­
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ - NANDAN DUTTA

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

১. বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান আলোচনা করো। 
অথবা ,
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রধান দুইজনের নাম করো এবং বাংলা গদ্য সাহিত্যের ক্রমবিকাশে তাঁদের কৃতিত্বের পরিচয় দাও। 

অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বিলেত থেকে তরুণ সিভিলিয়ানরা চাকরি নিয়ে কোলকাতায় এলে তাদের দেশীয় ভাষা , ইতিহাস , ভূগোল - ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতার লালবাজার এলাকায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর উইলিয়াম কেরী ১৮০৭ সালে এই কলেজে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এই অবস্থায় তিনি উপলব্ধি করেন সহজ - সরল ভাষায় বাংলা গদ্য গ্রন্থ রচিত না হলে সাহেবদের সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করার উপযোগী ভাষা শিক্ষা দেওয়া দুস্কর। এজন্য তিনি নিজেই বাংলা গদ্য রচনায় হস্তক্ষেপ করেন। এরপর থেকে মূলত কেরী সাহেবের উদ্যোগেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশ তরান্বিত হতে থাকে। এছাড়াও তিনি এদেশীয় কিছু পন্ডিত নিযুক্ত করে তাঁদের বাংলা গদ্য রচনায় উৎসাহিত করতে থাকেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন - মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার , রামরাম বসু , গোলোকনাথ শর্মা , তারিণীচরণ মিত্র , রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় , চন্ডীচরণ মুনসি , রামকিশোর  তর্কচূড়ামনি , হরপ্রসাদ রায় , কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন। এঁদের কেউ কেউ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক না হলেও কেরী সাহেবের উৎসাহে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। 



উইলিয়াম কেরী :-

উইলিয়াম কেরী ইতিহাসমালা ও কথোপকথন গ্রন্থদুটি রচনা করেন। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সমাজ সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করতে কথোপকথন গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাম্য দৈনন্দিন জীবনের সাথে যোগযুক্ত হতে হলে যে সাধারণ ভাষা জানা প্রয়োজন সেই ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তাঁর কথোপকথন গ্রন্থটিতে। তবে ইতিহাসমালা গ্রন্থটি উইলিয়াম কেরির মৌলিক রচনা নয়; দেশি - বিদেশি ১৫ টি গল্প নিয়ে সংকলিত এই গ্রন্থটির ভাষা সহজ -সরল -প্রাঞ্জল প্রকৃতির এবং তা সাধুরীতির অনুগামী। কেরী সাহেব ভারতের প্রাচীন পিছিয়ে পিছিয়ে পড়া শিক্ষারীতির পরিবর্তে আধুনিক সাহিত্য , বিজ্ঞান , গণিত , ইতিহাস , দর্শন - ইত্যাদি প্রগতিশীল পদ্ধতিতে আলোচনার মাধ্যমে পাঠক ও শিক্ষার্থীর মন থেকে যাবতীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন। 

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার :-

বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারকে একজন যথার্থ ভাষাশিল্পী বলা যায় এবং তিনি ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একজন প্রধান পন্ডিত। লেখকের   ''বত্রিশ সিংহাসন '' (১৮০২) গ্রন্থটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সার্থক বাহন। এছাড়া তাঁর ''হিতোপদেশ'' ( ১৮০৮) গ্রন্থটিতে সংস্কৃত ভাষার প্রয়োগ বেশি থাকায় গাম্ভীর্যভাব লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া তিনি তাঁর ''রাজাবলি '' (১৮০৮) গ্রন্থটিতে ইতিহাস আশ্রিত ঘটনায় লোকভাষা প্রয়োগ করার যে নিদর্শন রেখেছেন - তা চিরস্মরণীয়। লেখকের ''প্রবন্ধচন্দ্রিকা'' য় - জ্যোতির্বিজ্ঞান , তর্কশাস্ত্র , ব্যাকরণ , রাজনীতি , আইন - প্রভৃতি নানান বিষয়ের অবতারণা রয়েছে। এখানে লেখকের বিশেষত্ব এই যে তিনি বিষয় অনুযায়ী ভাষা প্রয়োগ করেছেন। বাস্তব চিত্র , ব্যাঙ্গ , পরিহাস , সাধারণ মানুষের ভাষা , কৃষক সমাজের ভাষা - কোনোরূপ ভাষাকেই কলমবন্দি করতে দ্বিধা বোধ করতেন না। 



রামরাম বসু :-

উইলিয়াম কেরী প্রথম জীবনে রামরাম বসুর কাছে বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এজন্য তাঁকে কেরী সাহেবের মুনসি বলা হয়। রামরাম বসুর উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থ গুলি হলো - '' রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র '' (১৮০১) , ''লিপিমালা'' ( ১৮০২) । দুটি গ্রন্থই লেখকের মৌলিক রচনা। এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে লিপিমালার ভাষা অত্যন্ত সরল এবং ফারসি আতিশয্য বর্জিত। পত্রলিখন পদ্ধতিতে তিনি এই গ্রন্থখানি লিখেছিলেন। 

এছাড়াও আরো বহু পন্ডিতবর্গ যাদের মধ্যে কেউ কেউ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক না হলেও উইলিয়াম কেরির উৎসাহে বাংলা গদ্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পন্ডিতবর্গ ও তাঁদের রচিত সাহিত্যকীর্তিগুলি হলো - তারিণীচরণ মিত্রের ঈশপের গল্পের অনুবাদ ; রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বায়স্য চরিত্ৰং ; চন্ডীচরণ মুনশির তোতা ইতিহাস ; হরপ্রসাদ রায়ের পুরুষপরীক্ষা ; কাশীনাথ তর্কপঞ্চাননের পদার্থ তত্ত্বকৌমুদী ও আত্মতত্ত্বকৌমুদী - ইত্যাদি।  

পরিশেষে বলা যায় ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ চালু থাকলেও ১৮১৫ সালের পর থেকে এর প্রভাব কমে যেতে থাকে। রাজা রামমোহন রায় বাংলা ভাষার উন্নতিকল্পে আত্মনিয়োগ করার কারণে এর প্রভাব খর্বিত হয়। তবুও বলা যেতে পারে প্রথম দেড় দশকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।      
[সমাপ্ত] 

Share
Tweet
Pin
Share