Pages

Powered by Blogger.
1ST SEMESTER SUGGESTION 2 ND YEAR SUGGESTION 2ND SEMESTER 3RD SEMESTER BENGALI NOTES CU suggestion. EDUCATION NOTES ENGLISH COMPULSORY GBU Suggestion. HISTORY EUROPE & WORLD HISTORY NOTES POL SC NOTES SOCIOLOGY NOTES WBCS 2020

NANDAN DUTTA

A new approach for exam notes .

CBCS 3RD SEMESTER BENGALI 
চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ - সুবোধ ঘোষ।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 

আমাদের ক্লাসটা ছিল একটি নৃতত্বের ল্যাবরেটরির মতো। এমন বিচিত্র মানবতার নমুনা আর কোন্ স্কুলে কোন্‌  ক্লাসে আছে জানি না। তিনটি রাজার ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে। একজন জংলি রাজার ছেলে, কুচকুচে কালো চেহারা। আর দুজন ছিল সত্যিকারের ক্ষত্রিয়াত্মজ – সুগৌর গায়ের রং, পাগড়িতে সাঁচ্চা মোতির ঝালর ঝুলতো। তা ছাড়া ছিল – সিরিল টিগ্‌গা, ইমানুয়েল খাল্‌খো, জন বেস্‌রা, রিচার্ড টুডু আর স্টিফান হোরো এবং আরো অনেক। এত ওরাওঁ আর মুন্ডা সন্তানের সমাবেশের মাঝখানে তবু আমরা কজন ইন্টার ক্লাস পরিবারের বাঙালি ও বিহারি ছেলে শুধু বুদ্ধির জোরে সর্বকর্মের মোড়লির গৌরব অধিকার করে বসেছিলাম। রাজার ছেলেগুলাকে আমরা বলতাম সোনা ব্যাঙ, আর মুন্ডা ও ওরাওঁদের বলতাম কোলা ব্যাঙ। ওদের কাউকে আমরা কোনো দিন গ্রাহ্যের মধ্যে আনতাম না। রাজার ছেলেগুলি অবশ্য আমাদের সঙ্গে কথা বলত না। অপরপক্ষে টিগ্‌গা, খালখো, বেসরা, টুডু – ওরা আমাদের সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারলে ধন্য হয়ে যেত। টিফিনের সময় একটা আনি নিয়ে টুডুকে দিতাম। বলতাম – টুডু, চট করে এক দৌড়ে এই এক আনার ঝালবাদাম নিয়ে এসো তো। গঙ্গা সাহুর দোকান থেকে আনবে।

স্কুল থেকে গঙ্গা সাহুর দোকান দেড় মাইল হবে। কৃতার্থভাবে আনিটা হাতে তুলে নিয়ে টুডু সেই প্রচন্ড রোদে ঝলসানো মাঠের ওপর দিয়ে পোড়া হরিণের মতো উদ্দাম বেগে দৌড়ে চলে যেত গঙ্গা সাহুর দোকানে। ফিরে এসে ঝালবাদামের ঠোঙাটা আমাদের হাতে সঁপে দিয়ে নিজে দূরে সরে যেত। আমরা বলতাম – কী আশ্চর্য টুডু, এতটা পথ দৌড়ে এলে তবু তুমি একটুও হাঁপাচ্ছো না।

এই ফাঁকা কথার কারসাজিটাকে আন্তরিক অভিনন্দন মনে করেই টুডু দূরে দাঁড়িয়ে গর্বভরে হাসত ! আমরা চোখ টিপে লক্ষ করতাম – টুডু কেমন জোর করে তার পরিশ্রান্ত শ্বাসবায়ুটাকে ঢোঁক গিলে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তাকে ঝালবাদামের একটু শেয়ার দিতে আমরা বোধ হয় ইচ্ছে করেই ভুলে যেতাম। দিতে গেলেও টুডু নিত না।

আমরা দেখতাম, একটু দূরে দাঁড়িয়ে সুতীব্র একটা দৃষ্টি দিয়ে স্টিফান হোরো আমাদের হাবভাব লক্ষ করছে। আমরা ঘাবড়ে যেতাম। স্টিফান যেন তির মেরে আমাদের বুকের ভেতরে ধূর্ত রসিকতায় তৈরি ফুসফুসটাকে খোঁচা মেরে দেখছে। সব বুঝে ফেলতে পারছে। কিন্তু সবার মধ্যে একমাত্র স্টিফানই পারে, আর কেউ নয়?

টুডু, খাল্‌খো, টিগ্‌গা, বেসরা সকলেই কতকটা এই রকমেরই বাধ্য বেকুব বিশ্বাসী আর নিরীহ ছিল। আমরা মনে মনে হাসতাম। – হায়রে, রাঁচির জঙ্গলের যত কোল, যত সব কোলা ব্যাঙ !

ওদের মধ্যে ওই একটিমাত্র কাল কেউটে ছিল, স্টিফান হোরো। বড়ো উদ্ধত ছিল স্টিফানের স্বভাবটা। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, হোরোর কাছে আমাদের আভিজাত্য চুপে চুপে হার মেনে নিত। ওর সঙ্গে সদ্ভাব রাখার জন্য মাঝে মাঝে যেচে ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। আরও লজ্জার বিষয় হোরো এক সময় আমাদের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত। ওই মাথা ঠাসা মোটা মোটা চুলের ঘুঙর, চ্যাপটা নাক, আবলুস কালো চেহারা – তবু এত অহঙ্কার !

স্টিফানের ওপর প্রথম একটু ভয় ও শ্রদ্ধা হল একটা ঘটনায়। সেদিন খেলার মাঠে দেখলাম – হোরো হকি স্টিক আনেনি। হোরো তবু খেলতে চায়। কিন্তু নিজের হকি স্টিক নিয়ে খেলতে হবে – এই ছিল আমাদের নিয়ম। হোরো বার বার আমাদের অনুরোধ করল – কিছুক্ষনের জন্য কেউ আমাকে একটা স্টিক ধার দাও, এক হাত খেলেই আবার দিয়ে দেব।

কেউ কারও স্টিক পরের হাতে দিতে রাজি ছিল না। হোরো বললো – আমি বিনা স্টিকেই খেলবো।

গোঁয়ার হোরো একটি ঘণ্টা আমাদের উদ্দাম হকি স্টিকের বাড়ি আর আছাড়ের সঙ্গে সমান স্বাচ্ছন্দ্যে পা দিয়ে খেলে গেল। হোরোর দুটি নিরেট শিশু কাঠের মতো পায়ের ওপর বেপরোয়া হকি স্টিক চালাবার সময় এক একবার সন্দেহে আমাদের হাত কেঁপে উঠেছে – স্টিকটাই ভেঙে না যায়।

স্টিফান হোরো ক্রমেই আমাদের ভাবিয়ে তুলছিল। শুধু ভয় আর শ্রদ্ধা নয় – আর একটা কারণে আমরা হোরোকে একবার ঈর্ষা করতে আরম্ভ করলাম। লেখা পড়ার ব্যাপারে হোরো আমাদের মনের শান্তি নষ্ট করতে চলেছে। ইংরাজি কবিতার আবৃত্তি ও ব্যাখ্যায় সে আমাদের ইন্দুকেও পরাজিত করে ছাব্বিশ নম্বর বেশি পেল। ঘটনাটা জাতীয় অপমানের মতো আমাদের গায়ে বিঁধল। বেহারি ছাত্রদের জাতীয়তা কতটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল জানি না, কিন্তু হোরোর সম্পর্কে একটা নিন্দার ষড়যন্ত্রে তারাও আমাদের সঙ্গে ইউনাইটেড ফ্রন্ট করল। আমরা বেশ জোর গলায় রটিয়ে দিলাম – এ স্কুলে অখ্রিস্টানদের ওপর বড়ো অবিচার চলছে। মাস্টারেরা সবাই খ্রিস্টান। সুতরাং খ্রিস্টান হোরো বেশি নম্বর পাবে তাতে আর আশ্চর্য কি ? কিন্তু কী ভয়ানক অন্যায় !

আমাদের অভিযোগকে মনে প্রাণে সত্য বলে বুঝলেন শুধু একমাত্র অখ্রিস্টান শিক্ষক। সংস্কৃতের মাস্টার বৈজনাথ শর্মা- পন্ডিতজি।

পন্ডিতজি আমাদের সান্ত্বনা দিলেন। কী আর করবে বাবা! পাদরিদের দের স্কুলে এইরকমই অন্যায় কান্ড হয়ে থাকে। যাক, ইউনিভার্সিটি তো আছে। সেইখানে ধরা পড়ে যাবে কার কতখানি যোগ্যতা।

প্রমোশনের পর নতুন বছরে স্টিফান হোরো আরও ভয়ানক এক গোঁয়ার্তুমি করে বসলো- পা দিয়ে হকি খেলার চেয়েও ভয়ানক। স্টিফান হোরো তার অ্যাডিশানাল ইংরাজি ছেড়ে দিয়ে সংস্কৃত নিল। খ্রিষ্টান টিচারেরা সবাই হোরোকে ধমকালেন, হেডমাস্টার ফাদার লিন্ডন ক্ষুন্ন হলেন, পন্ডিতজি অদ্ভুতভাবে হাসতে লাগলেন। তবু অনার্য হোরোর সংস্কৃত পড়ার প্রতিজ্ঞা তিলমাত্র বিচলিত হল না।

পন্ডিতজি আমাদের আড়ালে ডেকে নিয়ে একটা অস্বস্তির হাসি হেসে বললেন – স্টিফান হোরো সংস্কৃত নিয়েছে। আর কি ? এইবার দেবভাষার কপালে কী আছে কে জানে।

পন্ডিতজি হাসতে লাগলেন। আমাদের কেমন সন্দেহ হল। – পন্ডিতজিকে যেন খুশি খুশি দেখাচ্ছে ! যাক।

শীঘ্রই আমাদের যত ধারণা সংশয় আক্রোশ ও আশঙ্কা পর পর কতগুলি ঘটনায় আরও জটিল হয়ে উঠতে লাগল।

নিউ টেস্টামেন্ট থেকে ডেভিডের গাথাগুলি আগাগোড়া নির্ভুল আবৃত্তি করে ফার্স্ট প্রাইজ পেল স্টিফান হোরো। সেকেন্ড, থার্ড, ও ফোর্থ প্রাইজের অগৌরবে মুখ শুকনো করে আমরা বসে রইলাম। ফাদার লিন্ডন উচ্ছ্বসিত আনন্দে হোরোর প্রশংসা করে ঘোষণা করলেন – ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তোমায় নিশ্চয় দারোগা করে দেবো হোরো, আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম।

তা করতে পারেন ফাদার লিন্ডন। এতটুকু সুপারিশ করার ক্ষমতা তাঁর আছে, কিন্তু ওইটুকু যদি স্টিফেন হোরোর জীবনের পরমার্থ হয়, হোক, তার জন্য আমরা মোটেই হিংসা করি না। তার জন্য এত কষ্ট করে নিউ টেস্টামেন্ট মুখস্থ করার দরকার নেই আমাদের।

তার পরের দিনই বাইবেল ক্লাসে হোরোকে একেবারে ভিন্ন রূপে দেখতে পেলাম আমরা। দুর্বোধ্য বিস্ময়ে আমরা শুধু খাবি খেতে লাগলাম।

বাইবেল ক্লাসের একেবারে পেছনের বেঞ্চিতে বসেছিল হোরো। পড়াতে পড়াতে ফাদার লিন্ডন বার বার পুলকিত নেত্রে হোরোকে প্রশ্ন করছিলেন – স্টিফান তুমিই উত্তর দাও। তুমিই সবচেয়ে ভালো উত্তর দিতে পারবে।

– জানি না স্যর। স্টিফানের রুক্ষ গলার স্বরে চমকে উঠে আমরা সবাই তার দিকে তাকালাম। দেখলাম, স্টিফান হোরোর আরও রুক্ষ ও বিরক্ত মুখটা ডেস্কের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। ফাদার লিন্ডনের দিকে যেন তাকাতে চায় না হোরো।

ফাদার লিন্ডনের সোনালি দাড়ির ওপর লালচে মুখে ক্ষণে ক্ষণে গাঢ় রক্তচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ছিল। চোখের দৃষ্টিটা তীব্র হয়ে উঠছিল। স্টিফানের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট স্বরে বললেন – স্টিফান, আজ কি তোমার ব্রেনটাকে দরজার বাইরে রেখে ক্লাসে এসেছে তুমি ? উত্তর দিতে পারছ না কেন ?

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 

জানি না স্যর। আবার স্টিফান হোরোর সেই স্পষ্ট অবিচল ও অকুতোভয় উত্তর শুনে আমাদের বুকে দূর দূর শুরু হয়ে গেল। আকস্মিকভাবে অসময়ে ক্লাস বন্ধ করে ফাদার লিন্ডন চলে গেলেন।

কিন্তু স্টিফান হোরোর এত রাগ কেন ? এত অভিমান কেন ? নিউ টেস্টামেন্ট মুখস্থ করে কার মাথা কিনেছে ? কি হতে চায় ? হাউস অব লর্ডস্‌ – এর সদস্য ?

এর পর বিপদে পড়লেন পন্ডিতজি। পন্ডিতজির মতি-গতিও কদিন থেকে কেমন একটু বিসদৃশ দেখাচ্ছে। আমাদের এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন পন্ডিতজি একটু সুস্থ বোধ করেন। দেখা হলেই ব্যস্ত হয়ে সরে পড়েন।  অথচ পন্ডিতজিকে কত কথাই না জিজ্ঞাসা করার আছে। ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। এই তো যত নম্বর প্রমোশন আর পজিশন নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা গবেষণা ও কৌতূহলের সময়। পন্ডিতজির উদার হাতের নম্বর অনেক সময় আমাদের টোটালকে পরিস্ফীত করে কৃপণ খ্রিস্টান শিক্ষকদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। আজও আমরা তাই জানতে চাই – পন্ডিতজি কার জন্যে কতদূর করলেন। ইন্দুকে যদি একবার বুক ঠুকে পঁচাশি দিয়ে দেন তবে টোটালে তার ফার্স্ট হওয়া সম্বন্ধে আর কোনো সংশয় থাকে না। সব খ্রিস্টানি ষড়যন্ত্র জব্দ হয়ে যায়।

পন্ডিতজির বাড়িতে গিয়েছি, লাইব্রেরি ঘরে একা একা পেয়েছি, পথে পথরোধ করেছি – কিন্তু পন্ডিতজি কিরকম গোলমেলে কথা বলে সব কৌতূহল যেন চাপা দিতে চান। আমাদের সন্দেহ আরও প্রখর হয়ে ওঠে।

আম্‌তা আম্‌তা করে দুবার মাথা চুলকিয়ে পন্ডিতজি সত্য সংবাদটা ব্যক্ত করে দিলেন। সংস্কৃতে স্টিফান হোরো সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, একশোর মধ্যে পঁচাত্তর।

আর ইন্দু ? আমাদের প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পন্ডিতজি অপরাধীর মতো বললেন – বত্রিশ।

মাত্র বত্রিশ ! পন্ডিতজির মতো বিশ্বাসহন্তা পৃথিবীতে আর নেই। আমাদের ক্ষোভ অসংযত হয়ে উঠেছিল। পন্ডিতজি মিনতি করে বললেন – স্টিফান হোরো এত ভালো সংস্কৃত লিখেছে, এ – তো তোমাদেরই গৌরব, আর্যভাষার গৌরব। এতে তো তোমাদের খুশি হবার কথা। এটা হোরোর জয় নয়, এটা হল সংস্কৃত ভাষার জয়।

চুলোয় যাক সংস্কৃত ভাষার জয়। ইন্দু ফার্স্ট হতে পারবে না, এটা যে আর্যত্বের কত বড়ো পরাভব, বাঙালির কত বড়ো অপমান – তা পন্ডিতজি বুঝলেন না। কিন্তু আমরা ঠিক রহস্যটি বুঝে ফেললাম – পন্ডিতজি হলেন বেহারি, তাই।

কিন্তু বাতাসের নিশ্চয় সেই পরম গুণ আছে, যার জন্য শত অন্যায়ের অবরোধের মধ্যেও ধর্মের কল নড়ে ওঠে। লাইব্রেরি ঘরে যেদিন বোর্ড নিবদ্ধ মার্কশিটের কাছে আমরা গিয়ে চোখ তুলে দাঁড়ালাম, সেদিন আমরা বিশ্বাস করলাম সত্যের জয় আছে, মিথ্যার পরাজয় আছে।

ইন্দুই ফার্স্ট হয়েছে। স্টিফান হোরো অনেক নীচে। ইংলিশে, ইতিহাসে, ভূগোলে, অঙ্কে- সব বিষয়ে অতি নগণ্য নম্বর পেয়েছে স্টিফান হোরো, একমাত্র সংস্কৃত ছাড়া। ভেবে অবাক হলাম আমরা, খ্রিস্টান টিচারেরা হোরোর ওপর হঠাৎ এত নির্দয় হয়ে উঠলেন কেন?

আরও কিছুদিন পর স্টিফান হোরো আমদের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য হয়ে গলে। শুধু আমাদের কাছে নয়, খালখো, বেস্‌রা, টিগ্‌গা সবাই বলাবলি করে- কী জানি হয়েছে হোরোর!

বড়দিনের উৎসবে আমরাও পিকনিক করতে গিয়েছিলাম শিলোয়ারার জঙ্গলে। রান্নার কাঠের জন্য মহা উৎসাহে একটা মরা কেঁদ গাছ ভাংছিলাম আমরা। হঠাৎ দেখলাম, স্রোতের ধার দিয়ে একা একা হোরো চলেছে। হাতে একটা গুলতি। আমরা চেঁচিয়ে ডাকলাম হোরোকে। এ রকম অভাবিত ভাবে হোরো যখন এসেই পড়েছে, তখন সেও আমাদের সঙ্গে এই বনভজনের আনন্দের একটু শেয়ার নিক না কেন। পোলাও হবে, মাংস হবে, দই আছে, বৈকুন্ঠ ময়রার সন্দেশ আছে। খেয়ে খুশি হবে হোরো। একেবারে আনকোরা মুন্ডা, জীবনে বোধ হয় এসব খায়নি কখনও।

হোরো এগিয়ে এল। আমাদের কাছে এসেই একটা শাল গাছের শাখার দিকে নিবিস্ট ভাবে তাকিয়ে রইল। তার পরেই শিকার লক্ষ করে গুলতি তুলে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে একটা হৃষ্টপুষ্ট কাঠবিড়ালি আহত হয়ে ধপ করে মাটির উপরে পড়ল। একটা লাফ দিয়ে আহত কাঠবিড়ালিটিকে লুফে নিয়ে পকেটের ভিতর রাখলো স্টিফান।

আমরা আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলাম- ওটা কী হবে স্টিফান।

-খাব। নিঃসংকোচে কথাটা বলে ফেলল হোরো। মনের ঘেন্না চেপে রেখে তবু আমরা হোরোকে নিমন্ত্রণ করলাম। ওসব ছুড়ে ফেলে দাও স্টিফান। পাগল কোথাকার। এসো আমাদের পিকনিকে তুমিও খাবে আমাদের সঙ্গে।

না। হোরোর কালো মুখের ভিতর থেকে ঝক্‌ঝকে্‌ দুপাটি সাদা দাঁতের হাসি আপত্তি জানাল।

এ রকম জংলি হয়ে যাচ্ছে কেন স্টিফান? রিচার্ড টুডু একদিন কানে কানে আমাদের বলল, – সত্যি কি জানি হয়েছে হোরোর। বোধহয় শীগগির পাগল হয়ে যাবে। ফাদার লিন্ডন আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, হোরোর সঙ্গে যেন কেউ না মেশে।

আমরা জিজ্ঞাসা করলাম।– কেন টুডু।

টুডু- একজন বুড়ো সোখার সঙ্গে আজকাল বড়ো ভাব হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিন মঙ্গলবারের হাটে গিয়ে সোখার সঙ্গে দেখা করে হোরো।

তাতে কী এমন অপরাধ করেছে হোরো?

টুডু ভুরু কুচকে বলল- অপরাধ নয়? এতে বাইবেলের অপমান করেছে হোরো। চার্চে যায় না। কারও কথা শোনেনা। তিন দিন বোর্ডিংয়ে ছিল না। ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে

বোর্ডিংয়ে ছিল না? কোথায় ছিল?

টুডু গলার স্বর আরও নামিয়ে চুপে চুপে বলল- বুরুতে গিয়েছিল। সেখানে নেচে গেয়ে এসেছে। পেট ভরে ইলি খেয়ে নেশা করেছে। তা ছাড়া…।

টুডু হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল। একটা কথা বলছি, কাউকে বলো না যেন। জানতে পারলে হোরো আমায় মেরে ফেলবে।

টুডুকে অভয় দিলাম।– না, কেউ জানতে পাবে না, তুমি বলো।

টুডু- একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়েছে। মেয়েটার নাম চির্‌কি, মোরাঙ্গি পাহাড়ের মুরমুদের মেয়ে।

টুডুর কথা গুলো মুগ্ধ হয়ে যেন গিলছিলাম আমরা। আমাদেরই সহপাঠী- দীন দরিদ্র মুন্ডা হোরো, কতই বা বয়স,তবু সেই হোরো আজ আমাদের এক মুহুর্তে বাইবেল ক্লাস, সংস্কৃতের নম্বর আর হকি খেলার সব আনন্দ উত্তেজনাকে মুল্যহীন করে দিয়ে, এক রোমাঞ্চময় অনুরাগের স্কুলে গিয়ে সবার অগোচরে নাম লিখিয়ে এসেছে। সেই মেয়েটি, চির্‌কি মুরমু তার নাম, তাকে যেন আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি। শাল ফুলের মালা গলায় দিয়ে, খোঁপায় একটা বনজবা গুঁজে, স্রোতের ভাষার মতো খলখল হাসির বন্ধনে হোরোর কালো হৃদয়ের সব দুরন্তপনাকে বন্দি করে কোন উপত্যকার একটি নিভৃতে নিয়ে চলে গেছে। সেখান থেকে ফিরে আসার সাধ্য নেই হোরোর। কোন্‌ সাধেই বা আসবে?

টুডু তখনও সেই রকম পাকা পাকা কথা বলে চলেছিল।– মুরমুরা বোঙা পুজো করে, ওদের সঙ্গে মেলামেশা কি উচিত হল? বড়ো ভুল করেছে হোরো।

স্টিফান হোরোকে বর্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, এটা শুধু একটা গুজব হয়ে রইল। কার্যত দেখলাম, হোরোকে তাড়ানো হলো না। নিজের ইচ্ছা মতো ক্লাসে আসে হোরো। নিজের ইচ্ছা মতোই অনুপস্থিত হয়। অনুগত খ্রিস্টান ছাত্রেরা হোরোকে এড়িয়ে যায়। হোরো যেন এক ঘরের মধ্যেই একঘরে হয়ে আছে।

রিচার্ড টুডু যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, কাজের বেলায় দেখলাম তার উল্টোটাই হয়েছে। হোরোকে বোর্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। সে বোর্ডিংয়েই আছে, অথচ তার সম্পর্কে যেন সব শাসন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

আমরা দেখে অবাক হয়ে যেতাম, এক একদিন বিকেলে ফাদার লিন্ডন টেনিস খেলছেন হোরোর সঙ্গে। আশ্চর্য! টুডু বেস্‌রা টিগ্‌গা- এরা হোরোর চেয়ে কম কালো আর বেশি বিশ্বাসী খ্রিস্টান। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওরা শুধু ফাদার লিন্ডনের টেনিস খেলার সময় বল কুড়িয়ে দেবার মর্যাদা পেয়েছে। তার বেশী নয়। আর স্টিফান একেবারে… সত্যি আশ্চর্য।

বোর্ডিংয়ের বাগানে বিকালবেলা জল দেবার ভার ছিল হোরোর উপর। এই কর্তব্যটুকুর বিনিময়ে হোরো বোর্ডিংয়ে ফ্রি খেতে পেত আর থাকত। আমরা দেখলাম হোরো বাগানে যায় না, জল তোলে না। উদ্যানসেবার ভার টিগ্‌গার ওপর চাপানো হয়েছে। বেচারি টিগ্‌গা! সকালবেলার রান্নার জন্য কাঠ কাটে, তার ওপর আবার বিকেলবেলা জল তোলা!

টুডু এসেই আর একদিন একটা খবর দিল- আজকাল আর হাটে যাবার সুযোগ পায় না স্টিফান, প্রতি মঙ্গলবার ফাদার লিন্ডনের ঘরে বসে পিলগ্রিম্‌স প্রগ্রেস পড়ে। পড়া শেষ হলে নাকি চা-বিস্কুট খায় হোরো। ফাদার লিন্ডন খাওয়ান।

আমাদের উৎসাহ ঔৎসুক্য আলোচনা আর গবেষণার সীমা ছিল না। অলক্ষ্যে কত বড়ো একটা ঘটনার দ্বন্দ্ব জমে উঠেছে, তার কিছু কিছু আভাস আমরা আমাদের অনুভব দিয়ে ধরতে পারছিলাম। এক দিকে কেম্ব্রিজের এম.এ. বিখ্যাত শিক্ষিত সুসভ্য ও শ্রদ্ধেয় ফাদার লিন্ডন।… অপর দিকে কোন এক জংলি মুন্ডা ডিহির বুড়ো সোখা দীনতম নগণ্য অর্ধোলঙ্গ বর্বরবেশী এক যাদুমন্ত্রী। যেন দুই যুগে লড়াই- বিংশ শতক বনাম প্রাক্‌ ইতিহাস। বুড়ো সোখা বোধ হয় সে লাঞ্ছনা ভুলতে পারে না- ছেলেধরা পাদরিরা তাদের ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, খ্রিস্টান করে দিয়েছে হোরোকে। তারই প্রতিশোধ নেবে বুড়ো সোখা। এই সুসভ্য ডাইনদের দূর্গ থেকে আবার জঙ্গলের ছেলেকে আবার জঙ্গলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

ফাদার লিন্ডন তাই বোধহয় সতর্ক হয়েছেন। স্টিফান হোরো যদি আবার জংলি হয়ে যায়, সে পরাজয় আর অপমান বড়ো বেশী করে বুকে বাজবে। সহ্য করা কঠিন হবে। লিন্ডন জানেন প্রতি মঙ্গলবারের হাটে বুড়ো সোখা আসে। একটা আরন্য-আত্মা প্রতিশোধ নেবার জন্য আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুযোগ খুঁজছে। চা-বিস্কুট-টেনিস সুসভ্যতার এক একটি প্রসাদ খাইয়ে হোরোকে যেন পোষ মানিয়ে রাখতে চাইছিলেন ফাদার লিন্ডন।

আমরা বলতাম- চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ। দেখা যাক, কে জেতে, কে হারে।

গুড ফ্রাইডে ছুটিতে সবাই দেশে যাবার ছুটি পেল। টুডু টিগ্‌গা বেস্‌রা খালকো সবাই চলে গেল। ওদের পক্ষে যাওয়ার কোনো বাধা ছিল না। কাঁধের লাঠিতে এক একটা পোঁটলা ঝুলিয়ে জঙ্গলের পথে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল একটানা হেঁটে ওরা চলে যাবে নিজের নিজের ডিহিতে। কোনো পাথেয় দরকার হয়না। ততখানি পয়সা খরচ করার সামর্থ্যও নেই ওদের।

কিন্তু হোরোকে ছুটি দিতে রীতিমতো বিচলিত হয়ে পড়লেন ফাদার লিন্ডন। হোরো যেদিন গেল, সার্ভিস বাসটা এসে দাঁড়াল বোর্ডিংয়ের কাছে। আমরা দেখলাম, ফাদার লিন্ডন ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা বের করছেন, বাসের টিকিট কিনে দিচ্ছেন হোরোকে।

আমাদের মধ্যে বাজি ধরা হল- হোরো আর ফিরে আসবে কিনা। ইন্দু বলল- নিশ্চয়ই আসবে। ফাদার লিন্ডন ওর জংলিপানা ঘুচিয়ে দিয়েছেন। দুবেলা চা-বিস্কুট মারছে আজকাল। তার আস্বাদ কী ভুলতে পারবে হোরো!

আমি বললাম- আর ফিরে আসবে না হোরো। এখানে না হয় চা-বিস্কুট আছে, কিন্তু ওদিকে যে…।

ইন্দু- ওদিকে কি?

বললাম- চির্‌কি মুরমুকে ভুলে গেলে?

ইন্দু একটু নিরাশ হয়ে পড়ল।– তাই তো!

ছুটি ফুরিয়ে গেলে আবার বোর্ডিংয়ের জীবন চঞ্চল হয়ে উঠল। সবাই এসেছে। স্টিফান হোরো ফিরে এসেছে। ইন্দুর জিত হল। আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। রাগ হলো হোরোর ওপর। হোরোটা সত্যিই একটা গবেট ও বেরসিক।

কিন্তু টুডুর কাছে গল্প শুনে আমাদের এই আক্ষেপ মুহূর্তে মুছে গেল। আমরা শুনলাম বুড়ো সোখার কথা, হোরোর কথা, চির্‌কি মুরমুর কথা।হোরোদের জঙ্গলের ছবিটা মুহূর্তের মধ্যে যেন দূরের ফোটা পলাশের আলেয়ার মতো আমাদের কল্পনার সীমার পায়ে দুলতে শুরু করে দিল। ইন্দু বলল- চতুর্থ পানিপথের  যুদ্ধে  বুড়ো সোখার জয় অবধারিত।

হোরোর পাশের ডিহির ছেলে টুডু। খ্রিস্টান টুডুরা অখ্রিস্টানদের সঙ্গে মেশে না। টুডু তবু যেন গোয়েন্দাদের মতো হোরোর সব কীর্তি দেখে এসেছে। তবু টডু প্রান থাকতে ফাদার লিন্ডনের কানে এসব কথা কখনও তুলবে না। হোরোর ওপর প্রচন্ড একটা শ্রদ্ধা ও মমতা আছে টুডুর। হোরোর কাছে গিয়ে কিছু বলতে পারে না বলেই আমাদের কাছে বলে। বলে বলে যেন শ্রদ্ধার বেদনা খানিকটা হালকা করে নেয়।

টুডু দেখেছে- একদিন তির দিয়ে একটা হরিণ মেরেছিল হোরো। স্রোতের ধারে হোরো দাঁড়িয়ে ছিল ধনুক হাতে। চির্‌কি মুর্‌মু তার পা ধুইয়ে দিচ্ছিল।

টুডু দেখছে- চির্‌কি তাদের গাঁয়ের ঘুমঘর থেকে জ্যোৎস্নারাতে চুপে চুপে পালিয়ে এসেছে। হোরো আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চির্‌কিকে হাতে ধরে নিয়ে গেছে।

টুডু দেখছে- হোরো খ্রিস্টান হয়েও আখারাতে গিয়ে মাদল বাজিয়েছে। চির্‌কিও নাচে কিনা সেখানে। বুড়ো সোখা ভালোবেসে হোরোকে। কেউ তাই হোরোকে ঘৃণা করে না।

টুডু বলল- জংলিদের সঙ্গে মিশে দুদিন সেন্ডেরা করেছে হোরো। টাঙি উৎসবে পাগলের মতো নেচেছে। শিমূল গাছে আগুন ধরিয়েছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে। সবার আগে এক লাফ দিয়ে এক কোপে জ্বলন্ত গাছ কেটেছে হেরো।

টুডু গলার স্বর খুব অস্পষ্ট করে ভয়ে ভয়ে বলল- আমি দেখেছি, তার পর গায়ের ফোস্কাতে  ঠান্ডা বাতাস লাগবার জন্য আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে হোরো! চির্‌কি মুরমু আস্তে আস্তে এসে হোরোকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 

বোর্ডিংয়ের পাশে ছোটো  মাঠের ঘাসের উপর সন্ধ্যার অন্ধকারে বসে আমরা টুডুর গল্প শুনছিলাম। হঠাৎ বোর্ডিংয়ের বারান্দা থেকে একটা বাঁশির স্বর ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে তারই সঙ্গে মিলিয়ে, তালে তালে মাথা দুলিয়ে, টুডু গুনগুন করে গাইতে লাগল।–

রাতা মাতা বির্‌কো তালা

রে নালো হোম নির জা

রাগা ইংগা

উৎফুল্ল টুডুর হাবভাব আর উৎসাহ দেখে মনে হল, এখনি সে নাচতে শুরু করে দেবে।

-কে বাজাচ্ছে বাঁশি। কে?

আমাদের ব্যস্ত জিজ্ঞাসার উত্তরে টুডু গান থামিয়ে বলল- ওই, সেই গান। হোরো সেই সুরটা বাজাচ্ছে।

-কোন গান?

-চির্‌কি মুরমুর গান।

-গানটার মানে কী টুডু?

টুডু উত্তর দিল- গানটার অর্থ, শোনো আমার জোয়ান বন্ধু, পালিয়ে যেওনা, এই ঘন জঙ্গলে  আমায় একা ফেলে চলে যেও না।

একটা পুলকের সঞ্চার আমাদের মনের অগোচরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। বললাম- এ যে আমাদেরই মতো গান টুডু!

ইন্দু চাপা সুরে আবৃত্তি করল।– শুন শুন হে পরাণ পিয়া…।

কিছুক্ষন আবিষ্টের মতো নিঝুম হয়ে বসেছিলাম আমরা। বোধ হয় আমরা মনে মনে চির্‌কি মুরমু নামে বনের লতার মতো না দেখা একটি মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম- না, তোমার বন্ধু পালিয়ে যাবে না,। আমরা প্রার্থনা করছি, হোরো তোমার কাছে ফিরে যাবে।

ফাদার লিন্ডনের গর্জন শুনতে পেয়ে চমকে উঠলাম। বোর্ডিংয়ের বারান্দায় অন্ধকারে যেন একটা ধস্তাধস্তি চলছে। টুডু দৌড়ে গিয়ে ঘটনা স্বচক্ষে দেখে ফিরে এল।সন্ত্রস্তের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।ফাদার লিন্ডন হেরোর বাঁশি ভেঙে দিয়েছে।

আমাদের সবার মনে একসঙ্গে ধক করে কতগুলি প্রতিহিংসার শিখা জ্বলে উঠল। রাগের মাথায় বললাম- ঘা কতক জমিয়ে দিতে পারল না হোরো?

টুডু বিমর্ষ ভাবে বললে- আমারও কেমন ভয় হচ্ছে। হোরো বড়ো  গোঁয়ার। ফাদারকে এর ফল টের পাইরে দেবে স্টিফান।

কিন্তু এর পর স্টিফান হোরোর গুয়ার্তুমির কোনো প্রমাণ পেলাম না। বরং দেখলাম, গোঁ ধরেছেন  ফাদার লিন্ডন। ফাদার লিন্ডনের অভিযান আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে একবার সফরে বের হন। কখনও ভোজপুরি লেঠেলে সঙ্গে যায়, কখনও বা আট দশটা কনস্টেবেল। থানাতে একটা চিঠি দিলেই কনস্টেবল চলে আসে। যেন একটা যোদ্ধার দল নিয়ে দুদিনের জন্য জঙ্গল এলাকায় অদৃশ্য হয়ে যান ফাদার লিন্ডন। সত্যি তিনি একজন ধর্মযোদ্ধা। আমারা শুধু মনমরা হয়ে ভাবতাম ফাদার লিন্ডনের এই রহস্যময় আনাগোনা কবে বন্ধ হবে? কবে শান্ত হবে তার লালচে  মুখের উত্তেজনা?

টুডুর কাছে শুনে স্পষ্ট করে বুঝলাম- মোরাঙ্গি পাহাড়ের মুরমুদের ডিহিতেই ফাদার লিন্ডনের অভিযান শুরু হয়েছে। পাহাড়ের গায় এরই মধ্যে একটি মাটির গির্জা তৈরি করে ফেলেছেন ফাদার লিন্ডন। অরণ্যের বুকের ভেতর ঢুকে তিনি যেন লক্ষ বছরের বৃদ্ধ যত বোঙাদের শিলাময় বেদি কাঁপিয়ে দিয়ে এসেছেন।

খুব বেশি দিন পার হয়নি, শুনলাম, মোরাঙ্গি পাহাড়ে একটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। মাটির গির্জা ভেঙ্গে ধুলো করে দিয়েছে। কে করেছে?

যে করেছে, তাকে আমরা স্বচক্ষে দেখলাম। বুড়ো সোখা। সেসন জজের আদালতে ভিড়ের মধ্যে মাথা গুঁজে আমরাও রায় শুনলাম- বুড়ো সোখার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।

স্টিফান হোরোকে দেখতাম, বোর্ডিংয়ের বাগানে একটা বুড়ো বটের ঝুরিতে দোলনা বেধেঁ সময় অসময় শুধু দোল খায়। দুলে দুলে যেন এক দুঃসহ গায়ের জ্বালা জুড়িয়ে নিচ্ছে স্টিফান হোরো।

নন-কো অপারেশনের ঝড় রইল সারা দেশে, আমরা স্কুল ছাড়ব। জালিয়ানওয়ালাবগের  অপমান আমাদের অশান্ত করে তুলল।

আমরা বাঙালি আর বিহারি ছেলেরা স্কুল ছাড়লাম। রাজার ছেলেরা কেউ ছাড়ল না। খ্রিস্টান ছেলেরাও নয়- টুডু টিগ্‌গা বেস্‌রা খাল্‌খো কেউ নয়। আমরা পিকেটিং করে ওদের বাধা দিতে লাগলাম!

আমাদের খুব ভরসা ছিল, হোরো আমাদের দলে আসবে। ফাদার লিন্ডন যেভাবে ওকে অপমান করেছে, জীবনে সে আর কোনো পাদরি বা সাদা চামড়াকে সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ।

আমরা স্কুলের ফটকে পিকেটিং করেছিলাম। দেখলাম হোরো আসছে।– স্বতন্ত্র ভারত কি জয়! জয়ধ্বনি করে আমরা হোরোকে অভ্যর্থনা জানালাম।

হোরো এগিয়ে এসে ইন্দুকে একটা ধাক্কা দিল, পরেশের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। বন শুয়োরের মতো গোঁ গোঁ করে পথ করে নিয়ে ক্লাসে ঢুকল।

সেইদিন হোরোকে আমরা ভালো করে চিনলাম। পাদরিদের ক্রীতদাস, মনুষ্যত্বহীন, মর্যাদাশূন্য, মূর্খ জংলি হোরো। স্বতন্ত্র ভারতবর্ষকে চিনল না, একটু শ্রদ্ধা করল না। চিনল শুধু ওর জঙ্গলটাকে। কিন্তু তোর জঙ্গলটা যে ভারতবর্ষের মধ্যেই রে বনবৃষ! ভারতবর্ষের বাইরে তো নয়।

আট বছর পরের কথা। আমি লোপো খানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা। সকালবেলায় কজন বিরসাইট মুন্ডা এসেছে হাজিরা দিতে। জেল থেকে আজ ই ওরা খালাস পেয়েছে। এখানে হাজিরা দিয়ে তারপর নিজের নিজের ডিহিতে চলে যাবে। বিরসাইটরা অত্যন্ত সন্দেহভাজন জীব। প্রতি বছর হাঙ্গামা বাধায়। পুলিশকে ব্যতিব্যস্ত করে। জঙ্গল আইন মানে না, মহাজনদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়, চৌকিদারি ট্যাক্স দিতে চায় না। বাজারে বসলে তোলা দেবে না। জমি ক্রোক করতে গেলে আদালতের পেয়াদাকে টাঙি নিয়ে কাটতে আসে। দুবছর আগে একবার স্বরাজ ঘোষণা করেছিল বিরসাইট মুন্ডারা, পাদরিকে মেরেছে, পুলিশকে মেরেছে, অনেকগুলি পুল ভেঙেছে। ওরমান্‌ঝির জঙ্গলে একটা খন্ড যুদ্ধ হয়েছিল ওদের সঙ্গে।

সবচেয়ে শেষে হাজিরা লেখাতে যে লোকটা উঠে এল তার নাম রুন্‌নু হোরো।

ডায়েরির ওপর থেকে চোখ তুলে লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। তার মাথার চুলে জংলি খোঁপাটাও জটার চূড়ার মতো হয়ে গেছে। গলায় একটা ভেলাফলের মালা,আদুর গা,কোমরে ছোটো একটা কাপড় জড়ান।হাতে একটা কাসাঁর বালা। এই প্রাগৈতিহাসিক সজ্জার মধ্যে শুধু একজোড়া সুশানিত আধুনিক চোখ…।

বিস্ময় চাপতে গিয়ে তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম- স্টিফান হোরো।

লোকটা মিষ্টি হেসে বলল- না না। ঘোষ, আমি রুন্‌নু হোরো।

-তুমিও একজন বিরসাইট?

-আমি বিরসা ভগবানের শিষ্য !

-বিরসা ভগবান? কে সে?

– সে আমাদের গান্ধি ছিল ঘোষ। আমি তাঁকে চোখে দেখিনি, আমরা বাবার মুখে তাঁর কথা শুনেছি। ইংরেজের জেলখানার অন্ধকারে একজন কয়েদির মতো মরে গেছে আমাদের বিরসা ভগবান। তাঁর চেহারা দেখতে কেমন ছিল জানো ঘোষ।

– কেমন?

– যীশু খ্রিস্টের মতো।

একটু চুপ করে থেকে হোরো বলল – আমাদের জঙ্গলে বাইরে থেকে অনেক পাপ এসে ঢুকেছে, ঘোষ। তাই বিরসা ভগবান আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন। তাঁর অনুরোধ কি ভুলতে পারি ?

আমি ডাকলাম। – স্টিফান হোরো।

হোরো প্রতিবাদ করল। – বলো, রুন্‌নু হোরো।

চুপ করে গেলাম। হোরো নিজে থেকেই খুশি হয়ে নানা খবর জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করল। – ইন্দু কোথায় ? পরেশ কী করছে ?

চার দিক একবার সাবধানে তাকিয়ে নিয়ে হোরোকে প্রশ্ন করলাম – এত রোগা হয়ে গেলে কেন হোরো ?

হোরো – আমার টি–বি হয়েছে। আচ্ছা, এবার যাই আমি।

একটা  কথা জানবার জন্য মনটা ছটফট করছিল। তবু সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। শেষে সাহস করে বলেই ফেললাম।-একটা খবর জানতে বড়ো ইচ্ছে করছে হোরো।

হোরো – বলো।

জিজ্ঞাসা করলাম – চির্‌কি মুরমু কোথায় ?

হোরো শান্তভাবে উত্তর দিলো। – ও, জানো না বুঝি ? ফাদার লিন্ডনের মিশনে চলে গেছে চিরকি। খ্রিস্টান হয়েছে। এখন হাজারিবাগের কনভেন্টে থাকে।

স্টিফানের চোখের দৃষ্টিটা চিকচিক করে উঠল, তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতোই, কিন্তু জলে ভেজা। আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করা হল না, স্টিফানও নিঃশব্দে চলে গেল।

কাউকে মুখ ফুটে বলতে লজ্জা করবে, একটা ভুলের স্মৃতি কিছুক্ষণের জন্য কাঁটার মতো মনের মধ্যে বিঁধছিল, হয়তো আমরাই নিরপেক্ষ থেকে চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধে স্টিফানকে হারিয়ে দিলাম। স্টিফানও বনবাসে চলে গেল।

সমস্ত গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের সাজেশন পেতে এখানে CLICK করো। 


Share
Tweet
Pin
Share
No comments
Newer Posts

Followers

Pages

  • Home
  • Privacy Policy
  • Disclaimer
  • CONTACT ME
  • About Me

Contact Form

Name

Email *

Message *

About me

Hallow viewers , myself Nandan Dutta [Subhankar Dutta], reside at Maheshpur,Malda.
I made this website for the students of B.A. courses under Gour Banga University. Here you can get suggestions of different subjects like HISTORY , SOCIOLOGY , POLITICAL SCIENCE & EDUCATION.
In future I will add MCQ sections of those subjects.


Categories

  • 1ST SEMESTER SUGGESTION (1)
  • 2 ND YEAR SUGGESTION (1)
  • 2ND SEMESTER (1)
  • 3RD SEMESTER (8)
  • BENGALI NOTES (21)
  • CU suggestion. (1)
  • EDUCATION NOTES (141)
  • ENGLISH COMPULSORY (16)
  • GBU Suggestion. (7)
  • HISTORY EUROPE & WORLD (46)
  • HISTORY NOTES (68)
  • POL SC NOTES (64)
  • SOCIOLOGY NOTES (72)
  • WBCS 2020 (1)

recent posts

Blog Archive

  • May 2025 (3)
  • April 2025 (20)
  • March 2025 (12)
  • February 2025 (8)
  • November 2024 (5)
  • October 2024 (2)
  • September 2024 (2)
  • June 2024 (2)
  • March 2024 (6)
  • February 2024 (4)
  • October 2023 (5)
  • May 2023 (5)
  • April 2023 (1)
  • December 2022 (1)
  • November 2022 (13)
  • September 2022 (2)
  • August 2022 (7)
  • July 2022 (29)
  • June 2022 (10)
  • May 2022 (25)
  • April 2022 (24)
  • March 2022 (16)
  • February 2022 (19)
  • January 2022 (21)
  • December 2021 (46)
  • November 2021 (5)
  • October 2021 (6)
  • September 2021 (5)
  • August 2021 (41)
  • July 2021 (43)
  • June 2021 (31)
  • May 2021 (7)
  • April 2021 (1)
  • July 2020 (1)
  • June 2020 (3)
  • April 2020 (1)
  • November 2019 (1)
  • July 2019 (1)
  • June 2019 (1)
  • May 2019 (1)
  • April 2019 (2)
  • January 2019 (1)

Pages

  • Home
  • 2nd SEM ভাষাতত্ত্ব :
  • বাংলা উপভাষা
  • দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব
  • ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত সাম্যের অধিকারগুলি আলোচনা করো।
  • হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব আলোচনা করো। তাকে কি উত্তর পথনাথ বলা যায় ?
  • ভারতীয় সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য :-
  • উদারনীতিবাদ : সংক্ষিপ্ত ধারণা :-
  • চোল শাসনব্যবস্থা :-
  • গুপ্তযুগ সুবর্ণযুগ সম্পর্কিত আলোচনা।
  • ৬. উদাহরণসহ মধ্যযুগের বাংলাভাষার কয়েকটি বৈশিষ্ট আল...
  • 1. Marxism
  • আধুনিক বাংলা ভাষা ও তার বৈশিষ্ট।
  • Discuss the career and achievements of Samudragupta .
  • ভাষাতত্ত্ব

Created with by ThemeXpose | Distributed by Blogger Templates