প্রকৃতিবাদ কাকে বলে ? শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।

প্রকৃতিবাদ কাকে বলে ? শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো। 
অথবা ,
প্রকৃতিবাদ কাকে বলে ? শিক্ষার লক্ষ্য , পাঠক্রম , শিক্ষাপদ্ধতি , শিক্ষক , শৃঙ্খলা ও বিদ্যালয় সংগঠন - ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদের ভূমিকা আলোচনা করো। 

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


প্রকৃতিবাদ 

ভাববাদী দর্শনের বিকল্প মতবাদ হিসেবে প্রকৃতিবাদের উৎপত্তি। প্রকৃতিবাদ সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করে যে - শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেন - কেবলমাত্র এইটুকু চিন্তা করা যথার্থ নয়। বরং যা সঠিকভাবে বলা উচিত তা হলো - শিক্ষার্থীই নিজস্ব স্বাভাবিক ইচ্ছা , আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষালাভ করে থাকে। এই মতবাদ জীবন ও শিক্ষার পরিধিতে সকল প্রকারের কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা ও বাহ্য নিয়ন্ত্রণের স্থান নেই বলে প্রচার করা হয়েছে।
সুতরাং এককথায় বলা যায় - প্রকৃতিবাদ হলো শিক্ষার্থীর ইচ্ছাশক্তির স্বাভাবিক প্রকাশ যা এই দৃশ্যমান জগৎকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে।

ত্রিবিধ দৃষ্টিকোণ 
প্রকৃতিবাদের প্রবক্তাগণ বস্তুজগতের বিশ্লেষণে ত্রিবিধ দৃষ্টিকোণের অবতারণা করেছেন। যেমন -
বাহ্য প্রকৃতিবাদ - বাহ্য জড়প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে মানুষের জীবনের গতি নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। এটি হলো জড়প্রকৃতি।
যান্ত্রিক প্রকৃতিবাদ - এই মতে সমগ্র বিশ্ব একটি বিশাল যন্ত্রের মতো। জড়জগৎ যেমন যান্ত্রিক নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , মানুষের মনও এই জড়প্রকৃতির অংশ হিসেবে যান্ত্রিক নিয়মেরই অধীন। মানুষ সহ সকল জীবই ভৌত নিয়মের অধীনে কাজ করে থাকে।
জৈবিক প্রকৃতিবাদ - এক্ষেত্রে মানুষের জৈবিক সত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই অর্থে মানুষ ইতর প্রাণীদের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু মানুষ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শ্রেষ্ঠ জীবে পরিণত হলেও ইতর প্রাণীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে থাকে।

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।


প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের অভিমত 
প্রকৃতিবাদী দর্শন অনুসারে মানুষের স্বাভাবিকত্ব গুরুত্ব পেয়েছে এবং আধ্যাত্মিকতা গুরুত্ব হারিয়েছে। মানুষের সহজাত বিবেকশক্তি ও পারলৌকিক বিশ্বাস এখানে মিথ্যা। এখানে যা সত্য তা হলো - মানুষের বাহ্য প্রকৃতি , অন্তর্প্রকৃতি ও কৃত্রিমতার বাঁধনমুক্ত পরিবেশ।
প্রবক্তাগণ 
প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - এরিস্টটল , অগাস্ট কোঁৎ , রুশো  , ফ্রয়েবেল , হার্বার্ট স্পেনসার , রবীন্দ্রনাথ , মন্তেসরি ও আরো অনেকে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে রুশো হলেন এই মতবাদের চরমপন্থী প্রবক্তা।
প্রকৃতিবাদ ও শিক্ষা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদের গুরুত্ব / ভূমিকা :-
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদের প্রভাবকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যেমন -
প্রকৃতিবাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য - প্রকৃতিবাদী দার্শনিকেরা আত্মপ্রকাশনে সহায়তাকে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত করেছেন। শিশুর সহজাত প্রবৃত্তিগুলির উন্নতিকরণ , ভবিষ্যত জীবনের প্রস্তুতি , শিশুকে সমসুযোগের পথে অগ্রসর করা - এসবই হলো প্রকৃতিবাদ অনুসারে শিক্ষার লক্ষ্য।
এ প্রসঙ্গে রুশো বলেছেন যে , শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বীয় স্বভাবধর্ম অনুসারে শিশুর আত্মবিকাশ।
পাঠক্রম রচনায় প্রকৃতিবাদ - প্রকৃতিবাদীরা পাঠক্রমে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি পছন্দ করেন না। তারা পাঠক্রম স্থির করতে বলেন শিশুর প্রকৃতি ও চাহিদা অনুসারে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা পাওয়ার কথা বলে থাকেন প্রকৃতিবাদীরা। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রকৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন বিষয় যেমন - কৃষিবিজ্ঞান , প্রকৃতি পরিচয় , জীবনবিজ্ঞান , ভৌত বিজ্ঞান এবং এছাড়াও আত্ম প্রকাশনার সাথে যুক্ত বিভিন্ন বিষয় যেমন - ভাষা , গণিত , ইতিহাস , অবসর বিনোদন - ইত্যাদি বিষয়গুলোকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন প্রকৃতিবাদীরা।

এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।

শিক্ষা পদ্ধতি ও প্রকৃতিবাদ - গ্রন্থকেন্দ্রিক বক্তৃতা পদ্ধতির পরিবর্তে প্রকৃতিবাদীরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালাভের শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কর্মের মাধ্যমে শিক্ষা - হলো প্রকৃতিবাদী শিক্ষার মূলকথা।
এ প্রসঙ্গে রুশো বলেছেন - Give your scholar no verbal lesson ; he should be taught by experience .
অর্থাৎ প্রকৃতিবাদীরা পুস্তক নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতিকে বাতিল করে দিয়ে গুরুত্ত্ব আরোপ করেছেন - অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার উপর।
শিক্ষক ও প্রকৃতিবাদ - শিক্ষায় শিক্ষকের স্থান নিরুপন করার জন্য প্রকৃতিবাদ শিক্ষককে নেপথ্য পরিচালক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শিক্ষক শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক আগ্রহ ও স্বাভাবিক বিকাশের উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত পটভূমি ও পরিবেশ গঠন করবেন।
অধ্যাপক Ross এ প্রসঙ্গে বলেছেন - শিক্ষক নিজ বক্তব্য পরিবেশন অপেক্ষা শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতাকেই অধিক গুরুত্ব প্রদান করবেন।
বিদ্যালয় সংগঠন ও প্রকৃতিবাদ - প্রকৃতিবাদের মতে শিক্ষাকেন্দ্র হবে মুক্ত , উদার , অবাধ , প্রাণময় , ও কর্মচঞ্চল। এখানে শৃংখলাহীন পরিবেশে শিশুর অবাধ স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার বিকাশের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কঠোরতা বর্জন ও মুক্ত শৃঙ্খলার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে , শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদীরা সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব প্রদান করেছেন শিক্ষার্থীকে। শিক্ষা পদ্ধতি , পাঠক্রম , শিক্ষক , বিদ্যালয় সংগঠন - প্রভৃতি সবকিছুতেই প্রকৃতিবাদ নিয়ে এসেছে শিশু মনস্তত্বের স্বাভাবিক বিকাশের ধারা। 

Share
Tweet
Pin
Share