ভারতে নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তনের কারণগুলি আলোচনা কর।

by - May 11, 2022

ভারতে নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তনের কারণগুলি আলোচনা কর। 

ভারতে নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তন - বিষয়টি আলোচনা কর। 

স্বাধীনতার পরবর্তীকালে নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তনের বিষয়টি আলোচনা কর। 




নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তন :- 


ভারতে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হওয়ার পর থেকে বিশেষ করে স্বাধীনতালাভের পর নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সমাজ , রাজনীতি , কর্মক্ষেত্র , অর্থনৈতিক অধিকার , সম্পত্তির উত্তরাধিকার - ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তনের সঙ্গে জড়িত উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল - 


১. বিভিন্ন আইন :- 
ভারতের বিভিন্ন সাংবিধানিক আইন নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তনের বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করে। এই সকল আইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আইন হল - Hindu Marriage Act 1955 , Hindu Succession Act 1956 , Special Marriage Act 1954 , Dowry Prohibition Act 1961 , Equal Remuneration Act 1976  । এইসকল আইনগুলি ভারতে প্রচলিত নারী অধিকারহীনতাকে অস্বীকার করে সর্বক্ষেত্রে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। 

২. সাংবিধানিক ব্যবস্থা :- 
ভারতীয় সংবিধানে কিছু বিশেষ মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এই সকল অধিকার প্রদানের সময় নারী - পুরুষের মধ্যে ভেদ করা হয়নি। এইসকল অধিকারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৪ - ১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকার , ১৯ -২২ নং ধারায় স্বাধীনতার অধিকার , ২৩ - ২৪ নং ধারায় শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার , ২৫ - ২৮ নং ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার , ৩২ ও ২২৬ নং ধারায় সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার - ইত্যাদি। এই সকল অধিকারগুলি নারীদের পুরুষের সঙ্গে সামাজিক অধিকারের দিক দিয়ে এক আসনে প্রতিষ্ঠা করে। 


৩. শিক্ষার প্রসার :- 
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বে হাজার হাজার বছর ধরে ভারতে নারীশিক্ষা ছিল অবহেলিত। কিন্তু স্বাধীনতালাভের পর ভারতে নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতিপূর্বে বিদ্যাসাগর , রামমোহন প্রমুখের প্রচেষ্টায় নারীশিক্ষার বিস্তারের সূচনা হয়। স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন কমিশন ও কিমিটি গঠন করা হলে , প্রতিটি কমিটি ও কমিশন নারীশিক্ষার বিস্তারের প্রতি জোর সওয়াল করে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন , মুদালিয়ার কমিশন , কোঠারি কমিশন , জাতীয় শিক্ষানীতি - সবগুলিতেই নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এরপর সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার , জাতীয় সাক্ষরতা মিশন ও সর্বশিক্ষা অভিযানের মাধ্যমে বালকদের সাথে সাথে বালিকাদের শিক্ষার বিষয়টিকেও সুনিশ্চিত করা হয়। 

৪. অর্থনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত ব্যবস্থা :- 
বিভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও শিক্ষার বিস্তারের মধ্যে দিয়ে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করা হয়। এরপর নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এরমধ্যে দুটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হল - স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা - যার মাধ্যমে প্রায় ১৮ লক্ষ মহিলাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়েছে ও ICDS প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২০ লক্ষ মহিলাকে স্বরোজগারি করে তোলা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন , ফ্যাক্টরি আইন , সমান পারিশ্রমিকের আইন - ইত্যাদি আইনগুলি অর্থনৈতিক নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। 

৫. নারী কল্যানমুলক কর্মসূচি :- 
ভারতের বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি নারী কল্যানমুলক কর্মসূচির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ষষ্ঠ , সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারীদের সামাজিক কল্যাণের জন্য প্রচুর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। নারীদের শিক্ষার বিস্তার , সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা , পারিবারিক দৈহিক ও মানসিক অত্যাচার বন্ধ করা , পুনর্বাসন কেন্দ্র গঠন , বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্র গঠন , শর্ট স্টে হোম - ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নারীদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। 

৬. নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন :- 
ভারতীয় সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনীতে যে পঞ্চায়েত আইন গৃহীত হয় তাতে পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরেই নারীদের জন্য এক - তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়। এছাড়াও পৌরসভা গুলিতেও নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি নারীদের সামাজিক , অর্থনৈতিক - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদার বিবর্তনের বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করে। 


৭. নারীদের স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি :- 
পরিবার কল্যাণ কর্মসূচি , সার্বিক সাক্ষরতা ও রোগ প্রতিষেধক কর্মসূচি - এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে নারীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে তত্ত্বাবধানের জন্য বহুসংখ্যক কর্মী নিয়োগ করা হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া , রোগ সংক্রান্ত তথ্য প্রদান , বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক প্রচার , গর্ভকালীন ও মাতৃত্বকালীন অবস্থায় মা ও শিশুর বিশেষ যত্ন , টীকা ও প্রতিষেধক সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি - ইত্যাদি কর্মসূচির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

৮. কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহন বৃদ্ধি :- 
আধুনিক ভারতে সরকারি ও বেসরকারি উভয়প্রকার কর্মক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। সরকারি আমলাতান্ত্রিক উচ্চপদগুলিতে নারীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমান করছে। শিক্ষা , বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা , শিক্ষার বিস্তার - ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের ফলে সামগ্রিকভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে নারীদের ইতিবাচক মর্যাদাগত বিবর্তন ঘটেছে।  

পরিশেষে বলা যায় , নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তনের বিষয়টি সর্বদা প্রবহমান। রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সামাজিক - সর্বক্ষেত্রেই পুরুষের সাথে নারীদের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আজও চলমান।   

      

You May Also Like

0 comments