উদাহরণসহ ধ্বনি - পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করো।

by - August 18, 2021

উদাহরণসহ ধ্বনি - পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করো। 



বাংলা প্রাণবন্ত চলমান ভাষা । বহু বছরের ধীর ও ধারাবাহিক বিবর্তনে বাংলা ভাষার বর্ণ ও সংযুক্ত বর্ণের মূল ধ্বনির নানা পরিবর্তন ঘটেছে । ধ্বনির পরিবর্তনশীলতা বাংলা ভাষাকে আরো আন্তরিক ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে । 

শ্রেণীবিভাগ—

(১) ধ্বনির আগম বা ধ্বন্যাগম 

(২) ধ্বনির লোপ বা ধ্বন্যালোপ

(৩) ধ্বনির স্থানান্তর

(৪) ধ্বনির রূপান্তর ।


(১) ধ্বনির আগম বা ধ্বন্যাগম -
 উচ্চারণকে সহজ ও সরল করবার জন্য বা উচ্চারণের অক্ষমতার জন্য যখন কোন শব্দের আদিতে, মধ্যে ও অন্তে নতুন কোনো ধ্বনির আগমন ঘটে, তখন সেই জাতীয় ধ্বনি পরিবর্তনকে ধ্বন্যাগম বলে । এই ধ্বন্যাগম দুই প্রকারের যথা (i) স্বরাগম ও (ii) ব্যঞ্জনাগম ।

(i) স্বরাগম:- শব্দের প্রথমে, মধ্যে ও অন্তে যখন কোনো স্বরবর্ণের আগমন ঘটে তখন তাকে স্বরাগম বলে । স্বরাগম তিন প্রকারের—

(ক) আদি স্বরাগম :-  যেমন স্পর্ধা > আস্পর্ধা, স্টেশন > ইস্টিশন, স্টেট > এস্টেট । অর্থাৎ শব্দের প্রথমে আ, ই, এ ধ্বনির আগমন ঘটেছে ।

(খ) মধ্য স্বরাগম :-  শ্লোক > শোলোক,  রত্ন > রতন, প্রীতি > পিরীতি -এখানে শব্দের মধ্যে ও, অ , ই ধ্বনিগুলির আগমন ঘটেছে ।

(গ) অন্ত স্বরাগম :-  বেঞ্চ > বেঞ্চি, সত্য > সত্যি,  ল্যাম্প > ল্যাম্পো প্রভৃতি -এখানে ই, ও অ স্বরধ্বনি গুলো শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ।


(ii) ব্যঞ্জনাগম :-  শব্দ মধ্যে যখন ব্যঞ্জনধ্বনির আগমন ঘটে তখন সেই প্রক্রিয়াকে বলে ব্যঞ্জনাগম । ব্যঞ্জনাগম ও তিন প্রকার — (ক) আদি, (খ) মধ্য ও (গ) অন্ত ব্যঞ্জনাগম ।

(ক) আদি ব্যঞ্জনাগম :- উজু > রুজু , ওঝা > রোজা , এখানে শব্দের আদিতে 'র' এর আগমন ঘটেছে ।

(খ) মধ্য ব্যঞ্জনাগম :- অম্ল > অম্বল, বানর > বান্দর, পোড়ামুখী > পোড়ারমুখী প্রভৃতি । এখানে ব, দ, র ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি শব্দের মধ্যে এসেছে ।

(গ) অন্ত ব্যঞ্জনাগম :-  সীমা > সীমানা , ধনু > ধনুক, নানা > নানান - শব্দের শেষে 'না', 'ক', 'ন' বর্ণের আগমন ঘটে শব্দগুলিকে সরলীকরণ করা হয়েছে ।



(২) ধ্বন্যালোপ :- 
ধ্বনির আগমন ঘটিয়ে যেমন ধ্বনির পরিবর্তন ঘটেছে তেমনি শব্দের আদি, মধ্য ও অন্তে ধ্বনির লোপ ঘটিয়ে শব্দের কাঠিন্য ভেঙে দেওয়া হয়েছে । যুগ্মশব্দ বা বড় বড় শব্দগুলিকে সরলীকরণ করে ছোট করা হয়েছে । ধ্বনিলোপ দুই প্রকারের যথা — (i) স্বরলোপ ও (ii) ব্যঞ্জনলোপ ।  স্বরলোপ আবার তিন প্রকারের যথা — (ক) আদি স্বরলোপ , (খ) মধ্য স্বরলোপ ও (গ) অন্ত স্বরলোপ ।

(ক) আদি স্বরলোপ :-  যেমন অলাবু > লাউ, অভ্যন্তর > ভিতর, উদ্ধার > ধার । এখানে প্রথম ধ্বনিগুলো লোপ পেয়েছে ।

(খ) মধ্য স্বরলোপ :-  যেমন গামোছা > গামছা, ভগিনী > ভগ্নী , জানালা > জানলা । এইসব শব্দের মধ্যস্থিত স্বরধ্বনি গুলির লোপ হয়েছে ।

(গ) অন্ত্য স্বরলোপ :- যেমন আশা > আশ, জলপানি > জলপান, কালি > কাল, ফাঁসি > ফাঁস প্রভৃতি শব্দের অন্ত্যস্থিত স্বরধ্বনিগুলি লোপ পেয়েছে ।

(৩) ধ্বনির স্থানান্তর :- 
শব্দমধ্যস্থ একাধিক স্বরধ্বনি বা ব্যঞ্জনধ্বনি বিভিন্নভাবে স্থান পরিবর্তন করে যখন তখন তাকে বলা হয় ধ্বনির স্থানান্তর । এই স্থানান্তর প্রধানত দুই প্রকার যথা— (ক) অপিনিহিতি ও (খ) ধ্বনি বিপর্যয় বা বিপর্যাস ।

(ক) অপিনিহিতি :- শব্দ মধ্যস্থ ব্যঞ্জনধ্বনির পর যদি ই-কার বা উ-কার থাকে, তবে সেই ই-কার বা উ-কার ঐ ব্যঞ্জনধ্বনির আগে উচ্চারিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে অপিনিহিতি বলে । যেমন —আজি > আইজ, কালি > কাইল, সাধু > সাউধ, আশু >  আউস প্রভৃতি (আ + জ + ই  > আ + ই + জ ) । এছাড়া য-ফলা যুক্ত শব্দ বা 'ক্ষ', 'জ্ঞ' থাকলেও ই-কার আগে উচ্চারিত হয় । বাক্য > বাইক্য, লক্ষ্ > লইক্ষ কন্যা > কিইন্যা প্রভৃতি । অপিনিহিতি বাংলার বঙালী উপভাষায় প্রচলিত বৈশিষ্ট্য । এই বঙালী উপভাষা বাংলাদেশে প্রচলিত হয় বেশি ।

(খ) ধ্বনি বিপর্যয় বা বিপর্যাস :- উচ্চারণের সময় অসাবধানতাবশত বা অক্ষমতার কারণে শব্দ মধ্যস্থ সংযুক্ত বা পাশাপাশি দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির স্থান পরিবর্তন করার ঘটনাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলে । যেমন বাক্স > বাস্ক, পিশাচ > পিচাস, বাতাসা > বাসাতা, তলোয়ার > তরোয়াল, দহ > হ্রদ, রিকশা > রিশকা প্রভৃতি ।

(৪) ধ্বনির রূপান্তর:- 
শব্দ মধ্যস্থ একটি স্বরধ্বনি বা ব্যঞ্জনধ্বনি রূপান্তরিত হয়ে যথাক্রমে অন্য কোনো স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনিতে রূপান্তরিত হয় তখন তাকে ধ্বনির রূপান্তর বলে । রূপান্তর তিন প্রকার যথা—(ক) স্বর সংগতি , (খ) অভিশ্রুতি ও (গ) সমীভবন বা ব্যঞ্জন সংগতি ।

(ক) স্বরসংগতি :- শব্দের মধ্যে পাশাপাশি বা প্রায় কাছাকাছি অবস্থিত দুটি পৃথক স্বরধ্বনির মধ্যে যদি একটি অন্যটির প্রভাবে বা দুটিই পরস্পরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে একই রকম স্বরধ্বনিতে বা প্রায় একই রকম ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে স্বরসংগতি বলে । স্বরসংগতি তিন রকমের, যথা — (i) প্রগত স্বরসংগতি , (ii) পরাগত স্বরসংগতি ও (iii) অন্যোন্য বা পারস্পরিক স্বরসংগতি ।

(খ) অভিশ্রুতি :- অভিশ্রুতি হল অপিনিহিতির পরবর্তী ধাপ । পশ্চিমবঙ্গের চলিত বাংলা ভাষায় এর প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি । অপিনিহিতি, স্বরসংগতি ও স্বরলোপ জনিত অনেকগুলি পরিবর্তনের পরিণাম হল অভিশ্রুতি । অর্থাৎ অপিনিহিতি সৃষ্ট কোনো শব্দ যখন ধ্বনিলোপ, স্বরসংগতি প্রভৃতি একাধিক ধ্বনি পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ফলে মান্য চলিত ভাষায় ব্যবহারের উপযোগী সংক্ষিপ্ত রূপ লাভ করে, তখন সেই সম্মিলিত ধ্বনি পরিবর্তন কে বলে অভিশ্রুতি । যেমন— রাখিয়া > রাইখিয়া (অপিনিহিতি), রাইখিয়া > রাইখিয়ে (স্বরসংগতি). রাইখিয়ে > রেখে (অভিশ্রুতি) । পটুয়া > পউটা > পোটো, কন্যা > কইন্যা > কনে , বেদিয়া > বাইদ্যা > বেদে , কলিকাতা > কইলকাতা > কোলকাতা প্রভৃতি ।

(গ) সমীভবন বা সমীকরণ বা ব্যঞ্জন সংগতি:-  শব্দমধ্যস্থ্য বা পাশাপাশি অবস্থিত দুটি পৃথক পৃথক ব্যঞ্জন উচ্চারণের সময়ে যখন একে অন্যের প্রভাবে বা উভয়ে উভয়ের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে দুটি একই ব্যঞ্জনে বা প্রায় সমব্যঞ্জনে পরিণত হয় তখন সেই প্রক্রিয়াকে বলা হয় সমীভবন বা ব্যঞ্জন সংগতি । ব্যঞ্জন সংগতি ও তিন প্রকারের, যথা—(i) প্রগত ব্যঞ্জনসংগতি, (ii) পরাগত ব্যঞ্জনসংগতি ও (iii) অন্যোন্য সমীভবন ।



You May Also Like

0 comments