্নীত।
ব্যাঙ্গাত্মক রচনা :-
উপরোক্ত রচনাগুলি ছাড়াও বিদ্যাসাগর কিছু ব্যাঙ্গাত্মক সাহিত্য সৃষ্টিও করেছিলেন। যেমন - '' অতি অল্প হইল (১৮৭৩)'' , ''আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩) , '' ব্রজবিলাস (১৮৮৪)'' । এই তিনখানি গ্রন্থ তিনি '' কস্যচিত উপযুক্ত ভাইপোস্য '' ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন - '' বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উশৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত , সুবিন্যস্ত , সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করে তাকে সহজ গতি বা কার্যকুশলতা দান করেছেন। '' বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যভাষাকে ছেদ - চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে , শব্দবিন্যাসের কৌশলে সরসতায় উন্নীত করেছিলেন বলেই তাঁকে ''বাংলা গদ্যের জনক '' আখ্যা দিতে কোনো দ্বিধা থাকে না।    


    এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


           

Share
Tweet
Pin
Share